টিক্কা খানকে গভর্নর নিয়োগ, সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ
৬ মার্চ ২০১৯ ০১:২৭
।। সুমন ইসলাম ।।
৬ মার্চ, ১৯৭১। সভা-সমাবেশ-মিছিলে সারাদেশ উত্তাল। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালন করতে গিয়ে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তারই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে আগে বেতন দেওয়া হয়নি, সেসব অফিস বেতন দিতে খোলা রাখা হয়। হরতাল চলাকালে সকাল ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। সে সময় পুলিশের গুলিতে সাত জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’— এসব স্লোগানে তখন মুখর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পল্টন ময়দান আর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্যও স্পষ্ট হচ্ছিল। সবার মনে আকাঙ্ক্ষা— কখন আসবে স্বাধীনতার ডাক। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন, তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সারাদেশ। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিও ছিল সেদিকেই। ওই ভাষণ ঠিক করতে আজ বঙ্গবন্ধু মিটিং করেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে।
বিকেলে বায়তুল মোকাররমের সামনে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সবাইকে মুক্তিসংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান মাওলানা ভাসানী। সাংস্কৃতিক কর্মীরাও রাজপথে মিছিল করেন। মিছিলে নায়ক রাজ্জাক, নায়িকা কবরী, পরিচালক জহির রায়হানসহ জনপ্রিয় ব্যক্তিরা অংশ নেন।
এর আগে, দুপুরে এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব।
তিনি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারণ করে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। এই উত্তপ্ত সময়ে নৃশংস বলে কুখ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর উদ্দেশ্য যে মিলিটারির বুটের নিচে পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনকে দাবিয়ে দেওয়া— এটা উপলব্ধি করতে পেরে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।
পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’
এদিকে, ইয়াহিয়া খানের ওই বেতার ভাষণের পর পরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।
ওই বেতার ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
চট্টগ্রামে আগের দিন বিহারি-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন হওয়ার পরও এদিন পাকিস্তানি আর্মির সহায়তায় বিহারিরা ও কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুট করে। এ সময় স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনা বিহারি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালিদের সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালে। রেলওয়ে কলোনি, হালিশহর, আগ্রবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারীর সংঘর্ষ হয়। আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গী বাজার, আসাদগঞ্জ, চকবাজারে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে বিহারি-জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।
লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখপ্রকাশ করেন।
সারাবাংলা/টিআর/আপ-এমও