‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’
৮ মার্চ ২০১৯ ১৭:৫৪
নারীর পদযাত্রা নানা বাধা আর প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। এরই মাঝে পথ তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। পুরুষের পাশাপাশি হাতে হাত মিলিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছেন, মেধা আর মনন কাজে লাগিয়ে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সারাবাংলা এমন দুইজন নারীর জীবনের গল্প শোনাতে চায়। তাদেরই একজন সার্জেন্ট পান্না আক্তার। তিনি রাজধানী ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। পান্না আক্তারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিথি চক্রবর্তী।
সার্জেন্ট পান্না আক্তারের জন্ম নেত্রকোণা জেলায় ১৯৮৭ সালে। তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে ২০১৫ সালের মে মাসে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকার কয়েকটি ইন্টারসেকশনের (যেখানে একের অধিক রাস্তা মিলিত হয়েছে) দায়িত্ব পালন করছেন।
সারাবাংলা: আপনার বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই।
পান্না: ছোটবেলা বাড়ির পাশেই একটি স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তবে কলেজ ছিল অনেক দূরে। সেই রাস্তাটি ছিল মাটির। এটা ২০০৪-০৬ সালের কথা বলছি। বেশিরভাগ সময় বাইসাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতাম। আবার কখনও কখনও বাদুরঝোলা হয়ে পাবলিক বাসেও যাতায়াত করেছি। আমি গ্রামের মেয়ে। আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন। গ্রামের মেয়ে হিসেবে আমার যে স্বভাব ছিল তাতে এই পেশা কখনই কঠিন মনে হয়নি। গ্রামের মেয়েরা অনেক পরিশ্রমী। কঠিন কাজগুলো তারা করতে পারেন।
তবে কিছু সমস্যাও হতো আমার। যেমন মেয়ে হয়ে সাইকেল চালিয়েছি বলে অনেকে ভালোভাবে নিতেন না। নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। আবার সাইকেলটিও ছিল ছেলেদের। আমি ভাইয়ের সাইকেল চালাতাম। মানুষের কথা শুনে আমি দমে যাইনি। সবসময় এটাই ভেবেছি, ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে সব জায়গায় যেতে পারেন তাহলে আমি পারবো না কেন?
সারাবাংলা: এই পেশার প্রতি ভালোলাগা জন্মেছে কীভাবে?
পান্না: আমি ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত স্বভাবের। যেসব কাজের জন্য বাইরে ছুটতে হয় সেগুলো করতে আমার ভাল লাগতো। তাছাড়া হিন্দি সিনেমার নারী পুলিশ অফিসারদের অভিনয় খুব ভাল লাগতো। তাদের দেখে মনে হতো, এমন পোশাক পরে আমিও যদি কাজ করতে পারতাম!
সারাবাংলা: পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন বাধা এসেছে কিনা?
পান্না: আমার বাবা ধার্মিক ছিলেন। এই পেশায় আসার ক্ষেত্রে তিনি দ্বিমত পোষণ করে বলতেন, মেয়েরা এই পেশায় কেন যাবে। তবে মা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন এবং আমার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সবসময় ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ কখনও বাধা দেয়নি। তাছাড়া মেধা দিয়েই আমি এই চাকরি পেয়েছি। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন মেয়ের পক্ষে এই চাকরি উপেক্ষা করার সাহস অর্থনৈতিকভাবে আমার ছিল না। তাছাড়া যেকোন কাজের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হলেই আমি সেই কাজ করতে পারি। এই আত্মবিশ্বাস আমার আছে।
এখন চাকরিতে অনেক প্রতিযোগিতা। সেক্ষেত্রে এই পেশায় সরকার আমাদের ভালো বেতন দিচ্ছেন। যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল, জ্বালানি খরচ, পোশাক, রেশন সবকিছুই সরকার দেন। সরকার জনগণের ট্যাক্স থেকে আমাকে টাকা দেন। তাই জনগণের সঠিক সেবা নিশ্চিত করাই আমার কাজ। এই কাজ ভালোভাবে করতে পারলে আমার ভাল লাগে।
সারাবাংলা: পরিবারের সহযোগিতা পান?
পান্না: আমার স্বামী সব কাজে আমাকে সহযোগিতা করেন। আমাদের এই পেশার নিয়ম হলো, চাকরি স্থায়ী হওয়ার দুই বছর পর বিয়ে করা যায়। আমিও তাই করেছি। প্রতিদিন কাজ শেষে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দুজনই ঘরের কাজগুলো সেরে ফেলি।
সারাবাংলা: কর্মক্ষেত্রে কোন সমস্যায় পড়েন কি?
পান্না: কর্মক্ষেত্রে টয়লেটের সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের। ট্রাফিক পুলিশদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। ফলে অন্য অফিস বা প্রতিষ্ঠানের টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। আর এই সমস্যার কারণে নারীদেরই বেশি ভোগান্তি হয়। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই বলে সারাদিনে ১ লিটারের বেশি পানি খেতে পারি না। অন্য টয়লেটে বারবার যেতে ইতস্তত বোধ করি।
নির্দিষ্ট টয়লেট না থাকায় পিরিয়ডের সময় কাজ করতে খুব অসুবিধা হয়। আমাদের ৮ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ৬ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ সমস্যা সমাধানের উপায় এখনও আমি জানি না। আসলে আমি একজন পান্নার কথা বলছি। একেকজন মেয়ের একেক ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। তবে প্রত্যেক মেয়ের সাধারণ সমস্যা হলো বাথরুম না থাকা।
তাছাড়া রাস্তায় কাজ করতে গেলেও কিছু সমস্যায় পড়ি। এই সমস্যাগুলো পুরুষ সহকর্মীদেরও হয়। তবে মেয়েদের ভোগান্তিটা একটু বেশি। কারণ আমাদের সমাজে কর্তৃত্ব করেন পুরুষ। তাই অনেক পুরুষ কর্তৃত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখতে চান ও নারীদের খাটো করে দেখেন। তবে আমাদের পুরুষ সহকর্মীরা খুব সহযোগিতা করেন।
সারাবাংলা: আপনার পেশা নিয়ে পরিচিত কিংবা আশেপাশের লোকজন কেমন মনোভাব পোষণ করেন?
পান্না: সবার দৃষ্টিভঙ্গি সমান নয়। অনেকেই এই পেশাকে ভালোভাবে নিয়েছেন। আবার অনেকে বলেন, ‘ওরা তো রাস্তায় কাজ করে’। রাস্তায় কাজ করাকে সম্মানের সাথে দেখার মানসিকতা অনেকের নেই। এতে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে এই ভেবে যে, তারা না বুঝেই এভাবে বলেন।
এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেই। গত বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে চার ঘন্টা একটি রাস্তা বন্ধ ছিল। আউটগোয়িংয়ে (ঢাকা থেকে বাইরে যায় যেসব গাড়ি) গাড়ি না যাওয়ার কারণে সর্বশেষ টেইল (সারিবদ্ধ গাড়ির শেষের অংশ) চলে গিয়েছিল গুলিস্তান পর্যন্ত। তাই চার ঘন্টা রাস্তা বন্ধ ছিল। সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি। রেইনকোট, গামবুট পড়ে আমরা রাস্তায় নেমে পড়ি। ঢাকায় চারটি ট্রাফিক বিভাগ আছে। প্রত্যেকটি বিভাগের প্রধান হলেন ডিসি। আমাদের উত্তর ট্রাফিক বিভাগের ডিসি স্যার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত প্রত্যেকেই আমরা সেদিন রাস্তায় নেমেছিলাম। তারপরও রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রাস্তার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। আমরা যদি রাস্তায় না থাকি তাহলে রাস্তার অবস্থা আরও কত খারাপ হবে- এটা যদি কেউ ভাবেন তাহলে আমার মনে হয় না, এই পেশাকে তারা ছোট করে দেখবেন।
সারাবাংলা: শুনেছি, আপনি প্রধানমন্ত্রীর প্যারেড পরিদর্শনকারী গাড়ি চালিয়েছেন। এই অনুভূতির কথা জানতে চাই।
পান্না: ২০১৭ সালে আমি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চালিয়েছি। আমাদের বছরে একবার ন্যাশনাল পুলিশ প্যারেড হয়। প্রধানমন্ত্রী যে গাড়িতে প্যারেড পরিদর্শন করেন সেই গাড়িতে চারজন থাকেন। প্রধানমন্ত্রী, আইজিপি, কমান্ডার এবং একজন ড্রাইভার। সেসময় ড্রাইভার হিসেবে আমি ছিলাম। এটি আমার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন।
প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সেই সাথে আমার কাঁধে হাত রেখে আইজিপি স্যারকে বলেছিলেন, ‘ও খুব ভাল গাড়ি চালায়।’ তখন আমি কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বলতে পেরেছিলাম ‘ধন্যবাদ স্যার’। ওই মুহূর্তটি মনে পড়লে আমার মধ্যে ফ্যান্টাসি কাজ করে। এই ঘটনা আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি।
সারাবাংলা: পেশাগত জীবনে পুরস্কার বা প্রাপ্তি কী?
পান্না: প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চালানোর কারণে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন) থেকে আমাকে ‘মেডেল অব কারেজ’ (Medal of courage) দেওয়া হয়েছিল ২০১৭ তে। তাছাড়া আমাদের আরও একটা ট্রেনিং হয়েছিল সদরঘাটের মিল ব্যারাকে। এই ট্রেনিংয়ে প্রথমবারের মতো নারী কনস্টেবলদের ট্রাফিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কনস্টেবল গাইড হিসেবে আমাদের কয়েকজন পুলিশকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। সেই ট্রেনিংয়ে আমি প্রথম হয়েছিলাম।
তখন নার্সিংয়ে আরেকটি ট্রেনিং হয়েছিল। তাতেও প্রথম হয়েছিলাম। এ কারণে আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। পরে আমার ডিসি স্যারও আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। এ রকম ছোটখাটো পুরস্কার কয়েক বছরে আমার অনেকগুলো জমা হয়েছে।
সারাবাংলা: কখনও হতাশা আসে কি?
পান্না: আমি এই চাকরি পেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি, আল্লাহ আমাকে রুটি-রুজির একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে মাঝে মাঝে হতাশাও আসে। অনেকসময় রাস্তায় মানুষের সাথে বাক-বিতন্ডা হয়। কারণ মামলা দিলে কেউ খুশি হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অনেকে মামলা দিলেও চুপচাপ থাকেন। আবার অনেকে এমন কথা বলেন যেগুলো শোনার পর কিছু করার থাকে না।
পুরুষ সার্জেন্টদের সাথেও অনেকে খারাপ ব্যবহার করেন। তবে মানুষ পুরুষ সার্জেন্টদের ভয় পায় বেশি। পুরুষের তুলনায় নারী সার্জেন্টের সাথে বেশি কথা বলেন। কারণ অনেকেই নারীদের দুর্বল ভাবেন।
সারাবাংলা: পুরুষ সহকর্মীরা কেমন আচরণ করেন?
পান্না: পুরুষ সহকর্মীদের খারাপ আচরণের শিকার তেমন হইনি। তবে কখনও কখনও পুরুষ সহকর্মীদের একথা বলতে শুনেছি যে, ‘উনি তো মেয়ে। এই ইন্টার-সেকশনের (এলাকা) দায়িত্ব নিতে পারবেন না’। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমি বলেছি, আমাকে আগে দায়িত্ব দেওয়া হোক। দায়িত্ব দেওয়ার আগেই ‘আমি পারবো না’ বলে তারা মন্তব্য করবেন কেন? এভাবে বলার পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি ভালোভাবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। যার জন্য আমার জোনাল অফিসারদের প্রশংসা পেয়েছি। তারা আমার উপর আস্থা পেয়েছেন। শুরুতে আমার সম্পর্কে যারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন, নারী হওয়ার কারণে খাটো করে দেখেছেন, পরে তারা আর কোন কথা বলতে পারেননি।
সারাবাংলা: এখন যে মেয়েরা চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলেন।
পান্না: আমার এই পেশাকে যথেষ্ট নিরাপদ মনে হয়। আমি শুনেছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে মেয়েরা শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। এই কথাগুলো মেয়েরা কাউকে বলতে পারেন না। এই পেশা মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাছাড়া যাতায়াতের জন্য আমাকে মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছে। তাই যাতায়াতেও কোন অসুবিধা হয় না। আমি চাই, মেয়েরা এই পেশায় আরও আসুক। একটু পরিশ্রম করতে পারলেই যথেষ্ট ভালো লাগার মতো একটি পেশা বলে আমি মনে করি।
সারাবাংলা/টিসি/ এসএস