রেডিও ও টেলিভিশনের নাম পাল্টে সম্প্রচার শুরু হয়
৪ মার্চ ২০১৯ ০১:১৪
।। সুমন ইসলাম ।।
৪ মার্চ, ১৯৭১। গণ বিক্ষোভে টালমাটাল দেশ। দিন যতই যাচ্ছিল এক দফার দাবি অর্থাৎ স্বাধীনতার আকাঙ্খার তীব্রতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ দিন সামরিক জান্তার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। আজ থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। বেতার-টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তারা অংশ নেবেন না।
মার্চ-৩: বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো: বঙ্গবন্ধু
এদিকে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারাবাংলায় সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন নিহত হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২১ জনে। ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, এ্যামবুলেন্স, চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের গাড়ি, পানি-বিদ্যুত-গ্যাস সরবরাহ, স্থানীয় টেলিফোন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় টেলিফোন যোগাযোগ, দমকল ও আবর্জনার গাড়ি হরতালের আওতা মুক্ত ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের টেলিফোন কর্মীরা পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রাঙ্কল বুক ও টেলিগ্রাম পাঠানো থেকে বিরত থাকেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাসী দেখুক, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বুলেটের মুখেও কী দুর্দান্ত সহাস ও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তিনি যে কোন মূল্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বেশ কিছু নির্দেশ জারী করেন। বঙ্গবন্ধু ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন দেয়ার জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
গতকাল বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থে শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।
এদিকে, করাচি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার দাবি জানান।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড. এ ভুট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তার দল যদ্দুর সম্ভব ৬-দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কী না- এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিকে, গভর্নরের বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কিছু প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। তার সেই প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বাঙালিরা কিভাবে মারা যাচ্ছে তার বর্ণনা দেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার দাবি মেনে নেয়ার কথা বলেন। এমন সময় সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত হয়ে বলেন, এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়। এরপর আর সেই আলোচনা এগোয়নি। অন্যদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা থেকে ইপিআর-এর বাংলাদেশি জওয়ানরা রাজপথে মিছিলকারীদের সঙ্গে একাত্ততা ঘোষণা করে জয়বাংলা স্লোগান দিতে থাকে। এবং পূর্বপাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ততা ঘোষণা করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
সারাবাংলা/এসবি
আরও পড়ুন:
মার্চ-২: ঢাবি ও সচিবালয়ে মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়ানো হয়
মার্চ-১: বাংলার জনগণ ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে: বঙ্গবন্ধু