‘পূর্ণিমা শীল করুণা ভিখিরি নয়, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান উন্নত শির’
১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৫৫
২০০১ সালের নির্বাচনের পর নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা শীলকে নিজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। সংবাদ মারফত থেকে আমরা জানতে পারছি মন্ত্রী মহোদয় তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন,
“পূর্ণিমা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। নিয়োগ দেওয়ার পর ফেইসবুক পেইজে ছবি দেওয়ার সময় তার ছবি আমি ব্লার করে দিতে চেয়েছিলাম, সে বললো ‘’ছবি দিতে কোনো সমস্যা নেই, এটি আমার লজ্জা না’।”
খবর থেকে আরো জানা যাচ্ছে, পূর্ণিমা পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় গান শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন।
পূর্ণিমার কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, তাঁর উপর চালানো নির্যাতন আসলেই তাঁর লজ্জা নয়। এই লজ্জা ওইসব বর্বর নরপিশাচদের, এই লজ্জা পুরুষের, এই লজ্জা সমাজের, এই লজ্জা সরকারের, এই লজ্জা রাষ্ট্রের, এই লজ্জা প্রাচীন পিতৃতন্ত্রের।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ গুহায় বসবাস করতো। প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হতো মানুষকে। নারী পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করতো সে সময়। খাদ্য সংগ্রহের পেছনেই তাদের জীবনের পুরোটা সময় কেটে যেতো। তাঁদের সেই আদিম সাম্যবাদী সমাজে বেঁচে থাকার উপকরণের অভাব ছিল কিন্তু তাঁদের মধ্যে ছলনা ছিল না, প্রতারণা ছিল না, হিংসার বিষ ছিল না, নারী নিপীড়নের ধারণাই ছিল না। সেই গুহাবাসী অরণ্যচারী মানুষের বংশধরেরা চন্দ্রবিজয় করেছে, মঙ্গলে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। দাবি করছে সে সভ্যতা নির্মাণ করেছে। অথচ কী হাস্যকর হয়ে ওঠে সে দাবি, যখন স্কুল পড়ুয়া চৌদ্দ বছর বসয়ী পূর্ণিমা ও তাঁর পরিবারকে অসভ্য মানুষের কুৎসিত চেহারা দর্শন করতে হয়! আহা, তখন সেই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়েছিল পৃথিবী, সভ্যতার মুখোশ খসে পড়ে নিমিষে, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল মানুষের যাবতীয় নির্মাণ, অহংকার।
অনেকদিন পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পূর্ণিমা আবার আলোচনায় এসেছে। তাঁকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ-ফিচার হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়ের বদান্যতার জয়জয়কর হচ্ছে। সরকারের বিশাল কৃতিত্ব হিসেবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অসম্পূর্ণ বিবর্তন হেতু প্রচুর নরবানরেরা পূর্ণিমাকে উপস্থাপনের ছলে তাঁর অতীত ব্যবচ্ছেদ করে অবদমিত বিকৃত কামনা মিটিয়ে নিচ্ছে।
সোজাসাপ্টা কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো তিতা তিতা লাগতে পারে, মনে হতে পারে ‘একটা ভাল’ উদ্যোগকে ব্যক্তিগত সংকীর্ণতার কারণে এবং অন্ধের মতো সরকারের বিরোধিতা করার নিমিত্তে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এরকম ভাবনাকারীদের সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। এই সুপার অপ্টিমিস্টিকদের কমবেশি আমাদের চেনা থাকার কথা। এরা ‘জী হুজুর’ শ্রেণির।
যাহোক, ভেবে দেখুন তো এপিএস হিসেবে পূর্ণিমার চাকরি পাওয়াটা তাঁর যোগ্যতার কারণে সম্ভব হয়েছে না কি তাঁর অতীত বেদনাদায়ক ঘটনা এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে? প্রশ্নটা প্রথমত আপনাকেই করছি যে এই লেখাটি পাঠ করছেন। মিস তারানা হালিমের কথায় স্পষ্ট, তিনি বলছেন, “আমার পরিকল্পনায় ছিল ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য কিছু করার’’। খুবই ভাল কথা, আমরাও চাই নির্যাতনের শিকার প্রতিটি নারী ন্যায্য বিচার পাক, সেই সাথে ক্ষতিপূরণও পাক। সমাজে তাঁরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকুক। কিন্তু আবারো বলতে চাই, পূর্ণিমাদের অতীত ঘটনা যেনো তাঁদের প্রাপ্তির একমাত্র কারণ না হয়ে ওঠে। আমরা যেনো ভুলে না যাই, পূর্ণিমা তাঁর জীবনের ওই ঘটনার পর থেমে থাকেনি। সে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিকমিউনিকেশনে পড়াশুনা শেষ করেছে। তারপর থেকে গান শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে সে। একরকম একজন শিক্ষিত নারীর চাকরির ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের ম্যানেজার হিসেবে সরকারেরইতো দায়িত্ব। যেমন দেশের লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাও তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুতরাং পূর্ণিমা কারও দয়া বা মহানুভতা ভিখিরি ছিল না।
এসব কথা বলার আরও একটি কারণ হলো, অতীতে আমরা দেখেছি বিশেষভাবে আলোচিত ঘটনার নায়ক কিংবা শিকার ব্যক্তিকে শোষক শ্রেণি ও এর পৃষ্ঠপোষকতাকারী সরকার বিবিধ পুরস্কার, উপঢৌকন দিয়ে বরণ করে করে নিচ্ছে। ব্যাপারটা বরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু দেখা গেছে এই বরমাল্য প্রদানের ঘটনা অত্যন্ত সুকৌশলে তাবেদার মিডিয়া ও অন্ধ স্তাবক বাহিনী দিয়ে প্রচার-প্রচারণার শীর্ষে নিয়ে গিয়ে কুৎসিত আত্মপ্রচারণায় নিমগ্ন হয়ে পড়ছে।
সাধারণত এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে তারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে এবং সেই সাথে অসচেতন নাগরিকদেরকে আফিম খাইয়ে ভুলিয়ে রাখার মতো করে দলীয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বিষয়টির উপর পুনঃ পুনঃ ফোকাস ফেলতে থাকে। মানে যেটা দাঁড়ায় -যার উপরকার করা হলো তাঁকে সকাল-বিকেল মনে করিয়ে দেওয়া, ‘দ্যাখো আমি কিন্তু তোমার উপরকার করলাম, মনে রেখো, ভুলে যেও না’। সেই সাথে আমারাও বিশ্বাস করতে শুরু করি আহা, দীঘির জলে একটা ফোটা শিশির না ফেললে দীঘিটি শুকিয়ে মরতো।
পূর্ণিমা শীলকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। এই কূপমণ্ডূক অন্ধ সমাজে সে যে সাহস ও আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়েছে তা বিরল উদাহরণ। পারিবার ও সামাজের পশ্চাৎপদতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতিত-অপমানিত অসহায় নারীটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বেঁচে থাকলে নির্মম গ্লানিকর জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বৈরি সামাজিক বাস্তবতায় পূর্ণিমার মতো নারীদের এরকম সাহস, আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ বিরল উদাহরণ। এরকম উদাহরণের সংখ্যা শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ তৈরি হোক। নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার দেশের সকল নারী পূর্ণিমার মতো সাহসে বলিয়ান হয়ে জেগে উঠুক। তাঁর সংগ্রাম যেনো একমাত্র উদাহরণ হয়ে না থাকে সেটাই আমাদের কাম্য হওয়া উচিৎ।
আর হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর অতীত ঘাঁটাঘাঁটি করা আদতে নোংরামী। যেমন সভ্য সমাজে কেউ না জেনে প্রয়াত কারও প্রসঙ্গ তুলে ফেললে কিংবা দুঃখজনক স্মৃতির কথা উত্থাপন করে ফেললে বিষয়টি জানার পর সাথে সাথে সরি’র পর সরি বলতে বলতে অস্থির হয়ে যায়। একে বলে সভ্য মানুষের আচরণ। আমরা এখনো অতো সভ্য হতে পারিনি।
[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]
সারাবাংলা/এসএস