ইউটিউব ভিডিও’র নামে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়লাম !
১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:৫৮
নারী নির্যাতনের ঘটনা একেবারেই স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে। ব্যাপারটা এমন যে, নারী হলো সমাজের সবচেয়ে ‘সস্তা বস্তু’। যে কেউ, যে কোন সময়, যে কোনভাবে চাইলেই নারীকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে, বলতে পারে! এর মধ্যে নারী নির্যাতনের নতুন শাখা ‘সাইবার ক্রাইম’। ইন্টারনেটকেন্দ্রিক নির্যাতনের ঘটনা ইতোমধ্যে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন বাড়ছে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক এর তথ্য অনুযায়ী, তাদের কাছে শতকরা ৭০ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের পক্ষ থেকে ৷ গত ৫ বছরে প্রায় দুইশ’ গুণ বেড়েছে সাইবার অপরাধের মামলা। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার মামলা এসেছে।
সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য মতে, ২০১৩ সালে মামলা হয় ৩টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি এবং ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫৫৭টি।
বহু নারীর জীবন প্রতিনিয়তই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে এই সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে পড়ে। তথাকথিত সামাজিক সম্মান, লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নারীই মুখ খুলছেন না। কেউ নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে আড়াল করছেন, আবার কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ।
সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন- টুইটার, ভাইবার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক এবং ইউটিউব। তেমনি ইউটিউবের এক নারী অবমাননাকর ভিডিওর বিরুদ্ধে গত কয়েকদিন ধরে আমরা অনেকেই অনেক কথা বলেছি।
কেন নারী অবমাননাকর বলছি আমরা? কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ভিডিওটি? ভিডিওতে বলা হয়েছিলো- ছেলেরা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারলেও নারীরা তা কোনোভাবেই করতে পারবেন না। কারণ, নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পরিবেশের নাকি বিশাল একটা পরিবর্তন হয়ে যায়! তাই নারীরা ধূমপান করতে চাইলে ঘরে বসে করতে হবে। শুধু তাই নয়, ভিডিওটিতে আরও বলা হয়েছে, কোনো মেয়েকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখলে, সাথে সাথে ভিডিও করে ভাইরাল করতে হবে। আর, ছেলেরা বহাল তবিয়তে সব জায়গায় ধূমপান করতে থাকবেন। কারণ, পাবলিক প্লেসগুলো সব পুরুষদের বাপের মানে পুরুষদেরই কিনে নেওয়া। সেখানে নারীরা বানের জলে ভেসে এসেছে আর কী!
৬/৭ দিন আগে রোমা দি প্রথম ভিডিওটি আমার দৃষ্টিগোচর করে। তারপর থেকেই আমরা কিছু মানুষ পদক্ষেপ নেই সেই নারী অবমাননাকর ভিডিও এবং ভিডিও নির্মাতা টীমকে রুখে দেওয়ার। কেন ৫/৬ দিন ধরে আমরা কিছু মানুষ আমাদের ব্যক্তিগত কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে এই ভিডিও নির্মাতাদের নিয়ে পড়েছিলাম? আমাদের কি ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ ছিলো? আমরা কি সবাই ধূমপান করি?
উত্তরটা হলো- না, আমরা যারা প্রতিবাদ করেছি তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ধূমপান করি না। আমি নিজে চরমভাবে ধূমপানবিরোধী একজন মানুষ। অধূমপায়ী হবার কারণেই হয়তো কেউ যখন সিগারেট টেনে আমার আশে পাশে ধোঁয়া ছাড়ে, আমার তখন চরম বিরক্ত লাগে। তাই, এটা যদি ধূমপানবিরোধী কোন প্রচার হতো, যদি বলা হতো যে পাবলিক প্লেসে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে কেউ সিগারেট খেতে পারবে না- তাহলে এই নির্মাতাকে আমি স্বাগত জানাতাম। কিন্তু না, এই ভিডিওটি কোন ধূমপানবিরোধী প্রচার ছিলো না। বরং এটা ছিলো উগ্র পুরুষতান্ত্রিতার গল্প; নারী স্বাধীনতাবিরোধী প্রচার। তাই, আমরা প্রতিবাদ করেছি, পদক্ষেপ নিয়েছি ভিডিও নির্মাতা এবং অভিনেতার বিরুদ্ধে। কারণ, এরাই আমাদের আগামি প্রজন্ম। এদের নিয়েই আমরা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। এরা যেন এদের মনের মধ্যে এমন কোন বৈষম্য নিয়ে বেড়ে না ওঠে যে, নারীরা দুর্বল। এরা যেন এটা মনে না করে যে, পুরুষ চাইলেই নারীকে যৌক্তিক-অযৌক্তিকভাবে, সময়ে-অসময়ে শাসন করতে পারে। নারী বলেই যেন ‘এটা করা যাবে না’, ‘ওটা করা যাবে না’ বলে বাঁধা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারে। কোনও পুরুষই যেন কোনও নারীর উপর আঙুল তুলে নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরাকে বাঁধাগ্রস্ত করতে না পারে।
আমাদের সমাজে নারীবিদ্বেষ নতুন কোন ইস্যু নয়। কিন্তু এই ২২/২৩ বছরের ছেলেগুলো এতটুকু বয়সেই যে নারী বিদ্বেষ ভেতরে পোষন করে রেখেছে সেটি ভাবিয়েছে আমাকে।
প্রথমদিন ভিডিওটি দেখার পরই প্রচন্ড শঙ্কিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মতো নারীর প্রতি অসহিষ্ণু এবং যৌন সন্ত্রাসপ্রবন একটি সামাজ ব্যবস্থায় এরকম নারী অবমাননাকর, বৈষম্যমূলক এবং নারীদের হেয়প্রতিপন্ন করতে উসকানি দেওয়া ভিডিও ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে এটা নিশ্চিত ছিলাম। তাই, শুরু থেকেই সোচ্চার হয়েছিলাম আমরা ওদের রুখে দিতে।
প্রথমদিন থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি ভিডিওর স্ক্রিপ্ট রাইটার, ডিরেক্টর হায়াত মাহমুদ ও অভিনেতা সাব্বির অর্ণবের সাথে যোগাযোগ করে ভিডিওটি ডিলিট করানোর। কিন্তু তারা সেটা না করায় আমরা আইনি পথে যেতে বাধ্য হই।
১৬ জানুয়ারি ‘বৈষম্য’ ভিডিওটির নির্মাতা এবং অভিনেতার বিরুদ্ধে আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘সাইবার ক্রাইম ইউনিট’-এ লিখিত অভিযোগ জানাই। ১৭ জানুয়ারি আমাদের উপস্থিতিতে নির্মাতা এবং অভিনেতাকে ফোন করে ডিএমপি-র ‘সাইবার ক্রাইম ইউনিটে’ ডেকে আনা হয়। এরপর তারা তাদের কৃতকার্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় আমাদের কাছে। আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসেসের সাথে আরও যারা যুক্ত ছিলেন, আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, কয়েকটি শর্ত দিয়ে আমরা ওদের একটি সুযোগ দিবো। কারণ, আমরা মনে করি, কেউ ভুল করে অনুতপ্ত হলে, ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা উচিৎ। একবার সুযোগ দেওয়া উচিৎ শুধরে নেওয়ার। তাই, আমরা তাদের কয়েকটি শর্ত দিয়ে শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি।
শর্ত গুলো ছিলো –
১. লাইভে এসে সবার কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া,
২. মুচলেকা দেওয়া যে, ‘ভবিষ্যতে এমন কোনও কাজ তারা করবে না’,
৩. নির্মাতা এবং অভিনেতা কর্তৃক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুকে থাকা এ সংক্রান্ত সব ভিডিও ডিলিট করা,
৪. এই ঘটনা থেকে তারা যে শিক্ষা পেয়েছে সেটা নিয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য একটি ভিডিও নির্মাণ করে প্রচার করা
শর্ত মেনে নির্মাতা এবং অভিনেতা ফেসবুক লাইভে বিষয়টির জন্য ক্ষমা চেয়েছে, মুচলেকা দিয়েছে। ক্ষমা চাওয়ার ভিডিও লিংক: https://www.facebook.com/hmrahat2/videos/2021288028083915/?hc_location=ufi
প্রায় সবগুলো ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেইজ থেকে ভিডিওটি ডিলিট করা হয়েছে এবং শেষ শর্ত মেনে এই ঘটনা থেকে গৃহীত শিক্ষা নিয়েও তারা একটি ভিডিও বানিয়ে সবাইকে সচেতন করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই- ডিএমপির ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’কে। বিশেষ করে এডিসি Najmul Sumon ভাইকে। তিনি গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন আমাদের অভিযোগ এবং তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন। সারাদিন আমাদের অত্যাচার সহ্য করেছেন, দুপুরে খাইয়েছেন (মাটন খিচুড়িটা মজার ছিলো)। পুলিশের ভাবমূর্তি আমাদের সমাজে যেহেতু ইতিবাচক কিছু না, তাই ‘সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন’ সম্পর্কেও মানুষের তেমনই ধারণা। তাই আমরাও ইত:স্তত বোধ করেছিলাম কী করবো না করবো ভেবে। কিন্তু তারপরও বিশ্বাস ছিল যে, সবাই মিলে কোনো উদ্যোগ নিলে কিছু একটা ফল পাবো; পেয়েছিও। অনেকদিন পর আবার মনে হলো- পুলিশ জনগণের বন্ধু।
এই ভিডিও ভাইরাল হবার শুরু থেকে যে মানুষগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। আর যাদের কথা না বললেই নয়, যাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য ছাড়া এই কাজটি করা সম্ভব হতো না সেই Jharna Moni, Irani Bilkis Khan, Rumana Iqbal, Farhana Huq Nila, Swapna Chokroborty, Shabana Seju আপুসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। Supriti দি আর Roma দি তো সবসময়ের, সব কাজের কাজী। তারা প্রতিটা মুহূর্তে নিজের কাজ ফেলে ‘বনের মোষ তাড়িয়েছেন’। অবশেষে আমরা পেরেছি নারী অবমাননাকারীদের রুখে দিতে।
অবশেষে এটা প্রমাণ হয়েছে, আমরা এক হলে যে কোনও অন্যায়কে রুখে দেওয়া সম্ভব। আমাদের একতা থাকবে এবং এখন থেকে কোনও নারীকে কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্যক্ত করা হলে বা নারীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর কোন কন্টেন্ট প্রচার করা হলে আমরা তার বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। আমাদের যাত্রা এখানে সবে শুরু।
শেষ করছি একটা তথ্য দিয়ে। ভিডিওটির নির্মাতা এবং অভিনেতা আমাদের সব শর্ত মেনে নেওয়ায় আমরা সেদিন মামলা করিনি। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রটি বন্ধ হয়ে যায়নি। ক্ষমা চাওয়ায় ওদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে নিজেদের শুধরে নেওয়ার। তারা কোন শর্ত না মানলে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে গিয়ে যে কোনও নারী/পুরুষ/পুলিশ যেকোন সময়ে মামলা করতে অথবা যেকোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সারাবাংলা/এসএস
ইউটিউব ইন্সটাগ্রাম টুইটার নারী নির্যাতন নারীর প্রতি সহংসতা ভাইবার সাইবার ক্রাইম সামাজিক যোগাযোগ্মাধ্যম