প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’
১২ মার্চ ২০১৯ ০৮:১৭
।। সুমন ইসলাম ।।
১২ মার্চ, ১৯৭১। প্রতিবাদ প্রতিরোধ বিক্ষোভে ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’ ঘুম ভেঙে জেগে উঠে। শেকল ছেঁড়ার অদম্য আকাঙ্খায় দুরন্ত দুর্বার হয়ে উঠে বীর বাঙালি জাতি। অন্যদিকে ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকাণ্ড। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই পূর্ববাংলায় থাকা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা দমে যেতে থাকে। পেশাজীবীরা পথে নেমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ নেয়।
পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। তারা আন্দোলনে অর্থের জোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দেন। রাস্তায় নেমে আসেন শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কর্মজীবী সবাই। স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে রাখেন ঢাকার রাজপথ। পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনকে জোরদার করতে, আরও সংঘবদ্ধ করতে রাজপথে নেমে আসে।
পাকিস্তানবিরোধী স্লোগানে রাজপথকে উত্তাল করে তোলে জনতা। শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে।
চির পরিচিত শাপলাকে জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভাতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে তারা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সরকারি আধাসরকারি কর্মচারিদের কর্মস্থল বর্জন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা, সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকা-সহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব বর্জন করেন। বগুড়া জেলখানা ভেঙ্গে ২৭ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদী নিহত ও ১৫ জন আহত হয়।
ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমি জানি শেখ মুজিবুর রহমান কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখুন।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘোষণায় ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। লাহোরে এক সংবাদক সম্মেলনে গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দোষ করা হল লাহোরে কিন্তু বুলেট বর্ষিত হল ঢাকায়। তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণ সমান অধিকার নিয়ে থাকতে চায়, পশ্চিমাঞ্চলের দাস হিসেবে নয়। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে। আর তা হচ্ছে শেখ মুজিবর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
লাহোরে ন্যাপের মহাসচিব সি.আর. আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমলারাই দায়ী। ভূট্টোও এ ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ভূট্টোর হুমকিপূর্ণ মনোভাব ও ক্ষমতার লিপ্সাই রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।
প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য পাঠানো খাদ্য বোঝাই মার্কিন জাহাজের গতি বদলে করাচি পাঠানো ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা প্রকাশ করেন।
সারাবাংলা/এমও