Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে জলপথে ভারত যাত্রা


১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৩৫

দিনটি ছিলো ২৬ শে মার্চ। অ্যাসাইনমেন্টসহ বেশ ব্যস্ত সময় পার করলাম, সেদিন আবার আমার জন্মদিনও। মোবাইল ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল। সন্ধ্যার পর অন করতেই অনেকগুলো নোটিফিকেশনের টক টক শব্দ।

দেখলাম আমাদের সচিবালয় বিটের সভাপতি শ্যামল দা জানতে চাইছেন যে লিখেছেন কার কার ইন্ডিয়ার ভিসা আছে।

আমি বললাম, আছে, কিন্তু কেনো? তখন শ্যামল দা বললেন বাংলাদেশ থেকে জাহাজ যাবে ভারতে। সেখানে সচিবালয় বিট করেন এমন দুজন সাংবাদিক যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

ভিসা আছে জানানোর পর দাদা বললেন তুমি দীনকে (সচিবালয় বিটের সাংবাদিক নেতা) বলো। দীন ভাই বললেন, ‘আপনি কাল বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের কাছে পাসপোর্ট দিয়ে আসেন।’

এরই মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পিআরও জাহাঙ্গীর ভাইও ফোন করে বললেন পাসপোর্ট দিয়ে আসছি কি-না? যথারীতি দিয়েও এলাম। আর এভাবেই যুক্ত হয়ে গেলাম দারুণ আর স্মরণীয় এক ভ্রমণের সঙ্গে।

ভ্রমণ সম্পর্কে বলার আগে বলে নিই কিছুটা ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নদীপথে যাত্রী চলাচল বন্ধ হয়ে যায় । তবে পণ্য আনা নেওয়া বন্ধ ছিল না। আবার যাত্রী পরিবহনের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়। দুদেশের সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গত ২৯ মার্চ বাংলাদেশ থেকে একটি যাত্রীবাহী জাহাজ ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর নারায়ণগঞ্জের পাগলা জেটিঘাট বা মেরি এন্ডারসন ঘাট থেকে কলকাতার পথে যাত্রা করে লাল সবুজ পতাকাবাহী জাহাজ এমভি মধুমতি। কর্মীসহ জাহাজের মোট যাত্রীসংখ্যা ১৬০ জন। এর মধ্যে পর্যটক ছিলেন ১০৭ জন।

প্রায় ৭০ বছর পর ঢাকা-কলকাতার মধ্যে আবার নতুন করে যাত্রীবাহী জাহাজের চলাচল শুরু হওয়ায় যাত্রীদের মধ্যেও ছিল দারুণ উদ্দীপনা।

বিজ্ঞাপন

জাহাজ ছাড়ার আগে আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে মেরি এন্ডারসন ঘাটের আকাশ। জাহাজ ছেড়ে যাওয়া উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আপনি যাচ্ছেন আমি গতকাল জেনেছি, জার্নি কেমন হয় জানাবেন।

ঘাটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যাত্রা শুরু করলো এমভি মধুমতি। ডেকের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম, এরকম যাত্রা এটাই আমার প্রথম। ভেতরে কাজ করছে অন্য এক অনুভুতি! এমন সময় পেছন থেকে বাদল দা ডেকে উঠলেন, আমাকে নাকি গোটা জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসেছেন।

বাদল দা’কে পরিচয় করিয়ে দিই। পুরো নাম সুভাষ চন্দ্র বাদল, দীর্ঘ দিন বার্তা সংস্থা বাসসে কাজ করেছেন, সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দিল্লি প্রতিনিধি হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন। আমার একজন অভিভাবক, শ্রদ্ধেয় দাদা। আমার সব ভালো-মন্দ সব কিছুর সঙ্গে পাই।

আরও একজন শ্রদ্ধেয় দাদা আছেন এই জার্নিতে তিনি সবার প্রিয় পরোপোকারী সুভাষ চন্দ্র সিংহ আমাদের সুভাষ দা । উনাকে চেনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না । তার সঙ্গে আছেন তার সহধর্মিনী মমতা হেনা লাভলী (এমপি)। আসলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করছিলাম তার মমতার সাগর যার কোন সীমারেখা নেই । সঙ্গে ছিলেন বিদ্যুৎ বাসু তিনিও অসাধারণ মানুষ। এর মধ্যে পরিচয় হলো অলোক দা’র সঙ্গে উনাকে আমি চিনি অনেক আগে থেকে দেশ টিভির বার্তা বিভাগের দায়িত্বে আছেন । কিন্তু আমার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি। আছেন বৌদি আমি তাকে থাই প্রিন্সেস বলে ডাকতাম। সত্যি তার সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। এরমধ্যে ট্রাভেল শো করেন শিশির দা মজার ব্যাপার দেখে আমার বাড়ি ফুলতলা আর তার বাড়ি নওয়াপাড়া। আর একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হলো সাতক্ষীরা বাড়ি। এছাড়া অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। একটু দেরিতে রাতের খাবার সেরে সাবাই ঘুমাতে গেলাম।

বিজ্ঞাপন

পরদিন ঘুম ভাঙল অজানা শব্দে, পরে বুঝলাম এটা পানি আর জাহাজের শব্দ। সকালে নাস্তা করে অপেক্ষা করছিলাম মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর। সেখানে ঘাটে ভিড়বে জাহাজ।

কিছুদূর যাওয়ার পর দুর থেকে মোংলা বন্দর দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। লেন্স জুম করে ভিডিও করছিলেন কেউ কেউ। জাহাজ ভিড়ল রামপালের পর একটি বাজারে। অনেকেই নামলাম, প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পেলাম ঘোরার জন্য। এরই মধ্যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। খাবার শেষ করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম সুন্দরবনে প্রবেশের। এরইমধ্যে ফোন করলেন নৌ প্রতিমন্ত্রী। জানতে চাইলেন ভ্রমণ সম্পর্কে। বুঝলাম কতটা আন্তরিক তিনি এই ভ্রমণ বিষয়ে।

এর মধ্যে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় মমতা আপা ডাকছেন সুন্দরবন এসে গেছে। দ্রুত উঠে পড়লাম ডেকের সামনে গেলাম দূর থেকে সুন্দরবন দেখা যাচ্ছে! আমার জীবনে প্রথম আমি সুন্দরবন দেখছি!

সবুজ গাছে চোখ আটকে গেল। আমি খুলনার মেয়ে অথচ জীবনের অতগুলো বছর পার করে এই প্রথম সুন্দরবন দেখছি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। যতই জাহাজে এগিয়ে যাচ্ছে ততই মুগ্ধ হচ্ছি। সে যেন এক জাদুর জগৎ।

প্রায় চার ঘণ্টা সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জাহাজ চলেছে, আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে নির্মল বাতাস গায়ে মেখেছি। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে। মনে হয় স্বচ্ছ জলে সূর্যের আলো যেন সোনা ছড়াচ্ছে। মনে পড়ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম তিনি লিখেছেন, ‘নৌকার সামনে বসে পানির ঢেউ খেলানো যেন আবাসউদ্দিনের গান হয়ে যাচ্ছে।’

একসময় রাত হয়, আমরা পৌঁছি আংটিহারাতে। সেখানে মাঝ নদীতে জাহাজ নোঙর করে। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের ইমিগ্রেশন করতে কাস্টমস, এসবি অফিসাররা ট্রলারে করে জাহাজে হাজির। তাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে রাতের খাবারের পালা। সকাল হলে আবারো জাহাজের ছুটে চলা।

ভারতের সীমানায় ঢুকতেই দুটি জাহাজ প্রটোকল দিয়ে নিয়ে যায় আমাদের। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে নির্দিষ্ট গতির ওপরে জাহাজ চালানো যাবে না, হর্ন দেওয়া যাবে। এসব মেনেই চলেছে আমাদের এমভি মধুমতি। অথচ বাংলাদেশ অংশে এমন কোনো নিয়ম দেখিনি। বন রক্ষায় ভারতের কর্মকাণ্ড সত্যিই প্রশংসনীয়।

তবে ভারতের সুন্দরবন আর আমাদের সুন্দরবনের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের অংশে বড় গাছ আর ঘন সবুজ। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম আমরা বুঝি না! কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা পাই ভারত থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া জাহাজ আরভি গঙ্গাকে। সেটির যাত্রীরা হাত নেড়ে আমাদের অভিবাদন জানালেন, আমরাও উত্তর দিলাম।

এবার ভারতীয় অংশে ইমিগ্রেশনের পালা। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়েছে। সামনে দুটো জাহাজ আমাদের জাহাজটিকে প্রটোকল দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু আমাদের আর তর সইছে না, তিনদিন পেরিয়ে গেছে, কখন পৌঁছবো গন্তব্যে সেই চিন্তাই কেবল করছি।

রাতের খাবার শেষে অলোক দা আর বিদ্যুৎ দা বললেন আজ গান হবে সারারাত। সুভাষ দা আর মমতা আপাও সায় দিলেন।

এরপর শুরু হলো গান শোনা ডাইনিংয়ে বসে। শিল্পি ইমতিয়াজ ভাই একের পর এক অনুরোধের গান শুনিয়ে যাচ্ছেন বিরতিহীন। শেষ পর্যন্ত গান শেষ করে ভোরে ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠেই তড়িঘড়ি করে নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে সবাই ডেকের সামনে দাঁড়ালাম, আমরা খিদিরপুর পৌঁছেছি। এখন নামার পালা।

বাংলাদেশ হাই কমিশন ও ভারতের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন আমাদের বরণ করে নিতে। আমরা জাহাজ থেকে নেমে ভারতের মাটিতে পা রাখার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হলাম।

এই যাত্রার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক যেমন আরও গভীর হবে, তেমনি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে ভারত ও বাংলাদেশ। বিকাশ ঘটবে পর্যটন খাতেরও।

যারা নগর জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা ঘুরে আসতে পারেন এমন ভ্রমণে। নদীর বাতাসে চাঙ্গা হবে শরীর-মন দুটোই।

সারাবাংলা/এসএমএন/এমআই

ভারত যাত্রা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

চট্টগ্রামে খালে ভাসছিল অর্ধগলিত লাশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৩

বিএসইসি‘র চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫১

বাড়তে পারে তাপমাত্রা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৪

সম্পর্কিত খবর