সাহিত্যচর্চার সুযোগ নারীরা কতটুকু পাচ্ছেন?
৭ এপ্রিল ২০১৯ ১৬:২৭
‘নারীরা যখন সাহিত্যচর্চা করেন, তখন তার কিছু অর্থ ও নিজের জন্য একটি কক্ষ থাকা খুব প্রয়োজন’। বৃটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ তার বিখ্যাত বই ‘এ রুম অব ওয়ান‘স অওন’ বা ‘নিজের একটি কামরা’ (আলম খোরশেদ অনূদিত বইয়ে) একথা লিখেছিলেন।
সাহিত্য রচনায় কেন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভার্জিনিয়া উলফ দেখিয়েছেন নারীর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কথা। সেই সঙ্গে অনেকের নিজের একটি ঘরও নেই। সৃজনশীলতার জন্য যা খুব প্রয়োজন বলে তিনি উপলব্ধি করেন।
ভার্জিনিয়া উলফ বলেন, যদি নিজের একটি ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারতেন। জেন অস্টেন, জর্জ ইলিয়ট, মেরি কারমাইকেলের মতো লেখিকাদের অত্যন্ত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেক্সপিয়ারের স্তরে উন্নীত হতে পারছেন না পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা অসঙ্গতির কারণে। এর মধ্যে বড় হলো আর্থিক সমস্যা। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর।
ভার্জিনিয়া উলফ এই সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে যান- ‘নারীকে নিচে ফেলে রাখলে পুরুষরা বড় হবে কী করে? আর পুরুষরা এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কী করে?’
মানবসভ্যতার এই যুগে নারীরা অনেক দিক থেকে এগিয়ে গেছেন। এদেশে এমন কোন পেশা নেই যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। অনেক জায়গায় পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সাহিত্যে নারীর পদচারণা কতটুকু?
অনেক নারী জীবনের কিছু সময় লেখালেখি করলেও পরে তা ধরে রাখতে পারেন না। কিংবা অন্যান্য কাজের ফাঁকে লেখালেখির সঙ্গে কিছুটা যুক্ত থাকেন। যার কারণে সাহিত্যে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা নারীদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
অনেক নারী ভালো লিখতে জানেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকে জীবনের সাধনা হিসেবে নিতে পারেন না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সাংসারিক দায়িত্ব, সন্তান দেখাশোনার দায়িত্ব- এই বিষয়গুলোই মূলত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। প্রশ্ন তোলা হয় নারীর সাহিত্য মান নিয়ে। কিন্তু পুরুষের মতো সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যদি নারীরাও বড় হতেন, তাহলে বেগম রোকেয়া, সিমন দ্যা বুভ্যেয়ার, মহাশ্বেতা দেবীর মতো আরও অনেক নারী লেখক তৈরি হতো এই সমাজে।
কবি রুবি রহমান এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারী লেখালেখি করতে চাইলে অনেক প্রতিবন্ধকতা আসে। সাহিত্যচর্চা শুরু করলেই অর্থনীতির সংকুলান হয় না। অর্থাৎ সাহিত্য ঠিক সঙ্গে সঙ্গে অর্থের যোগান দিতে পারে না। আবার অর্থ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সবার জন্যই কঠিন। তবে মেয়েদের জন্য আরও কঠিন। কারণ নারীকে সহযোগিতা করার মতো মানসিকতা সবার থাকে না। এছাড়া পারিবারিক ব্যাপারগুলোতেও নারীকেই বেশি ভূমিকা পালন করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মায়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তার সন্তানের। একজন মা সব দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেও সন্তানের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সন্তানের সমস্ত ব্যাপারের সাথে মাকেই যুক্ত থাকতে হয় বেশি। যেমন আমার সন্তানের কোন সমস্যা হলে সেটাকেই বড় সমস্যা মনে করতাম আমি।’
তবে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বলেন, ‘লেখালেখি করতে গিয়ে নারীর প্রতিবন্ধকতা সবসময়ই ছিল, এখনো কিছুটা আছে। তবে এক্ষেত্রে নারীকেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। পারিবারিক ব্যস্ততা থাকবেই। তার মধ্যেই নিজের জন্য সময় করে নিতে হবে। আমি ৫৪ বছর ধরে লেখালেখির জায়গাটি ধরে রেখেছি। আমাকেও বাচ্চা লালনপালন ও সংসারের অন্যান্য ব্যাপার দেখতে হয়েছে। তবে এসব কাজে অনেক সময় চলে যায়, এটা সত্যি। লেখালেখির কাজে তখন কম সময় পাওয়া যায়। কিন্তু এর মধ্যেও সময় বের করে নিতে হয়।’
শুধু লেখালেখি না, অন্যান্য সৃজনশীল কাজেও অনেকসময় নারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়। একারণে অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞান ও গণিতে ছেলেরা এগিয়ে। অনেক অভিভাবক তার ছেলেকে বিজ্ঞান বিভাগে আর মেয়েকে কলা ও মানবিক বিভাগে পড়ান। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া ছেলেদের পক্ষে যতটা সহজ মেয়েদের ক্ষেত্রে তা নয়। হাতেগোনা যে কয়জন যেতে পারেন, তাদেরও অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করেই যেতে হয়।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কবি রুবি রহমান বলেন, ‘একসময় বাংলা সাহিত্য পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে মাস্টার্স কোর্সে। তখন মাস্টার্স ছিল দুই বছরের। ছেলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। বাসায় ছেলেকে আমি পড়াতাম। তাই প্রথম বছর শেষ করার পর আর পড়তে পারিনি। কারণ আমি লক্ষ করেছিলাম, আমি পড়াশুনায় মনোযোগ দিলে বাচ্চাকে পড়াতে পারতাম না। বাচ্চার রেজাল্ট খারাপ হলো। তখন আমারও মন খুব খারাপ হয়ে গেল। পরে পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দিলাম।’
বাংলাদেশে নারী সাহিত্যিক কম কেন জানতে চাইলে কবি রুবি রহমান বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে নারী সাহিত্যিকের উপস্থিতি অনেক কম। হাতেগোনা কয়েকজন নারী লেখক আছেন। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর কাজ অনেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। তাই নারী লেখালেখি করলেও এটাকে কোন ‘কাজ’ মনে করা হয় না। নারী যখন লিখতে বসেন তখন পরিবারের সদস্য, এমনকি গৃহপরিচারিকাও নানাভাবে কাজের বিঘ্ন ঘটায়। তখন মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। কারণ অফিসে যাওয়াকেই সবাই কাজ মনে করেন, ঘরে বসে লেখালেখি করাকে কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। তাছাড়া লেখালেখি করে অর্থ আসে না, একারণে অনেকেই লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে কিংবা এটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে অন্য চাকরি করেন। ফলে চাকরির ফাঁকে লেখালেখি করলে লেখার মান ভালো হয় না।’
তাছাড়া নারী লেখকদের বই প্রকাশ করতেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। নানা ধরনের আজেবাজে কথার বেড়াজালে নারীর প্রতিভা আবদ্ধ রাখা হয়।
এই প্রসঙ্গে রুবি রহমান বলেন, ‘আগে একটি কথা প্রায়ই শোনা যেতো। লেখক যদি ভালো কিছু লিখতেন তাহলে লোকে বলতো, স্বামী লিখে দিয়েছে। কোন নারী লেখকের স্বামীও যদি লেখক হন, তাহলে এই কথাটি আরও বেশি শোনা যেতো।’
তবে সেলিনা হোসেন বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘আগে নারী লেখকদের বই প্রকাশ করতে সমস্যা হতো। তবে এখন তেমন হয় না। আসলে কিছু মানুষ আছেন যারা সবক্ষেত্রেই অপরকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে পছন্দ করেন।’
নারীরা এগিয়ে যাবেন কীভাবে?
সাহিত্যচর্চায় নারীরা এগিয়ে যাবেন কীভাবে জানতে চাইলে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমার কাছে একজন বিস্ময়কর লেখক। তার লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হই। তিনি দারিদ্র্য ও নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে লেখালেখি করেছেন। আমি মনে করি, লেখালেখি করা সাধারণ কোন কাজ না। এটা একটা সাধনা।’ তিনি বলেন, ‘এখন অনেক পুরুষ তার স্ত্রীকে সহযোগিতা করেন। তবে যে মেয়েরা তার স্বামীর কাছে সহযোগিতা পান না, তাদের জন্য ব্যাপারটা একটু কঠিন। কিন্তু অসম্ভব না।’
মানসম্মত লেখা না পেলে পাঠকের কাছে সেই লেখকের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না বলে মনে করেন সেলিনা হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। তখন ঢাকায় বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখা পাঠাতাম। কোন লেখা যদি প্রকাশ করা না হতো তাহলে কখনও প্রকাশক বা সম্পাদকদের দোষ দেইনি। ভেবেছি, আমার লেখার মান হয়তো ভালো হয়নি তাই লেখাটা ছাপেনি। এরপর আরও দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে আরেকটি লেখা পাঠিয়েছি। এখন আমি দেখি, লেখকরা শুধুমাত্র প্রকাশক বা সম্পাদকদের দোষ খোঁজেন। নিজের লেখার মান কেমন তা বিবেচনা করেন না। আমি মনে করি, নিজের সীমাবদ্ধতা আগে দেখা দরকার। ভালো লিখতে না পারলে সেটা একসময় ডাস্টবিনে যাবেই। একটি বা দুটি বই প্রকাশ করলেই কেউ ভালো লেখক হতে পারেন না। এটা আজীবনের সংগ্রাম।’
সেলিনা হোসেন নারী লেখকদের সবসময় উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মেয়েদের লেখালেখিতে সবসময় উৎসাহ দেই। মেয়েদের সবসময় নিজের ভেতরের শক্তিকে পরিচর্চা করতে হবে। নিজের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। জীবনের সবজায়গায় সমস্যা থাকে। সমস্যাকে ভয় পেলে চলবে না। সমস্যা জয় করে নিতে হবে।
কবি রুবি রহমান বলেন, ‘সমাজের অন্যান্য পেশার মতো লেখালেখিতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। বর্তমান সরকার নানাদিকে নারীদের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি।’
তিনি বলেন, ‘৬০ এর দশকে অল্প কিছু নারী লেখালেখি করতেন। এখন আরও কিছু নারী এ পথে আসছেন। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি না। আমি মনে করি, লেখকের নিষ্ঠার কাছে অন্যান্য কাজ প্রধান হবে না কখনো। তবে জীবনের মোহ থেকে একেবারেই কেউ মুক্ত হতে পারেন না। পারিবারিক, সামাজিক দায়িত্ব সবার থাকে। তারপরও নিজেকে সাধনার মধ্যে নিয়োজিত রাখতে হয়। একাগ্রতা অনেক বড় একটি বিষয়। কাজে একাগ্র হলে অনেক সমস্যা জয় করা যায়।’
সারাবাংলা/টিসি/এসএস