‘মা’কে প্রতিদান দেওয়া যায় না’
২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৭
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: স্কুলশিক্ষক বাবা অলিউর রহমান দুই ছেলের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খেতেন। ছেলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকাও জোগাতে পারছিলেন না। ঠিক ওই সময়ে এগিয়ে আসেন মা আকলিমা বেগম। নিজের কানের দুল বিক্রি করে শেষ দিনে ছেলেকে ফরম পূরণের সুযোগ করে দেন। ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে ঢুকেই মায়ের সেই ত্যাগ আর অকৃত্রিম ভালোবাসাকে স্মরণ করলেন ছেলে। প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মায়ের কানে পরিয়ে দিলেন সোনার দুল, নিজের ফরম পূরণের সময় মায়ের কান থেকে খুলে পড়া দুলগুলোই যেন ফিরল মায়ের কানে।
বলছিলাম জামালপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সহকারী জজ হিসেবে সদ্য যোগ দেওয়া মনিরুল ইসলামের কথা, যিনি চাকরির প্রথম বেতন পেয়েই মায়ের জন্য কানের দুল গড়িয়েছেন। ১১তম জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় ১১তম স্থান অর্জন করেছিলেন মনিরুল ইসলাম। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর জামালপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সহকারী জজ হিসেবে যোগ দেন তিনি।
সেই মনিরুল অবশ্য মা’কে সোনার দুল কিনে দেওয়াকে প্রতিদান মনে করতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমি জানি এবং বিশ্বাস করি, কোনো কিছুর বিনিময়েই মাকে প্রতিদান দেওয়া যায় না, শুধু নিছক কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া। এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতি মায়ের ক্ষেত্রেই ঘটে। তাই সব মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর সীমাহীন ভালোবাসা।’
মনিরুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেছেন মা’কে নিয়ে তার এই এই ভালোবাসার কথা। লিখেছেন, ‘আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগের কথা। আমি তখন কলেজে পড়ি। কলেজের ফরম ফিলাপে বেশকিছু টাকা দরকার পড়ে। বাবা স্কুলের একজন সাধারণ শিক্ষক ছিলেন। যে টাকা সম্মানি পেতেন, তা দিয়ে আমার আর আমার ভাইয়ের পড়ালেখা চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। আর যখন কোনো বিশেষ পরিমাণ টাকার দরকার পড়ত, জমি বিক্রি ছাড়া উপায় ছিল না। আবার জমিও যে খুব বেশি ছিল, তা নয়। টাকার খুব জরুরি দরকার। খুব ক্রাইসিস চলছিল। বাবা অনেক চেষ্টা করেও জমি বিক্রি করতে পারলেন না। কিছুটা নিরাশ লাগল বাবাকে। তাহলে কি এবার আমার ছেলের ফরম ফিলাপ হবে না? বাবার চোখে মুখে বিষণ্নতা। ফরম ফিলাপের আর মাত্র একদিন বাকি। কী করা যায়, তা ভেবে নিশ্চুপ আমার বাবা।’
মনিরুল লিখেছেন, হঠাৎ বাবার কাছে আসলেন আমার মা, আর তার কান থেকে দু’টো সোনার গহনা খুলে বাবার হাতে তুলে দিলেন। আর বললেন, দ্রুত বিক্রি করে ফরম ফিলাপ করতে। বাবা সেই দুল বিক্রি করে আমাকে টাকা দিলেন, পরদিনই আমি ফরম ফিলাপ করলাম। সেদিন মা তার শখের জিনিসগুলো অবলীলায় দিয়েছিলেন আমার ভবিষ্যতের জন্য।
মনিরুল ওই ফরম পূরণের দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, চাকরি পেলে প্রথম বেতন তুলেই তা দিয়ে মায়ের জন্য ওই একই রকম সোনার দুল গড়িয়ে দেবেন। করেছেনও তাই। গত ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহ থেকে প্রথম মাসের বেতন তুলে মাকে না জানিয়েই গহনা কেনেন। তবে সেটা জানাননি মা’কে। মা যখন জানলেন, তখন তার হাতেই সেই গহনা।
ওই মুহূর্তটি তুলে ধরে মনিরুল লিখেছেন, মা আমার হাতে তার সেই চিরচেনা সোনার ঝুমকা দুল দেখেই কেঁদে ফেললেন। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। মা একটু আড়াল করেই তার চোখ মুছলেন। আমি নিজ হাতে মাকে সেই দুল পরিয়ে দেই। সে যে কী আনন্দ! এ এক পরম পাওয়া। এই অনুভূতি ভালোলাগার অনুভূতি।
যোগাযোগ করা হলে মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মায়ের ঋণ তো কখনও শোধ করা যায় না। এট ছিল কেবল কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা মাধ্যম মাত্র। নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যে মায়ের কাছে আমরা ঋণী, যে ঋণ কখনও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।’
মনিরুল বলেন, মায়ের স্বপ্ন ছিল, তার ছেলে একদিন বড় চাকরি করবে, জজ-ব্যারিস্টার হবে। আমি সবসময়ই মায়ের চোখে-মুখে এই স্বপ্নটা দেখেছি। মায়ের সেই স্বপ্নই আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। আজ চাকরি পেয়ে মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। তাতে যে তৃপ্তি, সেটাই আমার জন্য বড় পাওয়া।’
মায়েরা সন্তানের জন্য সবসময়ই বেশি কষ্ট করেন উল্লেখ করে মনিরুল বলেন, আমি দেখাতে চেয়েছি, ‘মাকেও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। তারা যে কষ্ট করেন সন্তানদের জন্য, তার তুলনায় আমার দেওয়া কানের দুল কিছুই না, একদমই কিছু না। কিন্তু তারপরও তার চোখে আমি পানি দেখেছি, যাকে বলে আনন্দঅশ্রু। এটা নিজের ভেতরে আমি সারাজীবন লালন করব। আর এটাও যে মনে রাখি সবসময়, মায়ের ঋণ কখনও শোধ করা যায় না।’
সারাবাংলা/জেএ/টিআর