একুশ আমাদের জীবনে সত্যিই কতটা জুড়ে আছে?
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৭:০০
তিথি চক্রবর্তী।।
একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে মিশে আছে বেদনা ও গৌরব। এই দিনটি নিয়ে এদেশের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা আছে। ভাষা আন্দোলনের সাথে মিশে আছে আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক চেতনা।
তবে একুশের চেতনা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি অর্থাৎ আমাদের জীবনে কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে? যে চেতনায় সেদিন বাংলা ভাষার দাবি পূরণ হয়েছিল তা ধারণ করতে পেরেছি কি? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাস্তার বিলবোর্ড বা দোকানের সাইনবোর্ডের নামও ইংরেজিতে লেখা। ইদানিং বিয়ের কার্ডেও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুদ্ধভাবে বাংলা বলতেও ভুলে যাচ্ছে অনেকে। ইংরেজি ও বাংলার সংমিশ্রণে কথা বলার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সন্তানকে এমনভাবে বড় করা হচ্ছে যেন বাংলা না জানাই গৌরবের। আবার অন্য দেশের পোশাক ব্যবহারও প্রবণতা হয়ে গেছে অনেকের।
বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে সেই জাতির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় জীবনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে। বায়ান্ন তথা একুশের ভাষা আন্দোলনের চরিত্র প্রধানত চারটি শ্লোগানের ভিত্তিতে প্রকাশ পেয়েছিল। সে চরিত্র রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিনির্ভর। স্লোগান চারটি হলো রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, শহীদ স্মৃতি অমর হোক এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু কর। প্রতিটি শ্লোগান বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ এগুলো বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘৪৭ সালে স্বাধীনতা এসেছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। তখন পাকিস্তান ছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। তখন পাকিস্তানে কমপক্ষে পাঁচটি জাতি ছিল। বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্দি, পাঠান ও বেলুজ। এই পাঁচটি জাতিকে একত্রিত করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ তৈরির চেষ্টা করা হল। এই ব্যাপারটি ছিল অসম্ভব কৃত্রিম। তখন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা শতকরা ৫৬ জন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৪৪ জন। তাদের মধ্যেও আবার কমপক্ষে চারটি জাতি। এদের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য পরিষ্কারভাবে দেখা গেল। পাঞ্জাবি সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রই হলো পাকিস্তানের শাসক। এটা ক্রমাগত প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ভাষা যদিও উর্দু না, তারপরও তারা উর্দুকে গ্রহণ করেছে। তারা পূর্ববঙ্গের ওপর যে আধিপত্য বিস্তার করেছে, ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তার প্রমাণ হলো তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছে। পাকিস্তানীরা উর্দু ভাষার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল রাষ্ট্র। কিন্তু জিন্নাহ বুঝেছেন, ধর্ম দিয়ে হবে না। জাতীয়তা তৈরি করতে হলে ভাষা দরকার। সেই ভাষা হবে উর্দু। তিনি বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত বুঝতে পারলো, তাদের এখন উর্দু শিখতে হবে। আর যারা জন্মগতভাবে উর্দু জানে তাদের সুবিধা হবে। বাঙালি মধ্যবিত্তরা বঞ্চিত হবে। তাই মধ্যবিত্ত বাঙালিরা সচেতন হলো। এটাকে মেনে নেয়নি। তখন বলা হলো, বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা।’
তিনি বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী জায়গা থেকে একটা নতুন জায়গা এলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এই চিন্তা দাঁড়িয়ে গেল। তখন বাঙালি মধ্যবিত্তরাই আন্দোলন শুরু করলো। ছাত্ররা এগিয়ে এলো। সাধারণ মানুষও এতে যোগ দিল। কারণ সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা ছিল, পাকিস্তান তাদের মহাজনী সুদ, জমিদার অত্যাচার, আমলাদের নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু মুক্তি আসলো না। তখন তাদের মনের দুঃখ মধ্যবিত্তের সাথে মিলে গেল। এরপর বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম ছাত্রহত্যা করা হলো। এই ঘটনা ছড়িয়ে গেল। সমস্ত পূর্ববঙ্গ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেল। তারপর পাকিস্তনীরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন আরও এগিয়ে গেছে। কারণ বাঙালিরা বুঝেছে আসল উদ্দেশ্য হলো, পাঞ্জাবিদের সামরিক আমলা ও বেসামরিক আমলার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, শতকরা ৫৬ জনের ভাষার স্বীকৃতি, আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়তে থাকে এবং ’৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ হয়।’
একুশের চেতনা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘একুশের চেতনা হলো একটি ইহজাগতিক চেতনা। পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ছিল। আর একুশের চেতনা ইহজাগতিক। ভাষা হচ্ছে একটি ইহজাগতিক ব্যাপার। এটি ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসেছে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভাষার কোন ধর্ম নেই, তেমনি ভাষার কোন শ্রেণীও নেই। ভাষা সকল মানুষের। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা ও শ্রেণী বিভাজন দূর করার আগ্রহও ভাষা আন্দোলনে নিহিত ছিল। এটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেতনা নয়, এটি বৈপ্লবিক চেতনা।’
এখন তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে সমাজে। ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা। উচ্চবিত্তরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করছে, বাংলা মাধ্যমকে বেছে নেয় মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা। আর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে নিম্নবিত্তের সন্তান। শিক্ষাব্যবস্থার এই বিভক্তির কারণে মানুষে মানুষে রুচি, সংস্কৃতিতেও পার্থক্য ঘটে।
এই প্রসঙ্গে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘একুশের চেতনা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়নি। শ্রেণী বিভাজন রয়েই গেছে। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হলো তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। এটি পাকিস্তান আমলেও ছিল। কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখেছি বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা থাকবে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে একধারার শিক্ষা হবে। কিন্তু তা হলো না। শ্রেণী বিভাজন শুধু রয়েই গেল না, এটি দিন দিন আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্তরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করছে, উচ্চবিত্তরাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক বৈষম্যকে প্রধান করে দেখা হয়েছিল। এখন শ্রেণী বৈষম্য প্রধান। দেশ যত উন্নত হচ্ছে, শ্রেণী বৈষম্য ততই বাড়ছে। একারণে বাংলাভাষা মর্যাদা পাচ্ছে না। বাংলাভাষার সম্ভাবনা বিকশিত হচ্ছে না।’
একুশ মানেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই চেতনা মানুষ ধারণ করতে পারছে কিনা জানতে চাইলে কবি ও কথাসাহিত্যিক মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের চেতনা হলো অসাম্প্রদায়িকতা, যুক্তিবাদিতা মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদাবোধের। ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে এই চেতনাগুলো ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আর নেই। সাধারণ মানুষের এখনও দেশের জন্য ত্যাগ করার মানসিকতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশ যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের মধ্যে এই অঙ্গীকার নেই। ফলে অসাম্প্রদায়িকতা দিন দিন বাড়ছে। একইসাথে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও যুক্তিবাদীতার অভাব প্রকট হয়েছে।’
বাংলাভাষার মর্যাদা দিন দিন কমে যাচ্ছে এমন মন্তব্য করে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীর মাতৃভাষার সংখ্যা দিয়ে বাংলা, বাঙালীর অবস্থান পঞ্চম। কিন্তু বাঙালির কোন মর্যাদা নেই। তার কারণ, এই দেশেরই কোন মর্যাদা নেই। বাংলার সেই জ্ঞান অনুশীলন ও চর্চা নেই। যার কারণে একুশের চেতনা রূপায়ন হয়নি। শ্রেণী বিভাজনের কারণে বাংলাভাষা উচ্চবিত্তরা চর্চা করছে না, মধ্যবিত্তরা কোন রকম করছে, বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা অক্ষর জ্ঞানও অর্জন করেছে তাদের জীবনেরও বাংলাভাষার কোন ব্যবহার নেই। আবার যারা মাদ্রাসার পড়ে তারা গরীব মানুষ, তারা আরেকটি ধারায় শিক্ষা নিচ্ছে।’
একুশের চেতনা আমাদের সংস্কৃতিতে কতটা রূপায়িত হচ্ছে জানতে চাইলে কথাসাহিত্যক মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ-উচ্চারণ সবকিছু নিয়েই তার সংস্কৃতি। আমরা অন্যদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবো, প্রয়োজন হলে চর্চা করবো। যেমন ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষা আমাদের জানতে হবে। কখনও কখনও চর্চা করতে হবে। কিন্তু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি হলো একটি জাতির স্বকীয়তা। যারা নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে তারা নিজেকেই চেনে না। এদের দেখলে আমার করুণা হয়।’একুশের চেতনা ধারণ করাই বড় কথা। তা না হলে এই দিনটি নিছক একটি ‘দিবস’ উদযাপনের মধ্যেই হারিয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষা, রুচি, মূল্যবোধ, মানবিকতা ও জীবনাচরণে একুশের গৌরবগাঁথা প্রভাব ফেলবে না। এই প্রসঙ্গে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একুশের চেতনা শ্রেণী বিভাজন বিরোধী। একুশের চেতনা রুপায়ন করতে হলে শ্রেণী বিভাজন দূর করতে হবে। তবে পুঁজিবাদী সমাজে বাংলাভাষার মর্যাদা বাড়বে না।’ এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আলোকচিত্র- আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন
ফিচার ছবি ডিজাইন- আবু হাসান
সারাবাংলা/টিসি/ এসএস