ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কোথাও নিয়ন্ত্রণ নেই পাকিস্তানি জান্তার
৯ মার্চ ২০১৯ ০৭:৩৪
।। সুমন ইসলাম ।।
মিছিলে মিছিলে উত্তাল সারাদেশ, ৯ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে দেশ চলছে তারই নির্দেশনা অনুযায়ী। শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু প্রযোজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। চরমে পৌঁছেছে দেশব্যপী অসহযোগ আন্দোলন।
ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। লা-কুম দ্বীনুকুম অয়ালিয়া দ্বীন’র মতো অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই, যখন প্রধান দুই নেতা একসঙ্গে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যমত প্রকাশ করেন তখন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সেদিন জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে মাওলানা ভাসানী বলেন, মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো। তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। আপামর জনসাধারণের দুই নেতা যখন এইভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেন, তখন ঘরে ঘরে মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখতে থাকে।
এদিকে, ঢাকা শহর পরিণত মিছিলের নগরীতে। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সারাদেশে যুবকরা হতে থাকে ঐক্যবদ্ধ। চলে বিভিন্ন স্থানে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। বাংলাদেশের যুবকদের রক্তে তখন একই নেশা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী, সচিবালয়-সহ সারাদেশে সব সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলাকোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেসব অফিস চালু থাকে।
লে. জেনারেল টিক্কা খানের আজ গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল চলাকালে ঢাকা হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকায় জাতিসংঘের উপ আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ এর ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি করে। রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সারাবাংলা/এটি