আমারও মন ভাঙ্গে, চোখে আসে জল
১৫ জুন ২০১৯ ১১:৫৭
১৭ বছর ধরে আমি বলে চলেছি একই কথা। ভুলতেও পারি না। কি আর করা। বুকের ভেতর এক অব্যক্ত ব্যাথা নিজেকেই বলে ওঠে, তুমিতো পরাজিত। পারলে না তোমার ভাইকে কেন মেরে ফেলা হলো তা জানতে? কিসের সাংবাদিকতা করো তুমি?
অনেক সময় ভাবি বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু কিইবা আমি করতে পারতাম? চেষ্টা যে করিনি তা তো নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী কিছু সাংবাদিক আর ব্যবসায়ীর কাছে হেরে গেছি। তাদের টাকার প্রভাব আর প্রতিপত্তির সাথে আমি কোনভাবেই পেরে উঠিনি। ছিল আরো কত হুমকি।
বন্ধুরা, আমার ছোট ভাই সুতনু নন্দী বাবনের কথা বলছিলাম। যার গিটারের যাদু আমাকে তাদের পরিবারেরর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর আমার বিয়ের মাত্র এক বছর পর আমাকে ঢাকা থেকে তাঁর নিথর দেহ বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে চট্টগ্র্রামে। সেই সময় চট্টগ্রামের এক ব্যান্ড গ্রুপে গিটার বাজিয়ে গান গাইতো বাবন।
২০০২ সালের ১১ জুন বাবনকে গিটার বাজানোর কথা বলে তার কয়েকজন বন্ধু ঢাকায় নিয়ে যায়। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে আমরা তার কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। ২০০২ সালের ১৩ই জুন রাতে খবর পাই, বাবন খুবই অসুস্থ। সেদিন মধ্যরাতে ফয়সাল নামে বাবনের এক বন্ধুর মাধ্যমে ফোনে আমার সাথে শেষ কথা হয় বাবনের। অনেক অনুরোধের পর ফয়সাল আমাকে বাবনের সাথে কথা বলতে দিয়েছিল। বাবন ফোন ধরেই আমাকে বলেছিল- ‘অশোক দা আমাকে বাঁচান’। আমি কিছু জানতে বা বলতে চাওয়ার আগেই ফোনের লাইনটা কেটে দেওয়া হয়। তারপর থেকে ফোনটি কেবলই বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য মাধ্যমে ফোন করে শুধু জানতে পেরেছিলাম বাবনকে রাজধানীর মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলাম আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে। বন্ধু সেই হাসপাতালে গিয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ডাক্তার হিসেবে তার যে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, তার কিছুই সে করেনি। এরপর আর কোনভাবেই ডাক্তার বন্ধুটিকে রাতের ঘুম থেকে জাগাতে পারিনি। অথচ এই বন্ধুর জন্য আমি একসময় অনেক কিছু করেছিলাম।
ডাক্তার বন্ধুকে না পেয়ে গভীর রাতে অনেক কষ্ট করে হাসপাতালের ফোন নাম্বার যোগার করি। সেখানে ফোন দিলে তারা জানান, রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরদিন ১৪ই জুন ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার আগে জানতে পারি, গেলো রাত ২টার দিকে কে বা কারা বাবনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলে রেখে যায়। ভোর হলে আমি সহযোগিতা চাই, সাংবাদিক বড় ভাই নঈম নিজামের কাছে। তিনি এটিএন বাংলা সহকর্মী সঙ্গীতশিল্পী চন্দন সিনহাকে সাথে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে খোঁজ করে জানতে পারেন গভীর রাতে একজন নাম পরিচয়বিহীন রোগিকে আনা হয়েছিল। সেই রোগি ভোরে মারা গেলে তাকে মর্গে পাঠানো হয়েছে।
প্রকৃতিও মনে হয় সেই মৃত্যুতে অঝোর ধারায় কাদঁতে শুরু করে ভোরবেলায়। ভারী বৃষ্টির মধ্যে নঈম নিজাম ও চন্দন সিনহা গিয়ে দেখেন মেডিকেলের মর্গের সামনে খোলা আকাশের নীচে বেওয়ারিশ হিসেবে বৃষ্টিতে ভিজছে বাবনের দেহ।
সেই থেকে ১৭ বছর পেরিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামের সংগীত সাধক ওস্তাদ মিহির নন্দী তাঁর একমাত্র ছেলে সুতনু নন্দী বাবন-এর হত্যার বিচার চাইতে চাইতে না পেয়ে নিজেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনিতো ননই, আজ পর্যন্ত আমরা কেউই জানতে পারলাম না, গিটার বাজাতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া বাবনকে কারা, কেন মেরে ফেললো? জনস্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউটের রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো মিথানল বিষক্রিয়ায় বাবনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ শুরু থেকেই ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল এবং মামলা নিতেও গড়িমসি করেছিল। পরে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনের হস্তক্ষেপে প্রথমে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা গিয়েছিলো। পরে আমাদের উদ্যোগে সিআইডি’র কাছে মামলাটি পাঠানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ৫ যুবকের জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশের কাছ থেকে জানার পর সিআইডি শুরুতে দ্রুত গতিতে মামলা তদন্তের উদ্যোগ নেয় এবং কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারও করে। কিন্তু তারপর কোনও এক অজানা কারণে তদন্ত আর এগোয়নি। এমনকি প্রধান আসামীকেও পুলিশ গ্রেফতার করেনি। তদন্ত ঝিমিয়ে পড়ায় গ্রেফতারকৃত আসামীরাও বেরিয়ে যায়। ভিসেরা রিপোর্টে বাবনকে হত্যার যথেষ্ট আলামত পাওয়া সত্ত্বেও তদন্ত সংস্থা সিআইডি মামলার কোন তদন্ত না করে, বাদী এবং সাক্ষীদের সাথে কথা না বলে রহস্যজনকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। তার অর্থ দাঁড়ায় পুলিশ কোন অপরাধ খুঁজে পায়নি। ফলে আমাদের পরিবার বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে। পরবর্তীতে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করে সঠিক তদন্তের জন্য আমরা বেশ কয়েকদফা চেষ্টা করেও কোন ফল পাইনি।
বিচার না পাওয়ার এই কষ্ট নিয়ে অনেকের কাছেই ছুটে গিয়েছিলাম। সবাই শুধু আশ্বাস আর স্বান্তনাই দিয়েছেন। কিন্তু বিচার পাইনি ১৭ বছরেও। তিন দশক ধরে সাংবাদিকতা করে মানুষের এতসব খবর বের করেছি, কিন্তু বাবনের হত্যার পেছনের খবরটি আজো বের করতে পারলাম না। তার হত্যার বিচারও নিশ্চিত করতে পারিনি আজো। নিজেকে তাই সত্যিই একজন পরাজিত ব্যক্তি মনে হয়। আমার কেবলই ভাবনায় আসে, আমাদের পরিবারের কি কোন অধিকারই নেই জানার! কেন, কারা, কি কারণে বাবনকে হত্যা করলো? কেন সমস্ত কিছু থাকার পরও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে বাবন পড়েছিল ঢাকা মেডিকেল মর্গে?
ডাক্তারদের কাছে জানতে পেরেছিলাম, তখন মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার ঔষধ পেলেই বাবন বেঁচে যেতো। পরিবারের কেউ তার সাথে ছিলো না। বাবনকে কেউই সেই ঔষধ দেয়নি। আমার ছোট ভাইটিকে বাঁচাতে না পারার এই কষ্ট যেমন আমাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, তেমনি বিচার না পাওয়ার গ্লানিতেও কাটবে বাকি জীবন।
বাবন চলে গেছে আজ ১৭ বছর। বাবন তুমি জেনো, আমরা তোমাকে কোনদিনও ভুলবো না।
অশোক চৌধুরী : সাংবাদিক, বার্তা প্রধান, বৈশাখী টেলিভিশন।
অশোক চৌধুরী ওস্তাদ মিহির নন্দী বাবন বার্তা প্রধান বৈশাখী টেলিভিশন