‘বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি প্রশ্নে কোনো আপস নয়’
১০ মার্চ ২০১৯ ০৫:৫২
।। সুমন ইসলাম ।।
সারাদেশে বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে টানানো হয় কালো পতাকা। এমনকি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মচারীরা ১০ম দিনের মতো কাজে যোগদানে বিরত থাকে। তবে বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসা কেন্দ্র খোলা ছিল। ঘরে ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। সরকারি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই সব চলতে থাকে। দিনটি ছিলো ১০ মার্চ, ১৯৭১।
সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, সাতকোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোনো মূল্যে তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চাই।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। এ ব্যাপারে আমরা কোনো আপস করতে রাজি নই। গত ২৩ বছর ধরে শাসক শ্রেণি বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বাঙালিরা আজ সেই শাসনের অবসান চায়। বাংলাদেশের মানুষ আজ অমানুষিক ও দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে।
সকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মীসভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতাদের স্বাক্ষরিত স্বাধীন- বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন বক্তৃতা করেন।
এদিকে, সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালাবার সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ২৭ জন আহত হয়। রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা আট ঘণ্টার নৈশ কারফিউ প্রত্যাহার করে।
বিকেলে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীনবাংলার দাবিতে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। ‘লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের নামে আমি যে নির্দেশ দিয়েছি সচিবালয়সহ সরকারি ও আধাসরকারি অফিস আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরগুলোতে তা পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তার বিবৃতিতে আরও বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসা-পরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশর জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চত্রান্তে লিপ্ত। সামরিক সজ্জা অব্যাহত রেখে বাংলার বুকে এক জরুরি অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী।
নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্ররা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে মহাসচিব উ-থান্টের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।
করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকায় আসবেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায় সে জন্য আগে আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে। করাচিতে ওয়ালী ন্যাপের পশ্চিম পাকিন্তান শাখার মহাসচিব মীর গাউস বখস বেজেঞ্জো এক বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে কেবল বাংলাদেশের নয় বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।
সারাবাংলা/এটি