শহীদ মো. আবু বকর: ১৮ বছর বয়সী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা
৫ মে ২০১৯ ০৮:৩১
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জুন মাসের শুরুতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধাদের গ্রেনেড হামলার পরে পুরোপুরি সতর্ক হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। কড়া পাহারা আর সর্বোচ্চ নজরদারিতে দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তারা সেখানে। এমন অবস্থায় সেখানে আবারও টাইম বোমা নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করাও ছিল দু:সাহসের কাজ। সেই দু:সাহস তখন দেখিয়েছিল এক বঙ্গ শার্দূল।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে সেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৯৭১ সালের আগস্টের ১১ তারিখ যে বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইম বোমা নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন তার নাম আবু বকর। আজ ৫ মে তার জন্মদিন।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট আলবদর বাহিনী তথ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কাছে ধরা ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু বকরের সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা খুবই কম। সেই জানার চেষ্টা থেকে ক্লাব অবসকিওরের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে রাশেদ রনি যোগাযোগ করেন শহীদ আবু বকরের বড় ভাই মোহাম্মদ আবু মোজাফফর, ছোট দুই ভাই মোহাম্মদ আবু হায়দার এবং মোহাম্মদ আবু আবরারের সঙ্গে। সেখানেই উঠে আসে শহীদ আবু বকরের জীবনের নানা ঘটনা এবং তার একাত্তরের বীরত্ব গাথা। আর সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা এই লেখাতে।
শহীদ আবু বকরের বাবা আবু জাফর এবং মা আনোয়ারা খাতুন ছিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। শহীদ বকর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালের ৫ই মে, সৈয়দপুরে। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান। বাবা আবু জাফর পেশায় সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন। চাকুরীর সুবাদে তিনি মুর্শিদাবাদ ছেড়ে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সৈয়দপুর উপজেলায় চলেন আসেন (বর্তমানে সৈয়দপুর নীলফামারী জেলার অন্তর্ভুক্ত), সেখানেই জায়গা-জমি কিনে স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ।
১৯৬৯ সালে বাবা আবু জাফর সৈয়দপুরে বাড়ি-জায়গা-জমি বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । এই চলে আসার সিদ্ধান্তের পেছনে মূল ভূমিকা ছিলো বকরের মা – আনোয়ারা খাতুনের, তিনিই আবু জাফর সাহেবকে ছেলে-মেয়েদের ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করানোর জন্যে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে রাজী করান। বকরের মামারা আগে থেকেই ঢাকায় স্থায়ী হয়েছিলো, তাদের সহযোগিতায় আবু জাফর সাহেব সৈয়দপুরে বাড়ি-জমি বিক্রিকৃত অর্থ দিয়ে ঢাকার গুলশান-২ এর ৯৬ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর প্লটটি কিনতে সমর্থ হোন, এবং তিনি তিন রুম বিশিষ্ট একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ী হন।
(শহীদ বকর এর জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান – এই দুটি তথ্য এতদিন পর্যন্ত অজানাই ছিলো, সম্প্রতি নেয়া সাক্ষাতকারে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে, উইকিপিডিয়াতে শহীদ বকর এর জন্ম ঢাকার গুলশানে লেখা আছে, তথ্যটি ভুল।)
শিক্ষাজীবনে মেধাবী শহীদ বকরের কয়েকটি গুণ ভীষণ প্রখর ছিলো। খুব মিশুক প্রকৃতির কারণে মানুষের সাথে খুব সহজেই সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন, অন্যকে কনভিন্স করার ক্ষমতা আর সেন্স অব হিউমার ছিলো দুর্দান্ত । ছোটদের সাথে দুষ্টামি স্বার্থে লেগপুলিংটাও খুব আগ্রহ নিয়ে করতো বকর। এছাড়ার অন্য একটি বিশেষ গুণ ছিলো তাঁর- কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মনোমুগ্ধকর বাঁশী বাজাতে পারতো, কোন গান শুনে ক্ষণিকেই তা বাঁশিতে তুলে ফেলার অপূর্ব গুণটির কথা ছোট ভাই হায়দার বেশ গর্ব করে বলে যান ।
২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী মিলিটারি কর্তৃক নিরীহ বাঙালীর উপর সংগঠিত ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা গণহত্যার ঘটনার পর সবকিছু পাল্টে যায় । ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর বকর তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে দেখে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের নির্মম নিদর্শন । সেই থেকে ১৮ বছর বয়সী বকর ভেতরে ভেতরে পুড়ছিল, একটি কথাই তাঁর মন থেকে উঠে আসছিলো – এভাবে বেঁচে থাকা যায় না।
মে মাসের শেষ দিকে বকর মনঃস্থির করে যে- তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। ছোট ভাই মোহাম্মদ আবু হায়দার, কর্নেল রেজার ছেলে তালাহ রেজা সহ বকর সিদ্ধান্ত নেন প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে দুই পিঠাপিঠি ভাই মায়ের অনুমতি চাইতে গেলে অনেক বোঝানোর পর অনুমতি মেলে শুধু বকরের, ছোট ভাই হায়দারকে থেকে যেতে হয়। হায়দারকে ছেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল, বকরের বড় ভাই ডাক্তারি পেশায় তখন সৌদি-আরবে কর্মরত, মেজভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এপ্রিলের শেষ দিকেই ভারত চলে যায়, (পরবর্তীতে জানা যায়- মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেবার জন্যে সীমান্ত পাড়ি দিলেও, সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে সেইসময় অনেকেই চলে এসেছিল, সবাইকে রিক্রুট করার মতো সামর্থ্য তখন ছিলো না, বকরের মেজভাইকে তাই নিরাশ হতে হয়, অত:পর তিনি ‘জয় বাংলা’ পাসপোর্ট নিয়ে মুর্শিদাবাদে খালাদের কাছে চলে যায়, যুদ্ধকালীন পুরো সময় সেখানেই থাকেন)।
সঙ্গত কারণেই বড় দুই ভাইয়ের অনুপস্থিতি কারণ এবং বয়স্ক বাবা-মা, বড় দুই বোন সহ ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্বটা বকর চলে গেলে হায়দারের উপরেই পড়ে । বকর ও তালাহ রেজা মেলাঘরের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বের হলেও পথিমধ্যে দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । বকর মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাইয়ের শুরুতে ঢাকায় ফেরে ।
ছোট ভাই হায়দার সেই ফিরে আসার দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন–
‘মাসখানেক পর হঠাৎ একদিন দেখি বাড়ীর পেছনের দিকের দেয়াল টপকে ১৫-১৬ বছরের গ্রামের একটি ছেলেকে নিয়ে বকর ভাই আসলেন । এসেই মাকে বললেন- ক্ষিদা লাগছে, গোসল করি, ভাত খেতে দাও । খেয়ে দেয়ে টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ওঁরা টানা ঘুমিয়েছিল । সেইবার সঙ্গে নিয়ে আসে স্ট্যানগান আর গ্রেনেড। যাত্রাবাড়ী উলানের ৩২কেভি লাইন উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো ওরা, উলান হাইএক্সটেনশন লাইন উড়াতে গিয়ে দেখেন যে এন্টিপার্সোনাল মাইন টাওয়ারে নিচে পোঁতা থাকতো, সেগুলো ডিফিউজ করে ৩০-৩২ তুলে নিয়ে এসেছিলো নৌকার পাটাতনে, এলএমজি, রকেট লান্সার, ডেটোনেটরসহ অনেক কিছু ছিলো । পরে যাত্রাবাড়ী থেকে ওগুলো নৌকায় করে নিয়ে আসা হয় গুলশান লেকে, গুলশান থেকে বড় বস্তায় ভরে সাইকেলে করে বাসায় এনে মাটি পুতে রাখা হয়েছিলো ।
মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য ঢাকায় এলে বকর বেশির ভাগ সময় নিজ বাড়ীতেই থাকতো, আর তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে আশেপাশে থাকতো ছোট দুই ভাই- হায়দার আর আবরার । বকর ভাইদের কাছে বিভিন্ন অপারেশনের ঘটনা খুলে বলতো । যেমন- কুমিল্লার গোমতী নদীর উপর আর্মিরা গানবোর্ডে চড়ে পেট্টোলিং করতো, রাতের বেলায় কুচুরী পানার আড়ালে ভেসে থেকে এসএলআর এর মাথায় রকেট লান্সার লাগিয়ে গানবোর্ডগুলোর উপর চড়াও হওয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো । এই অপারেশনগুলো করা হতো মূলত পেট্রোলিং করা আর্মিদের অস্ত্র-টাকা পয়সা লুট করার জন্যে ।
তবে বকর ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়তেই এতবছর পরও ভাই হায়দারের চোখ ছলছল করে উঠে । ঘটনাটি মুগদাপাড়ার। বকর হঠাৎ জানতে পারে যে- ওখানকার স্থানীয় এক রাজাকার সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে আর লুটপাট করে বেড়াচ্ছে। এই খবর জানার পরই দুএকজনকে সাথে নিয়ে বকর চলে যায় মুগদাপাড়ায়, এক সন্ধ্যায় চাদরের ভেতরে স্টেনগান পেঁচিয়ে একটি ব্রিজের পাশে অপেক্ষায় থাকে বকর, অন্য সঙ্গীরা ব্যাকআপ হিসেবে কিছু দূরে। হাটফেরত সেই রাজাকার ব্রিজের কাছে চলে আসলেই বকর বেরিয়ে এসে চাদরের আড়াল বের করে আনে স্টেনগান, কিছু বুঝে ওঠার আগে স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় পাকিস্তানী রাজাকারটার।’
এই লেখার লেখক, অ্যাডিশনাল এসপি মাসরুফ হোসেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তারিক লিংকনের সৌভাগ্য হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেবার। একাত্তরের অনন্য সাধারণ সেই উপাখ্যান বলার সময় ফতেহ ভাই বারবার বলছিলেন তার অসম্ভব প্রিয় গেরিলা আবু বকরের কথা। সেই স্মৃতির অনুলিখন করেছেন মাসরুফ হোসেন-
”বিপদ এড়ানোর সব রকমের সুযোগ থাকার পরেও সব ছেড়েছুড়ে ও চলে আসল যুদ্ধে- দেশমাতার ঋণ শোধ করার শপথ নিয়ে। ওর একেবারেই নিষ্পাপ চেহারা আর অল্প বয়েস খুব কাজে লাগত গেরিলাদের। ট্রেনিং থেকে শুরু করে পুরোটা সময় ফতেহ চৌধুরীর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো ও, উনি যেখানেই যেতেন ও তার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত সে ও লেগে থাকত। প্রথম প্রথম সরাসরি যুদ্ধে ওকে যেতে দেয়া হত না, কিন্তু একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক কিছু কাজে ও ছিলো আলটিমেট চয়েস। এরকম একটা কাজ ছিলো হেড অফ ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স(আইএসআই), পূর্ব পাকিস্তান- গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে পরিবারসহ ভারতে পৌঁছে দেয়া। এই অফিসার পাক ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম সিনিয়র অফিসার হলেও হলেও বাঙালি বিধায় পাকিরা তাকে বিশ্বাস করতো না, কঠোর নজরদারীতে রাখতো। এই ভদ্রলোক পরিবারসহ একটা বিয়ে খেতে এসে সেখান থেকে ক্র্যাক প্লাটুনের এক জ্যেষ্ঠ মেম্বারের সহায়তায় পালিয়ে এসে বাসাবোতে একটা সেইফ হাউজে উঠলেন। সেখানে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় বকরের, ফতেহ আর বকরের দায়িত্ব পড়ে তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেবার।
এদিকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলাম(পরবর্তীতে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের এয়ার ভাইস মার্শাল ) নিখোঁজ হবার পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা, হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাঁকে। কারণটা স্বাভাবিক, যিনি ইন্টেলিজেন্সের এত সিনিয়র অফিসার, তাঁর কাছে ওরা নতুন তথ্য না দিলেও ইতোমধ্যে দেয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তো ছিলই- সেগুলোও যুদ্ধে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে সক্ষম হত। আমাদের দুই ‘ক্র্যাক’ সদস্য, যাদের বয়স যথাক্রমে ১৮ এবং ২২, সিদ্ধান্ত নিলো এরকম বিপজ্জনক একজন সঙ্গীকে তার পরিবারসহ নিয়ে যাবে ঢাকার বুক থেকে সোজা ভারতে, সব রকমের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে।
যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের কর্নেল র্যাঙ্কের একজন তার পক্ষে কাজ করার জন্যে পালিয়ে এসেছেন , আর তার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে তাঁর স্ত্রী আর শিশুপুত্রসহ বর্ডার পার করে দেশের বাইরের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। এমনটা ভাবাও দু:সাহসিকতা। আমাদের বীর ফতেহ আলী চৌধুরী আর তার সঙ্গী বাকের এই কাজটা করেছিলো,পরিবারসহ এভিএম ইসলাম সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলো ভারতের সোনামূড়াতে, যেখানে মুক্তিবাহিনীর একটি মেডিকেল ইউনিট অবস্থিত। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) আখতার এলেন, তিনি খবর দিলেন মেজর খালেদ মোশাররফকে। মেজর খালেদ মোশাররফ ফোনে কি কি জানি ইন্সট্রাকশন দিলেন- পুরো এলাকা গরম হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের ভেতরেই ভারতের ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এলেন, সঙ্গে ডজনখানেক উচ্চপদস্থ অফিসার।
প্রথমে তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি এরকম একটা কাণ্ড ১৮ আর ২২ বছর বয়েসি দুটো বাচ্চা ছেলে ঘটাতে পারে, এত এত চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে এরকম হাই প্রোফাইল কাউকে বর্ডার পার করে দিতে পারে। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিলো যে ফতেহ আর বকরকে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হল, নেয়া হল আলাদা আলাদা লিখিত স্টেটমেন্ট। যাচাই বাছাই শেষে সত্যতা প্রমাণের পর ভারতীয় অফিসাররা এভিএম ইসলাম সাহেবের নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে নিয়ে রাখলেন রেড ফোর্টে, সেখান থেকে পাকিস্তানের যাবতীয় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করল মিত্রবাহিনী। শওকত আলী (বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার) তখন আশেপাশেই ছিলেন, তিনি ফতেহকে ডেকে বললেন- ‘ফতে, তুই এইটা কি করছোস! দিলি তো ব্যাটা পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজায়ে!!এই অসম্ভব কাজ তুই কেমনে করলি?’
উত্তর পাননি শওকত আলী। এরকম দুর্বল মুহূর্তে বকর সব সময় ফতেহ চৌধুরীর কাছে সাহস নিতে চেষ্টা করতেন। ফতেহ অভয় দিয়ে বলতেন, ‘চিন্তা করিস না বকর, আমি থাকতে কোন কিছু তোকে ছুঁতেও পারবে না।’ ২৯ আগস্টের অল্প কিছুদিন আগে বড় একটা অস্ত্রের চালান নিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু লোকদের সাথে করে ত্রিমোহনীতে আসে বকর আর ফতেহ, গুরু আর শিষ্য। দুজন কি কারণে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন, বকর আগেই গিয়েছিলো ফকিরবাড়ি নামের একটা জায়গায়, অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতে। হায়, এই বিচ্ছেদই হলো কাল, ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত বকরও ধরা পড়ল ২৯ আগস্টে।
এ কথা বলতেই ফতেহ আলী চৌধুরীর গলা ভেঙ্গে আসে হাহাকারে। আর সেই শোকাচ্ছন্ন হয়েই লেখককে বলেন
“মাসরুফ, কথা দিয়েছিলাম আমি জীবিত থাকতে আমার সাথে থাকলে ওর কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আমার বকর মারা গেল সেই একাত্তরে, কই এই ৪৩ বছর ধরে আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। বকর, ভাই আমার, তোকে বাঁচাতে পারলাম না…।”
বকর জানতো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাকিস্তানীদের কাঁপিয়ে দেওয়া অপারেশনের পর সে ধরা পড়তে পারে যেকোনো সময়। পাকিস্তানীরা হয়ে উঠবে ক্ষিপ্ত। হয়েছিলও তাই। ২৯ আগস্ট দিবাগত রাত ৩ টার দিকে শহীদ আবু বকর বীরবিক্রমকে তাঁর বাড়ি থেকে পাকি বাহিনী আটক করে। পরে টর্চার সেলে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে। রুমী-বদি-আজাদ-জুয়েল-আলতাফ মাহমুদের মত বকরের লাশটাও আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মো. আবু বকরকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫০।
প্রাণপ্রিয় জীবনটা যারা হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিয়েছিল একটা স্বাধীন দেশের জন্য, আমাদের জন্য, মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে, সেই অগুনতি শহীদ বীরদের একজন শহীদ আবু বকর বীর বিক্রমের আজ জন্মদিন ছিল। বাংলাদেশ তাকে মনে রাখেনি, তার স্মরণে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছিল না তেমন কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ।
তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না।
এই বীরের জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বি:দ্র:- শহীদ বকরের ছবি কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক- অমি রহমান পিয়ালের কাছে অনুরোধ করলে তার ব্যক্তিগত আর্কাইভ থেকে খুঁজে দেন শহীদ বকরের একটি ছবি। প্রাপ্ত ছবিটি ছিলো সাদাকালো, অনেক দিনের পুরনো বিধায় কিছু জীর্ণ। ক্লাব অবসকিওরের শাওন মাহমুদের অনুরোধে সেই ছবিটি থেকে এই রঙিন প্রতিকৃতিটা করে দেন অসীম চন্দ্র রয়।
গ্রন্থ কৃতজ্ঞতা-
১। বারে বারে ফিরে যাই- মেজর(অব:) ডা. আখতার আহমেদ বীর প্রতীক
২। একাত্তরের দিনগুলি- জাহানারা ইমাম
সারাবাংলা/এসবি
একাত্তরের দিনগুলি জাহানারা ইমাম বারে বারে ফিরে যাই বীরবিক্রম মেজর(অব:) ডা. আখতার আহমেদ বীর প্রতীক শওকত আলী শহীদ আবু বকর বীরবিক্রম শহীদ বকর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল