উৎসব কি নারীরও?
৩১ মে ২০১৯ ১২:২০
বছরজুড়েই ঈদ, পূজা, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ- একের পর এক উৎসব আসতে থাকে মহা সমারোহে। বাড়িতে বাড়িতে কেনাকাটা, রান্নাবাড়ার ধুম। ঈদের সকালে পরোটা গোশত তো দুপুরে মোরগ পোলাও। রাতে আবার প্লেন পোলাওর সাথে চাই রোস্ট, রেজালা। নানারকম মিষ্টি, সালাদ, সবজি, কাবাব, কত যে খাবারের আয়োজন।
আবার পূজোর সময়ে নাড়ু চাই কয়েকরকম। পূজোর একেকদিন একেকরকম রান্না- কোনদিন নিরামিষ তো কোনদিন আমিষ। উৎসবের কয়েকটা দিন ঘরবাড়িও থাকতে হবে ঝকঝকে পরিষ্কার আর গোছানো। আলমারি আর ডিনার ওয়াগন থেকে নামবে নতুন বিছানার চাদর, সোফার কাভার, কাঁচের বাসন। বাড়িতে অতিথি আসবে। সবাই ঘরসজ্জার প্রশংসা করবে, খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে।
উৎসব ঘিরে এই প্রতিটা জিনিস সুচারুভাবে সম্পন্ন করার পেছনে থাকে সেই পরিবারের গৃহকর্ত্রীর হাত। ঘরের প্রতিটা কাজ পরিবারের নারীকেই করতে হয়, তিনি চাকরিজীবী হোন, কী গৃহিণী। নারীনেত্রী খুশী কবীর বলেন, আজকাল সব অর্থনৈতিক শ্রেণীতেই কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও ঘরের কাজের দায়িত্ব এখনও শুধুমাত্র নারীর উপরই ন্যস্ত থাকে। তিনি বলেন, যারা বাইরে কাজ করেন না, তারা ঘরে বসে আয় করেন। কেউ অনলাইনে ব্যবসা করছেন, কেউ বা আউটসোর্সিং করেন। এভাবে নারীরা সংসার খরচের অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু দেখা যায়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলেও ঘরের কাজ, বাচ্চার দেখাশোনা, সংসারের বাজার কিংবা অন্যান্য কেনাকাটা ইত্যাদি এখনও নারীকেই করতে হয়।
দুই সন্তানের মা উম্মে সালমা একজন গৃহিনী। বলছিলেন, সারাবছর দুই সন্তানের দেখাশোনা, ঘরের কাজ সব তিনিই করেন। ঈদ বা বড় কোন উৎসবেও তার ব্যতিক্রম নেই। তবে উৎসবের পরিকল্পনা, কেনাকাটা তারা স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই করেন। ঈদে তাদের বাড়িতে প্রচুর মেহমান আসে। তাই সারাদিন সবাইকে আপ্যায়ন করতে করতে নিজের জন্য কোন সময় থাকে না সালমার।
জানতে চাইলাম, ঘরের কাজের চাপ আরেকটু কম থাকলে তিনি ঈদ বা অন্যান্য উৎসব আরেকটু বেশি উপভোগ করতে পারতেন কিনা। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তা তো পারতামই। কিন্তু লোকজন সব আমাদের বাড়িতেই আসে। তাই আমি আর বের হওয়ার সময় পাইনা।’
খুশি কবীর বলেন, ‘বাঙালির উৎসব মানেই নতুন পোশাক আর খাওয়া। কে কোন পোশাক কিনবে, আর কি খাবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর সম্পন্নকরণ দুটোই নারীকেই করতে হয়।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শাহানা পারভীন। দুই বছরের সন্তান, স্বামী আর বাবা-মা নিয়ে তার সংসার। বলছিলেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। তাই একমাত্র ছেলেকে দেখাশোনার জন্য তার বাবা-মাকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। প্রতিদিন অফিস, রাস্তার জ্যাম মিলিয়ে বাইরে থাকেন প্রায় দশ থেকে বারো ঘন্টা। তারপরেও ঘরে ফিরে সংসারের কাজের অনেকটা তাকেই করতে হয়। বলছিলেন, বাবা-মা এবং স্বামী অনেকটা সাহায্য করলেও মূল চাপটা তার উপরেই থাকে। শাহানা বলছিলেন, ‘এভাবেই করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কী রান্না হবে, কতটুকু রান্না হবে, কাদের দাওয়াত দেবো বা কাদের বাসায় যাবো, এই পরিকল্পনাগুলো তিনি করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তার স্বামীর হাতে ছেড়ে দিলে কাজটা হয়তো ঠিকঠাক হবে না তাই তিনি নিজেই করেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্র ঠিক করে দেয় সমাজ ও পরিবারে একজন নারীর ভূমিকা কী হবে। সংসারে একজন নারী কতটা কাজ করবে, কীভাবে করবে তাও সমাজই ঠিক করে দেয়। তিনি বলেন, ‘যিনি ঘরের কাজ করেন, তাকেই আদর্শ নারী মনে করা হয়। তাই সারাবছরের মতো উৎসবেও নারীর উপরেই কাজের চাপ থাকে।’
শান্তা চক্রবর্তী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। জানালেন আজীবন ঘর-সংসার সামলেই চাকরি করতে হয়েছে তাকে। পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতেন ছয় কিলোমিটার দূরের স্কুলে। স্কুলের পাশাপাশি পরিবারের সবার জন্য রান্নাবান্না, বাচ্চাদের দেখাশোনা, সংসারের দায়িত্ব সব একা হাতে সামলেছেন তিনি। গর্ভাবস্থাতেও এই নিয়ম। বলছিলেন, ‘সকালে রান্নাঘরের চুলার পাশে বসিয়ে দুই ছেলেকে পড়াতেন রান্না করতে করতে। স্কুলের সময় হলে নিজে তৈরি হয়ে, সবাইকে খাবার দিয়ে, সন্তানদের প্রস্তুত করে নাকেমুখে খেয়েই দৌড় দিতেন স্কুলের দিকে।
এদিকে উৎসব মানেই যেন বাড়তি কাজের চাপ। তাদের বাড়ির উৎসবগুলো এখনও যৌথভাবে পালিত হয়। পূজোর কাজ, রান্না-বান্না সবকিছু বাড়ির বউরাই করেন। সারাবছরের মতো এসময়েও পুরুষরা ঘরের কাজে হাত দেন না।
শান্তা চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘বরং তাদের (পুরুষদের) খুশি করতেই মেয়েদের সব কাজ নিখুঁতভাবে করতে হয়। কাজ একা ঘরের বউরা করলেও পূজার বাজার দেখা যায় দুজনেই করেন। তিনি বলছিলেন, ‘উপার্জন দুজনেই করলেও কাজের ভারটা বাড়ির মেয়েদেরই বেশি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণেই পুরুষরা এমন করে। তারা ভাবে ঘরের কাজ সব মেয়েরা করবে, পুরুষরা হাত লাগাতে পারবে না।’
একজন ভালো নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয় না। বরং সবার খুশির জন্য নিজের ইচ্ছা ও খুশি ত্যাগ করেন এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। চারদিকে তাকালে এমন নারীর সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের নারী সদস্যরা কী পরবেন, কী করবেন, কোথায় যাবেন বা যাবেন না তাও পরিবারের পুরুষরাই ঠিক করে দেন। অথচ পরিবারের সবার দেখাশোনা করতে যেয়ে একজন নারীর উপর যখন অতিরিক্ত শারীরিক-মানসিক চাপ তৈরি হয় তখন সাহায্য করার জন্য পুরুষ সদস্যরা এগিয়ে আসেন না। বরং পুরুষ সদস্যরা ঘরের কাজ করা নিজেদের জন্য লজ্জার বলে মনে করেন।
ড. সামিনা বলেন, ‘এই যে নারীকে ভালো মা, ভালো মেয়ে, ভালো বউ বা ভালো স্ত্রী হতে হবে এটাও সামাজিকভাবেই নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। যে নারী ঘরের কাজ সব একা হাতে সামলায় সেই ভালো এমন একটা ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকাল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে চাকরিবাকরি শুরু করলেও দেখা যায় তাদের উপর এখন চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। তাদেরকে বাইরে সামলিয়ে ঘরও সামলাতে হচ্ছে। অফিস করে এসে একজন নারীকেই বাজার করতে হয়, ইফতারি, রাতের খাবার বা সেহরি কি হবে তা ঠিক করতে হয়, বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয়। আবার ঈদের প্রস্তুতিও নারীকেই নিতে হয়।’
তাহমিনা ইসলাম বলছিলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই ঈদের দিন শ্বশুর বাড়িতে থাকেন (এখন নিজের বাড়ি) আর ঈদের পরদিন বাবার বাড়িতে যান তারা। তাদের বাবার বাড়িতেও বউরা ঈদের পরদিন নিজদের বাবার বাড়িতে যায়। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। জিজ্ঞাসা করলাম এইযে ঈদ কোথায় করবেন সেই সিদ্ধান্ত কে নেয়। খুব সহজভাবেই বললেন, তারা স্বামী নেয়। অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্ত পরিবারের পুরুষ সদস্যই নেবেন, সেটাই যেন স্বাভাবিক।
বড় পরিবারের বউ তাহমিনা দুই সন্তানের মা। সারাবছর তো বটেই রোজা বা ঈদের সময় উৎসবের সমস্ত পরিকল্পনা, কেনাকাটা, রান্নাবান্না, অতিথি আপ্যায়ন, সব একা হাতেই সামলাতে হয় তাকে। এতোসব কিছুর ভীড়ে নিজের জন্য কোন সময় থাকে না তার।
তাহমিনার মতো নারীর সংখ্যাই এখনও সমাজে বেশি বলেই বলছিলেন ড. সামিনা। নারীর উপর বাড়তি চাপের কারণে তারা নিজেদের জন্য কোন সময়ই বের করতে পারেন না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘ঘরের কাজ, বাইরের কাজ- এই সবকিছু মিলিয়ে নারীদের এখন নতুন এক দারিদ্র যুক্ত হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে, ‘টাইম পোভার্টি’।’
বিয়ের পরপর নিজের মতো করে আনন্দ উপভোগের ইচ্ছা থাকলেও ছেলেমেয়ে হয়ে যাওয়ার পর তাদের খুশিতেই নিজের খুশি মেনে নিয়েছেন তাহমিনা। পরিবারের সবার আনন্দেই নিজের আনন্দ খুঁজে পান তিনি। বলেন, মাঝেমধ্যে ‘এতো দায়িত্ব পালন করতে করতে মানসিক চাপ লাগলেও কিছুই করার নাই।’
ড. সামিনা বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখবেন মিডিয়া ঠিক করে দিচ্ছে সমাজে বা পরিবারে নারীর আদর্শ ভূমিকা কী?’ তিনি বলেন, ‘দেখবেন, টিভি কমার্শিয়ালে দেখানো হয় একজন আদর্শ নারী একা হাতে রান্নাবান্না করে ঘরের সবাইকে খাওয়াচ্ছে। আর বাড়ির বাকিরা রান্না ভালো হল কিনা তাই নিয়ে মতামত দিচ্ছে। আবার কাপড় ধোঁয়া, ঘর পরিষ্কার করাও যে নারীর কাজ তা দেখানো হচ্ছে।’ কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, প্রতিনিয়ত এসব দেখানোর ফলে সমাজে নারীর উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখন সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলেও নারীর উপর চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। যা একজন নারীকে ‘ভালো নারী’ হওয়ার চাপ তৈরি করছে।’
শাহানা, সালমা, এবং তাহমিনা- প্রত্যেকেই বলছিলেন তাদের স্বামীদের উপর ঘরের কাজের দায়িত্ব দিতে তারা ভরসা পান না। কারণ তাতে কাজটা সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে কিনা সেই ভয়টা থেকেই যায়। কারণ, পুরুষরা এসব দায়িত্ব নিয়ে বা কাজ করে অভ্যস্ত না।
উত্তরণের পথ
ডক্টর সামিনার মতে ঘরের কাজ যে নারী-পুরুষ দুজনেই করতে হবে এই বার্তাটা নারীকেই পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হবে। তাকে বলতে হবে, অর্থনীতির মতো ঘরের কাজও বন্টন হতে হবে। তাছাড়া, স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘরের কাজ করলে আনন্দময় পরিবেশ বজায় থাকবে। ছেলে মেয়েরাও শিখবে যে ঘরের কাজ সবাই মিলেই করতে হয়। এতে তাদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যমূলক চিন্তা আসবে না। এভাবেই সমাজ থেকে ধীরে ধীরে একসময় লিঙ্গ বৈষম্য কমে যাবে, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ঘরের কাজের চাপ একা নারীর উপর পড়াতে কিন্তু আজকাল অনেক বিয়েও ভেঙে যাচ্ছে। স্বামী- স্ত্রী দুজনেই বাইরে কাজ করে টাকা আনলেও ঘরের দায়-দায়িত্ব নারীকে একা হাতে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তখনই দেখা যায় দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। পুরুষরাও সামাজিকভাবেই এসব কাজ নারী করবে এই চিন্তা করেই অভ্যস্ত তাই তারাও অংশ গ্রহণ করছেনা। ফলে সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে।
সবকিছু মিলিয়ে সমাজে ও পরিবারে সুস্থ পরিবেশ ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ঘরের কাজে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ জরুরি বলে জানান ড. সামিনা।
নারী নেত্রী খুশী কবীর বলেন, ‘শুধু উৎসবেই নয়, সারাবছরই ঘরের কাজ শুধু নারী করবে তা ঠিক নয়। নারী ও পুরুষ দুজনেরই সমানভাবে অংশগ্রহণ জরুরী।’
শাহানা বলছিলেন, আমাদের দেশে ছেলেরা এভাবেই বেড়ে ওঠে যে তারা সংসারের কাজ করতে পারেনা। তাদের দায়িত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। তার মতে, উৎসব আসলেই যে বাড়তি মানসিক টেনশন যুক্ত হয়, সেটা না থাকলে বা ভাগাভাগি করতে পারলে উৎসবগুলো আরেকটু উপভোগ করতে পারতেন।
শান্তা চক্রবর্তী মনে করেন, ‘সমাজব্যবস্থা এভাবে চলতে পারে না। এই পরিস্থিতি দূর করতে মেয়েদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে বলেন তিনি। নিজের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে যে ঘরের কাজ শুধুই নারীর নয়। ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়ে কাজ ভাগ না করে দিলে তারা বড় হয়ে সব কাজই করতে শিখবে।’
ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত
মডেল দম্পতি- সুরাইয়া হালিম ও আব্দুল হালিম
সারাবাংলা/আরএফ/