আপনার শৈশব স্মৃতি কল্পনা নয়তো?
২২ মে ২০১৯ ০৪:১২
ঢাকা: গল্পটা এমন, আশির দশক, গ্রীষ্মকাল, একটি শিশু পারিবারিক অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনুষ্ঠানে আসা আরও অনেক শিশু এবং বড়রা তাকে আদর করছে। স্মৃতির পাতায় থাকা এই গল্প এখন অনেকটাই ঝাপসা, অস্পষ্ট। যিনি বলছেন, তিনি নিজেও নিশ্চিত নন গল্পের কতটুকু সত্যি। পরিবারের সদস্যদের কাছে শোনা। তবে সেই অনুষ্ঠানের ছবি আছে।
ছোটবেলার এমন স্মৃতি কম-বেশি আমাদের প্রত্যেকেরেই রয়েছে। তবে সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে একদম বিপরীত মত। গবেষকরা বলছেন, স্মৃতি থেকে শৈশবের গল্প আমরা বলি ঠিকই। কিন্তু প্রতি ১০ জনে, চারজন যা বলেন তা আসলে কাল্পনা।
গবেষকরা আরও বলছেন, আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশ আত্মজীবনীর স্মৃতি সংরক্ষণ করে, একটি শিশুর বয়স দুই বছর হওয়ার আগপর্যন্ত ওই অংশের গঠন শেষ হয় না।
তবে ওই বয়সেও শিশুদের স্মৃতি জমতে থাকে। যে কারণে তারা স্বজনদের দেখলেই চিনতে পারে। কিন্তু স্মৃতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বলেন ওয়েস্টমিনস্টার ইউনিভার্সিটির আত্মজীবনীমূলক স্মৃতি বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন লাভডে। তার মতে, মস্তিষ্কের ওই অংশ গড়ে উঠতে সময় লাগে বলেই, বড় হতে হতে আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায়।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স সাত বছর হলেই পুরনো স্মৃতিগুলো সরিয়ে সেই জায়গা নেয় নতুন নতুন স্মৃতি। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, আমাদের অনেকের মনেই শিশুকালের ঝাপসা স্মৃতি থেকেই যায়। যা ভাবিয়ে তুলেছিল মনঃগবেষকদের। আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে তাই লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর মেমোরি অ্যান্ড ল’ বিভাগের পরিচালক মার্টিন কনওয়ে আরেকটি গবেষণা পরিচালনা করেন।
এই গবেষণায় তিনি ৬ হাজার ৬৪১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাদের শৈশবের স্মৃতি বিশ্লেষণ করেন। এদের মধ্যে ২ হাজার ৪৮৭ জন বলেন, প্র্যামে বসে থাকার স্মৃতিও তাদের মনে আছে। ১৪ শতাংশ দাবি করেছেন, তাদের প্রথম জন্মদিনের আগের স্মৃতি এখনো পরিষ্কার মনে আছে। কেউ কেউ এমন ঘটনার উল্লেখ করেন, যেগুলো তাদের জন্মের আগে ঘটে গেছে।
কনওয়ে এবং তার সহযোগীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, আমাদের স্মৃতিতে এমন অনেক গল্প থাকে যা বাস্তবে কখনোই ঘটেনি। কিন্তু স্মৃতিগুলো এতটাই স্পষ্ট যে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়, এই স্মৃতিগুলো কিভাবে এলো?
আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের জীবনেই নানা ধরনের গল্প থাকে। বয়স যত বাড়তে থাকে অতীতের স্মৃতি তত বেশি হয়। আর এসব স্মৃতি বেশ গুরুত্বও বহন করে আমাদের যাপিত জীবনে। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রশ্ন আসে, আমরা স্মৃতির দিকে হাত বাড়াই। মনে করার চেষ্টা করি, এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেছিল কি?
একই বিষয়ে গবেষণা করেন কিমবারলি ওয়েড। তিনি বলেন, ‘এসব স্মৃতি থেকে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। কিন্তু অনেক সময় সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়। কোনো একটি বিষয় অনেক জানার পরেও স্মৃতির প্রভাবে ভুল হয়ে যেতে পারে।’
আর এই স্মৃতিগুলো আমাদের মনের সাদা কাগজে অন্য কেউ, এমনকি একদম অপরিচিত ব্যক্তি লিখে দিতে পারেন। কোনো ব্যক্তিকে এটাও বিশ্বাস করানো সম্ভব, ছোটবেলায় তিনি একটি অপরাধ করেছিলেন যা আইনত শাস্তিযোগ্য। যদিও এমন কোনো ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
যেকোনো ব্যক্তির মনেই ভ্রান্ত স্মৃতি জমতে পারে। যদি সঠিক পরিবেশ হয়, তাহলে যে কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন অন্যরা। সম্প্রতি একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট অংশগ্রহণকারীর শতকরা ৪৭ ভাগ মানুষের মনে আংশিক ভ্রান্ত স্মৃতি রয়েছে। ১৫ ভাগ ব্যক্তি মনে থাকা শৈশবের স্মৃতি পুরোটাই ভুল বা কল্পনা।
শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোনো একটি ছবি কিংবা ভিডিও দেখার পরে তারা নিজেদের ওই জায়গায় কল্পনা করে। এই কল্পনাগুলো থেকে যায় এবং বড় হওয়ার পরে মনে হয় ঘটনাগুলো সত্যি ছিল। তার সঙ্গে আসলেই এমনটি ঘটেছিল। শিশুকাল থেকেই যারা বই পড়ুয়া, তারা এই সমস্যায় বেশি পড়েন। কারণ বাহিরের জগতে কী হচ্ছে সেটা তারা লক্ষ্য করেন না। উপকথা, রূপকথা, উপন্যাসের গল্পই তাদের জগৎ হয়ে যায়- যোগ করেন ওয়েড।
মনে হতে পারে, সেই কবেকার শৈশব স্মৃতি সত্যি হোক বা না হোক তাতে কী বা এসে যায়! কিন্তু মনোঃবিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরবর্তী জীবনে অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে এই স্মৃতিগুলোর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ ছোটবেলার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, আবেগের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এর ওপর নির্ভর করে আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, ভয় এবং কোন পরিস্থিতিতে আমাদের আচরণ কেমন হবে।
যে খাবার খেয়ে আমরা জীবন ধারণ করি, প্রতিদিনই খেতে হয় যেসব খাবার তাতেও ভ্রান্ত স্মৃতির প্রভাব রয়েছে। অন্তত ২০টি পরীক্ষায় এই ফলাফল পাওয়া গেছে। ১৮০ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল নিয়ে একটি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় তাদের ভূমিকা হলো, অংশগ্রহণকারী সম্পর্কে জানা এবং তাদের জানানো।
একটি কক্ষে একজন অংশগ্রহণকারীকে পর্যায়ক্রমে ১৮০ জন স্বেচ্ছাসেবী এসে জানান, তার অতীত থেকে জানা গেছে, ছোটবেলা এগ সালাদ খেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করলেন। এভাবে কয়েকজনকে একই কথা জানানো হয়। এরপর তারা এগ স্যান্ডউইচও খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
পরবর্তী চারমাস পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তারা ডিমের তৈরি কোনো খাবার খাননি। কেউ কেউ লোভনীয় স্ট্রবেরি আইস-ক্রিম পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। যাদের বলা হয়েছিল ডিম তাদের সহ্য হতো না, ডিমের তৈরি বিস্কুট খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এসব কাল্পনিক স্মৃতি একজন খুব সচেতন ব্যক্তিকেও আদর্শচ্যুত করে দিতে পারে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যখন ভ্রান্ত স্মৃতির কারণে মানুষ অপরাধ করে বসে। দেখা গেছে, যাদের অবচেতন মনে শিশুকালে নির্যাতনের ভয় থেকে যায়, তারাই পরবর্তীতে অপরাধী হয়ে ওঠে অনেক ক্ষেত্রে।
৬০’র দশকে যাদের জন্ম তারা মনে করতে পারবেন ‘স্যাটানিক প্যানিক’ শব্দটি। আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ‘স্যাটানিক রিচ্যুয়াল অ্যাবিউজ’ থেকে এসেছে এটি। শয়তান উপাসকরা শিশুদের অপহরণ করতো এবং শয়তানের সন্তুষ্টি অর্জনে হত্যা করতো। কখনো কখনো গণধর্ষণ করা হতো। পরবর্তীদের এসব শিশুদের জায়গা হতো পতিতা পল্লীতে। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
শয়তান উপাসকদের কাঁধে বন্দুক চাপিয়ে অন্য যুদ্ধও চলে। যেখানে বিত্তবানদের সন্তানরা বেশি ভুক্তিভোগী হয়। তাদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। তবে নব্বই পরবর্তী সময়ে এই ঘটনা কমতে শুরু করে।
একটি দিবা শিশুপরিচর্যা কেন্দ্রে কর্মরত দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা শিশুর বুক কেটে হৃদপিণ্ড বের করে আনে। জীবিত শিশুকে মাটি চাপা দেয় এবং হাঙ্গর ভর্তি সুইমিংপুলে শিশুকে ছুড়ে মারে। এসব অভিযোগে তাদের ২১ বছরের কারাদণ্ড হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন। শৈশবের মিথ্যা স্মৃতি থেকে স্যাটানিক প্যানিক হতে পারে বলে মত দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
লাভডের মতে, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের এসব ধারণা বা শৈশবের মিথ্যা স্মৃতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। সহজ পদ্ধতি হলো, কারো মুখ থেকে ছোটবেলার গল্প শোনার পরে তা যাচাই করে দেখা। ছবি, ভিডিও দেখা এবং একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে আলাদা আলাদা করে গল্প শোনা।
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় উঠে আসা সামগ্রিক বিষয়গুলো মোটা দাগে হয়ে থাকে। এর সবটা সবার সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে সেটা ভাবা উচিত হবে না।’
এটা ‘পারফেক্ট’ সমাধান না, তবে কার্যকর একটি পদ্ধতি বলে মত দিয়েছে ওয়েড। তিনি বলেন, ‘আমাদের শৈশবে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ওই সময়ের স্মৃতিতে কিছুটা অমিল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো আমাদের শিশুকালের স্মৃতি স্পষ্ট হবে এটা প্রত্যাশা করাও বোকামি।’
গবেষকদের মতে, শৈশবের স্মৃতি যেমনই হোক সচেতনভাবে সেটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। কেননা, ভীষণ বিষণ্ন সময়ে পরলোকগত দাদা-দাদি কিংবা পোষা প্রাণীর স্মৃতি আনন্দের উৎস হতে পারে। সেটা প্রকৃতপক্ষে ঘটে থাকুক বা ভ্রান্ত স্মৃতি হোক।
এক ব্যক্তি তার শৈশব স্মৃতি থেকে বলেছেন, অনেকদিন পরে আমি যখন দাদির সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। আমরা এক সঙ্গে সাঁতার কেটেছিলাম। যদিও এটা সম্ভব না, কিন্তু এই স্মৃতি যতবার আমার মনে পড়ে ততবার আমি আনন্দিত হই।
সারাবাংলা/এটি/এমও