[পর্ব -৬] পরিবারেই ধর্ষক
১১ জুলাই ২০১৯ ১৩:৫৬
আমার মানবাধিকার সংস্থার কর্মজীবনের শুরুতে সবচাইতে কষ্টদায়ক, পীড়াদায়ক এবং বিষয়টি মানতে না পারার মত একটি মেয়ের জীবনের ঘটনার কথা শুনতে আমাকে তার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো।
তখন মাত্র কিছুদিন হলো ঐ মানবাধিকার সংস্থাটিতে যোগ দিয়েছি। প্রতিদিনই পরিবারিক নানা বিষয় নিয়ে নারীরা আসতো। যাদের কাছে শুনতে হতো নানা কষ্ট আর যন্ত্রনাদায়ক নির্যাতনের কথা। অভিযোগ শোনা এবং সেসব নির্যাতিত নারীদের সর্বোচ্চটা পাইয়ে দেবার চেষ্টায় কোন কমতি রাখতাম না।
খুব মনে পড়ে সদ্য চাকরীতে যোগদানের এক বা দুইদিনের মধ্যে আমার কাছে একটি মেয়ে আসলো। সঙ্গে তার মা। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। তার শারিরীক অবয়বেই সেটা ফুটে উঠেছিল। দেখে অনুমান করলাম, মেয়েটির বয়স সর্বোচ্চ বিশ বছর হবে।
মেয়েটি একদম চুপ। কোন কথাই বলছেন না। আমি বারবার তার কাছে জানতে চাইছিলাম ‘তোমার কী সমস্যা?’ আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। মেয়েটির আচরণে খুব অবাক হলামা। মেয়েটির কাছে কোন উত্তর না পেয়ে তার মায়ের কাছে জানতে চাইলাম তার মেয়ের সমস্যা কী। সে বিবাহিত কিনা।
মা তখন কোন কথা না বলে আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে তাকে মেয়ের সমস্যাটি খুলে বলতে বললাম। মেয়েটির মা আমাকে যা বললো সেটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, ‘আপা আমার স্বামী, মেয়েটির নিজের বাবা তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে। আমি চাকুরীসূত্রে ঘরের বাইরে থাকি। এ সুযোগে তার বাবা জোর করে মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতো। এক পর্যায়ে মেয়েকে সে বাধ্য করে। খুব ছোট থেকে আমার মেয়ে তার নিজের বাবার হাতে এমন নির্যাতনের শিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছুই বুঝিনি। বাবা, মেয়েকে ধর্ষণ করবে এমন চিন্তা কী কখনো মাথায় আসে? মেয়েও আমাকে কখনো জানায়নি এসব নিয়ে। এখন মেয়ে অন্তসত্ত্বা এবং তার পেটে তার বাবার সন্তান। আমার মেয়ে শারীরিক পরিবর্তন হওয়ায় আমি জানতে পারি এবং মেয়ে আমাকে বিষয়টি খুলে বলে। আমি আমার মেয়ের বাবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই। কিন্তু এ মেয়েকে বাড়িতে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মেয়েকে আশ্রয় দিন এবং আমি চাই তার বাবার শাস্তি হোক।’
এমন একটি ঘটনা শুনে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। মনে আছে, আমি ঠিকমত খেতে পারিনি কিছুদিন। আমার সহ কর্মীদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তারপর হালকা হই। ভেবে পাচ্ছিলাম না, এ কেমন বিকৃতি? যে সন্তানকে আমি জন্ম দিলাম সে সন্তানই আমার ভোগের বস্তু হলো। যা শুধুমাত্র একজন পুরুষের দ্বারাই সম্ভব।
একজন পুরুষই যেন শুধুমাত্র ভাবতে পারে, ‘আমি পুরুষ। তাই আমার সাথে একটি মেয়ে যে সম্পর্কেই সম্পর্কিত হোক না কেন, আমার বোধ, বুদ্ধি, চেতনা, মানবিকতা লোপ পায়। তখন আমার মনে একটি মাত্র বিষয় কাজ করে আর তা হল আমাকে ভোগ করতে হবে। আমার উদগ্র কামনা চারতার্থ করতে হবে।’
এখন আমার দেশে যে হারে শিশু ধর্ষণ বাড়ছে। তা বলার কোন ভাষা নেই। কোথায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না একটি শিশু। রাস্তা-ঘাট, নিজের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, মাদ্রাসা, স্কুল- সর্বত্র যেন ধর্ষণের মহোৎসব। এ উৎসবের বলি যেন শিশুরাই। একটি কোমলমতি অবুঝ শিশুকে ধর্ষণ করার মত বিবেকহীন কুলাঙ্গারের যেন কমতি নেই আমাদের সমাজে। ভদ্রবেশী, সুদর্শন, সুপুরুষ পুরুষরাই যেন ওৎ পেতে থাকে কখন খাবলে ধরে খাবে ঐ শিশুদের আর বন্য আদিমতায় তাদের লিপ্সা পূরণ করবে।
সাধারণত দেখা যায়, আমাদের সমাজে এবং পরিবারেই প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার শিকার হয় শিশুরা। তাও খুব কাছের মানুষের দ্বারা। আমি আমার কর্মজীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা দেখেছি। পরিবারের সবচাইতে আপন মানুষটি শিশু ধর্ষণ করেছে। যৌনতার স্বাদ নিয়েছে নিজের সন্তানের কাছ থেকে। এর থেকে কু-চিন্তা, কু-কর্ম আর কি হতে পারে? একটি পুরুষ যখন তার অনৈতিক চিন্তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে তখন সে পারে তার ঔরষে জন্ম দেওয়া সন্তানের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতে। বাবা-ধর্ষক, বাবা- উৎপীড়ক এর চাইতে লজ্জা অপমান একজন পুরুষের আর কি হতে পারে।
আমি এমনও শিশু পেয়েছি যে তার মায়ের বিয়ের মাসখানেকের মাথায় সৎ বাবার কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একই ছাদের রাতে মা আর দিনে সেই মায়ের সন্তান হচ্ছে স্বামী এবং বাবা নামক সেই পুরুষের শয্যাসঙ্গী। এ লজ্জা, এ অপমান আমাদেরই।
অতি সম্প্রতি পেশাগত কারণে অন্য একজন পেশাজীবির সাথে কথা হচ্ছিল। বিষয়টি ছিলো ধর্ষণ বা বাবা কর্তৃক ধর্ষণ। তিনি তার পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারই বর্ণনা করছিলেন। বলছিলেন- মা মারা যাবার পর বাবা তার দুই সন্তান (বড়টি ছেলে এবং ছোটটি মেয়ে) কে ফুফুর বাড়িতে রেখে আসে। মেয়েটি ফুফুর বাড়িতে নিগৃহিত হবার কারণে বাবা ছেলে সন্তানটিকে ফুফুর কাছে রেখে নিজের ১০ বা ১১ বছরের মেয়েটিকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মেয়েটিকে নিয়ে আসার কিছুদিন পরই শুরু হয় তার উপর যৌন নির্যাতন। মেয়েটি প্রায় রাতেই কান্নাকাটি করতো। প্রতিবেশিরা মনে করতেন হয়তো মৃত মায়ের জন্য কাঁদছে শিশুটি। এদিকে বাবার হুমকির কারণে ছোট্ট শিশুটি কাউকে বলতেও পারছিলো না সে কি নির্মম নির্যাতনের শিকার। এক পর্যায়ে বাড়ির আশপাশের কিছু মেয়ে একরকম জোর করেই জিজ্ঞেস করে তার কি হয়েছে। মেয়েটি তখন তার উপর বাবার ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিতে থাকে। প্রতিবেশিরা বিষয়টি জেনে ফেলে এবং ঐ পাষন্ড বাবাকে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তুলে দেন।
কিন্তু ঐ শিশু সন্তানটি কি ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বড় হবে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের সবারই আছে আশা করি। যে বাবার মা-মরা সন্তানকে মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ আর আদরে বড় করার কথা ছিল। সেই বাবাই যখন সন্তানকে স্নেহ বঞ্চিত করে উল্টো আজীবনের জন্য ক্লেদাক্ত স্মৃতি বহনের চিহ্ন দিয়ে যায় সেই যন্তরণার ভার শুধুমাত্র সেই শিশুটিই আজীবন ভোগ করবে।
আমরা চারপাশে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা দেখছি। সম্প্রতি একটি মানবাধিকার সংস্থার জরিপে দেখা গেছে ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসের মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিলো ৬৩০টি। ভুক্তভোগীদের বয়স ১৮ বা তার নীচে আর ধর্ষণ পরবর্তী শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। যাদের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ধর্ষণের হাত থেকে বাদ যায়নি শিশু, নারী, কিশোরী এমনকি ৯০ উর্ধ্ব নারীও।
ধর্ষণ এখন মহামারী আকার ধারণ করছে। আমাদের শিশুরা পরিবারের অতি আপনজনদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে বাবা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, যে বাবা সন্তানের লালন-পালন করে, সেই বাবাই একসময় তার কন্যা শিশুটিকে নিজের ভোগের সামগ্রী ভাবে।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ এ বলা আছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড। ধর্ষণ অথবা ধর্ষণ পরবর্তী কারণে মৃত্যু হলে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা।
দেশে প্রচলিত আইন দিয়ে ধর্ষণ রোধ সম্ভব। কিন্তু বিদ্যমান আইনের দীর্ঘ সূত্রিতা ধর্ষণের ব্যাপকতা বাড়ার একটি বড় কারণ। আমরা এই পর্যন্ত শিশু ধর্ষণের কোন উল্লেখযোগ্য বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখি নি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সায়মার ঘটনাটি আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এমন পুতুলের মত নিষ্পাপ হাজারো সায়মা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে আর কাম বাসনা চরিতার্থ করার সামগ্রী হচ্ছে।
আমরা অপরাধিদের কোন বিচার প্রক্রিয়ায় আনতে এতো গড়িমসি করি কেন? আমরা কি পরিনা এত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না যেয়ে তাৎক্ষনিক কোন শাস্তি দিয়ে এই বর্বর পুরুষগুলোকে শেষ করে দিতে। আদালতের কাঠগড়ায় ধর্ষিত নারী ও শিশুটি আসামী পক্ষের আইনজীবীদের জেরার মুখে আরেকবার ধর্ষণের শিকার হন। আসামিপক্ষের আইনজীবী তাকে এমন সব প্রশ্ন উপস্থাপন করেন যেন ধর্ষণ ঘটেছে ঐ নারী বা শিশুটির কারণে। ছোট্ট দুই মাসের শিশুটি কি বোঝে, ধর্ষণ কি? কতটা পাষন্ড আর বিকৃত হলে পুরুষটি পারে ঐ দুই মাসের শিশুটিকে ধর্ষণ করতে।
একটি পরিবারের যখন কন্যা শিশু বড় হতে থাকে, তখন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবারেরও রয়েছে। মা হিসেবে কন্যা শিশুটির সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তার আচরণগত কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা লক্ষ করতে হবে। শিশুরা বোঝে না তার অতি কাছের মানুষটিও তার সাথে কোন খারাপ আচরণ করতে পারে। ভালো আর মন্দ স্পর্শের ফারাক বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাই পরিবারকেই নিতে হবে।
আমাদের নারী এবং শিশুরা কার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় না? বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, চাচা, মামা, খালু, ফুফা, ভাই, অফিসের বস, সহকর্মী, প্রেমিক, শিক্ষক, বাস চালক, সৎ পিতা এবং সর্বোপরি জন্মদাতা পিতার হাতেও ধর্ষিত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এমন সমাজের কাছে আর কি চাওয়ার আছে। কলুষিত সমাজের এই রক্ষকরাই এখন ভক্ষক হয়ে উঠেছে। আর ধর্ষণের পর মেরে ফেলা যেন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠছে প্রতিটি ধর্ষকের কাছে।
আমি বুঝি না, আমাদের দেশের সরকার, বিবেকবান সমাজ, আইন রক্ষাকারী বাহিনী, আইন প্রণেতা- সবাই কী চোখ বন্ধ করে আছে। তারা কী ভাবছেন না যে এই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আরো কঠিন আইন প্রয়োগ করা দরকার।
আমি চাই সমাজ ধর্ষক মুক্ত হোক। প্রতিটি শিশু একটি সুন্দর শৈশব পার করুক। প্রতিটি নারী খুঁজে পাক তার নিরাপদ অবস্থান।
সারাবাংলা/আরএফ