Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লৈঙ্গিক রাজনীতির কবলে শিশুর খেলনাও!


১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ১৪:২০

রাজনীন ফারজানা।।

কোথাও আগুন লাগলে অগ্নি নির্বাপনের গাড়ি ছুটে আসে। গাড়ি থেকে ধুপ ধাপ করে অগ্নি নির্বাপনকর্মীরা নেমেই বড় বড় হোস পাইপ নিয়ে ছোটে, বিশালাকৃতির ক্রেন নিয়ে উঠে যায় আগুন লাগা ভবনের ছাদে কিংবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢুকে পড়ে আগুনের ভেতরে জীবিত কাউকে উদ্ধার করতে। কাজটা যেমন সাহসিকতার তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ।

আবার বিশাল কোন বিল্ডিং, রাস্তা বা ব্রিজ বানানো হচ্ছে। সেখানে মাথায় হলুদ হেলমেট আর গায়ে কমলা জ্যাকেট পরে ছুটোছুটি করতে দেখা যায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আর্কিটেক্টদের। এধরণের কাজেও ঝুঁকি কম নাই। যখন তখন ঘটতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা।

অগ্নি নির্বাপন, ভারি নির্মান, ট্রেন চালনা, দুরপাল্লার বাস বা ট্রাক চালনা, ক্রেন চালনা, জাহাজ বা যুদ্ধজাহাজ চালনার মত ঝুঁকিপূর্ণ যেসব কাজ আছে সেসব কাজে মেয়েদের উপস্থিতি দেখাই যায় না বলতে গেলে। আবার ঘর সংসার সামলানো, বাচ্চা মানুষ করা, গৃহস্থালি কাজে পুরুষের উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়ে না এদেশে। অর্থাৎ পেশা এবং দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রবল লিঙ্গ বৈষম্য দেখা যায়।

শিশুর খেলনা

শুধু পেশা নয়, সমাজের নানা ক্ষেত্রেই লিঙ্গ বৈষম্য দারুণ প্রকট। এমনকি শিশুরা যে খেলনা নিয়ে খেলে সেখানেও লিঙ্গ বৈষম্য চোখে পড়ে। খেলনার দোকানে গেলে দেখা যায় একদিকে গোলাপির প্রাধান্য। পুতুল, কিচেন সেট, হাড়ি পাতিল, খেলনা মোবাইল, খেলনা ল্যাপটপ, গাড়ি, সফট টয়, সাইকেল এবং আরও যত খেলনা সব গোলাপি। অন্যদিকে আছে নানা আকারের ও গড়নের গাড়ি, প্লেন, ট্রেন, ছোট আকারের সুপার হিরো, একশন ম্যান (অগ্নি নির্বাপন কর্মী, পুলিশ, সৈন্য, বৈদ্যুতিক কর্মী ইত্যাদি) এবং আরও নানা ধরণের খেলনা। যখন কেউ মেয়ে শিশুর জন্য খেলনা কিনতে যায় তখন দেখা যায় স্বভাবতই গোলাপি সারির দিকেই যান। আর ছেলেদের খেলনার ক্ষেত্রে গাড়িই থাকে প্রধান পছন্দ।

বিজ্ঞাপন

 

শিশুর খেলনা

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, একটা শিশুকে জেন্ডার ইন্ডিপেনডেন্ট (লিঙ্গ বৈষম্যহীন) খেলনা দিলে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়। অথচ অনেকসময় খেলনার দোকানে বাবা মাকে ছেলেমেয়ের খেলনা আলাদা করে দেখানো হয়।

নাসরিন পারভীনের মেয়ের বয়স চার। তিনি বললেন যখন কোন দোকানে বাচ্চার জন্য খেলনা কিনতে যান তখন বিক্রয়কর্মী তাকে জিজ্ঞাসা করেন ছেলে শিশু নাকি মেয়ে শিশুর জন্য খেলনা কিনবেন তিনি। মেয়ের জন্য খেলনা কিনবেন বললেই তাকে পুতুলের সেকশন দেখিয়ে দেওয়া হয়। নাসরিন বলেন, ছোটবেলা থেকে সচেতনভাবেই মেয়েকে লিঙ্গবৈষম্যহীন খেলনা কিনে দেন। কিন্তু অনেকেই তার বাচ্চাকে পুতুল উপহার দেন। আবার তার মেয়ের স্কুলে টিফিনের সময় আয়ারা মেয়ে বাচ্চাদের হাড়িপাতিল, পুতুল দেয় আর ছেলে বাচ্চাদের লেগো সেট দিয়ে খেলতে দেয়। অথচ তার মেয়ে লেগো সেট দিয়ে খেলতে খুবই পছন্দ করে বলে জানান তিনি।

শিশুর খেলনা

কিন্ডারজয় নামে একটি জনপ্রিয় চকলেট আছে, যে চকলেটের মোড়কের ভেতরে শিশুদের জন্য সারপ্রাইজ খেলনা রাখা থাকে। এই চকলেটের মোড়কের ওপরে লেখা থাকে কোনটা মেয়ে শিশুর জন্য, কোনটা ছেলে শিশুর জন্য। দেখা যায় মেয়ে শিশুর জন্য পুতুল বা হেয়ার ব্যান্ড এবং ছেলে শিশুর জন্য গাড়ি, অস্ত্র বা পাজল ধরণের খেলনা রাখা থাকে।

খেলনার এই ভিন্নতার মাধ্যমে আসলে একটা শিশুর সামনে সমগ্র জেন্ডার সিস্টেম বা লিঙ্গভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কীভাবে চলে তা তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ নারী এবং পুরুষের আলাদা আলাদা স্বভাব, আচরণ এবং পছন্দ অপছন্দ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় শিশুর সামনে। এবং আশা করা হয় এই শিশুটি যখন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হবে তখন যেন লিঙ্গভিত্তিক সমাজের এইসব নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। এভাবেই gendered socialization নামক ব্যবস্থা টিকে আছে।

বিজ্ঞাপন

ধরা হয় লিঙ্গ ভিন্নতার বিষয়টা মানুষের ভেতরে প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। কিন্তু Social Learning Theory অনুযায়ী একটা শিশু বড় হয়ে মাসকুলাইন (পুরুষের মত) হবে নাকি ফেমিনাইন (নারীর মত) হবে তা আসলে নির্ভর করে তার বেড়ে ওঠায় সামাজিকতার প্রভাবের উপর। তাকে যেভাবে শেখানো হয় তাই শেখে। আর ‘শেখা’ বিষয়টা যতটা না প্রকৃতিক ততটাই সচেতনভাবে নির্মিত।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, একদম ছোট বয়সে (আর্লি চাইল্ডহুড) একটা শিশুকে যে ধারণা দেওয়া হয় সেভাবেই সে বেড়ে ওঠে। ধারণা গড়ার ক্ষেত্রে সমাজ, ধর্ম, পরিবার, মিডিয়া সবাই ভূমিকা রাখে বলে জানান তিনি।

শিশুর খেলনা

সামাজিকতার নানা উপকরণের মাঝে আছে বাবা-মায়ের আচরণ ও খেলনা। শিশুদের অনুকরণপ্রিয়তার কারণে তাদের সামনে একটা বিষয় যেভাবে উপস্থাপন করা হয় সেভাবেই সে শেখে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করে। একটা মেয়ে শিশু যখন দেখে মা রান্না করছে কিংবা তার যত্ন নিচ্ছে তখন সে কিচেন সেট দিয়ে রান্না করা-খাওয়ানোর অভিনয় করে, পুতুলের মা হয়ে তাকে গোসল করায়, ঘুম পাড়ায় ইত্যাদি। আবার একটা ছেলে শিশু যখন দেখে গাড়ি বাবা কিংবা অন্য পুরুষ চালাচ্ছে তখন সে গাড়িই কিনতে চায়।

অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, একটা শিশুকে জেন্ডার স্পেসিফিক (ছেলে ও মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা) খেলনা দেওয়া একধরণের লিঙ্গবৈষম্যমূলক আচরণ। এতে করে একটা শিশু ছোট থেকেই জানছে মহিলা এবং পুরুষদের কাজ আলাদা আলাদা। ফলে শিশুর cognitive development বা সামগ্রিক উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়।

 

শিশুর খেলনা

বাবা মায়েরা কি ভাবছেন এই নিয়ে? কথা হল কয়েকজন বাবা মায়ের সাথে।

শামিম আহমেদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কাজ করেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনা কেনার সময় লিঙ্গভিন্নতার বিষয়টা মাথায় আসেনি কখনও। চেষ্টা করেছেন লিঙ্গ বিভাজন না করে ছেলে মেয়ের পছন্দটাকেই গুরুত্ব দিতে। তার মেয়ের পছন্দ ছিল পুতুল, হাড়িপাতিল, লেগো, গাড়ি, বার্বি, টেনিস সেট, সাইকেল ইত্যাদি আর ছেলের পছন্দ ফুটবল, গাড়ি, লেগো, স্পাইডারম্যান, স্কুটি, সাইকেল এসব।

ছেলে কিংবা মেয়ে কাউকেই বন্দুক কিনে দেবেন না এমন মনঃস্থির করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার ছেলে নীচে খেলতে গিয়ে সবার হাতে বন্দুক জাতীয় খেলনা দেখে প্রতিদিন বাসায় এসে বায়না করত। অনেকদিন যাবত ওর বায়নায় কান না দিলেও একটা পর্যায়ে দেখেন ছেলে খুবই মন ছোট করছে এই নিয়ে। পরে ছেলেকে একটা খেলনা মেশিনগান কিনে দেন। তিনি মনে করেন, একটা শিশু কি খেলনা দিয়ে খেলবে তার পুরোটাই বাবা মায়ের হাতে থাকে না। সমাজ আর মিডিয়ার প্রভাবও নিয়ামক হিসেবে কাজ করে এক্ষেত্রে।

 

শিশুর খেলনা

 

কার্টুন চরিত্রের আদলে বানানো খেলনার প্রতি ছেলে মেয়ে উভয়েরই ঝোঁক থাকে। দেখা যায়, ছেলেরা সুপার হিরো পছন্দ করলেও মেয়েরা রূপকথার রাজকন্যার আদলে বানানো পুতুলই পছন্দ করে। অধ্যাপক শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, খেলনার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের পেছনে ব্যাবসায়িক চিন্তা ভাবনা কাজ করে। ব্যাবসায়ের স্বার্থেই জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রগুলোর আদলে খেলনা আসে বাজারে। এগুলো একটা শিশুর মানসিক গঠনে কতটা প্রভাব ফেলবে তা বিবেচনা করা হয়না বলে জানান তিনি।

বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন হারুনুর রশিদ। তার দুই মেয়ে। একজনের বয়স চার আরেকজনের এক। তিনি মনে করেন খেলনা একটা বাচ্চার মনসামাজিক গঠনে ভূমিকা রাখে। তার মেয়েরা যেন লিঙ্গ বৈষম্য শিখে বড় না হয় তাই তিনি মেয়েদের খেলনা কেনার সময় সচেতন থাকেন। তিনি মনে করেন একটা মেয়েকে পুরুষতান্ত্রিকতার দৃষ্টিতে যেভাবে দেখা হয় সেভাবেই একটা পুতুলকে বাজারজাত করা হয়। তার মেয়েরা যেন মেয়ে মানেই সাজুগুজু করা রাজকন্যাকে আদর্শ না ভাবে তাই তিনি তাদের পুতুল কিনে দেন না।  শিশুরা যেন চলাফেরা করে এমন খেলনা কিনে দেন তাই তাদেরকে সাইকেল, গাড়ি বা বল কিনে দেন। আবার শিক্ষণীয় খেলনা হিসেবে পাজল কিনে দেন।

শিশুর খেলনা

 

সংবাদকর্মী জিনিয়া আফরোজ চান তার সন্তান যেন কোনধরনের জেন্ডার স্টিরিওটাইপ (লিঙ্গ নিয়ে সাধরণ যে ভাবনা) মানসিকতা নিয়ে বেড়ে না ওঠে। তাই তার একুশ মাসের ছেলেকে ঘরের কাজ শেখানোর জন্য সচেতনভাবেই হাড়িপাতিলের সেট কিনে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি ছেলেকে বল, রঙিন ছবিযুক্ত বই, গাড়ি কিনে দেন। ছেলেকে কখনোই বন্দুক কিনে দেবেন না বলে মনঃস্থির করেছেন তিনি।

জামাল আহমেদ একজন শিল্পী। তার পাঁচ বছরের মেয়ের ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক। মেয়েকে তাই তিনি ছবি আঁকার সামগ্রি কিনে দেন সবচাইতে বেশি। স্টিকার, পুতুল ও ক্লে (খেলনা কৃত্রিম মাটি) দিয়ে খেলতেও পছন্দ করে সে। ক্লে দিয়ে ফুল, পিঠা, পাখি এসব বানায় বলে জানান জামাল।  মেয়ের জন্য ইউনিসেক্স টয় কেনার কথা কখনও মাথায় আসেনি বলেও জানান তিনি।

কথা হল স্টিকারের দোকানদার আলমগীরের সাথে। তিনি বললেন তার এখানে ছেলেদের জন্য স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, গাড়ির ছবিযুক্ত স্টিকার আছে। আর মেয়েদের জন্য আছে ফুল, প্রজাপতি, সিনডারেলা, এলসার ছবি দেওয়া স্টিকার। ছেলে মেয়ের স্টিকার আলাদা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্রেতা যা চায় তাই দেন তিনি। কেউ ছেলের জন্য ফুল বা প্রজাপতির আর মেয়ের জন্য গাড়ির স্টিকার কিনতে চাইলে তিনি তাই দেন।

যেহেতু শৈশবের খেলনা এবং খেলাধুলা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে ভূমিকা রাখে তাই শিশুর জন্য খেলনা বাছাই করতে সচেতনতার বিকল্প নাই। অধ্যাপক শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, পরিবারের পাশাপশি সচেতনতা তৈরিতে মিডিয়াকেও ভুমিকা রাখতে হবে। নারী পুরুষ ভেদাভেদ যত কম প্রদর্শন করা হবে একটা শিশু এব্যাপারে তত কম জানবে। তাই তিনি সচেতনতার পাশাপাশি কার্যকরী পদক্ষেপ রাখার উপর জোর দেন।

 

মডেল- উজান, অতন্দ্রিলা, নৈঋতা ও  রিসালাত

 

সারাবাংলা/আরএফ/ এসএস

 

 

 

 

লৈঙ্গিক রাজনীতি শিশুর খেলনা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর