Monday 07 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইইউবি’র গোলটেবিল: নারীর চাকরিজীবন সহজ না কঠিন?


৩০ আগস্ট ২০১৯ ১৪:৫২ | আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০১৯ ১৫:১১
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢ‌াকা: একজন নারীর জীবন সহজ না কঠিন সেই প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। তবে তার চাকরিজীবন সহজ না কঠিন আর কঠিন হলে কীভাবে সেটাকে সহজ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। সেই আলোচনার পালে আরেকটু হাওয়া দিতে রাজধানীর ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি আয়োজন করেছিল এক গোলটেবিল বৈঠকের।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) গবতলীতে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের মূল ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় ‌‌’নারীর চাকরিজীবন-সহজ/কঠিন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ফ্যাকাল্টি মেম্বার ও ভেরিটাস ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারিতা মিল্লাত।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমকর্মী, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সাংবাদিকদের আলোচনায় উঠে আসে নারীর চাকরিজীবনের নানা দিক। কর্মজীবী নারীরা জানান চাকরি করার প্রতিবন্ধকতার কথা, জানান নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে উঠে আসার কথা। আবার পুরুষরাও আলোচনার মাধ্যমে বাতলে দিলেন এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিক ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা বলেন, নারীর চাকরিজীবন শুধু নয়, গোটা জীবনই আসলে কঠিন। তার জীবন সহজ করার জন্য সমাজ বা পরিবার কতটুকু সাহায্য করছে সেটা দেখার বিষয়। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন সংসারের দায়িত্ব নারী-পুরুষ দুজনকেই ভাগ করে নিতে হবে। তা না হলে বিশেষ করে ৩০ বয়স বয়স পেরিয়ে গেলে নারী সংসার-সন্তান না ক্যারিয়ার এই দ্বন্দ্বে পড়ে যাবে। তার মনের এই সংশয় দূর করতে রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। যেন তার কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা, যাতায়াত ব্যবস্থার নিশ্চয়তা থাকে। যেন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বা ডে কেয়ারে রেখে তিনি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন।

নারীর চলার পথে বিভিন্ন ট্যাবুর কথা তুলে আনেন ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কো-অর্ডিনেটর ও সাহিত্যিক মুর্শিদা জামান। তিনি বলেন, ‘এদেশের নারীদের উচ্চতা সাধারণত পুরুষদের চেয়ে কম। কিন্তু কর্মক্ষেত্রগুলো সেই অনুযায়ী কোনো চেয়ার বা টেবিলের ব্যবস্থা করা হয় না। সাধারণত পুরুষদের গড়নের কথা ভেবেই এগুলোর নকশা করা হয়। ফলে নারীরা ব্যাক পেইনসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হন। এছাড়া যথাযথ টয়লেটের অভাব নারীকে ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকিতেও ফেলে দেয়।’

সময় টেলিভিশনের সাংবাদিক শতরূপা দত্ত বলেন, পারিপাশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই এখন কন্যা সন্তান আশা করছেন না। কারণ তারা ভয় পান যে, কন্যাকে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারবেন কি না। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তখন প্রশ্ন ওঠে যে, সমাজের অসংখ্য মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের দায়িত্ব কে নেবে?

শুধুমাত্র সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে একটা মেয়ে প্রয়োজন হলেও গভীর রাতে কর্মস্থল থেকে ফিরতে অস্বস্তি বোধ করে। এমনকি নারী সাংবাদিকরাও তার বাইরে নন। এই যে মানসিকতা, এর থেকে বের হতে হবে। কাজের প্রয়োজনে যে কেউ রাতে বাড়ি ফিরতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি নারী না পুরুষ না ভেবে তার কাজটা কী, সেটা মাথায় রাখতে হবে।

বিডিনিউজ২৪.কমের সহকারী ফিচার এডিটর ওমর শরীফ বলেন, যে কোনো ট্যাবু ভাঙ্গার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের সময় থেকেই ছেলে-মেয়ে অভিন্ন স্কুলে পড়া উচিত। তাহলে নারী-পুরুষের প্রতি যে একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ বা জড়তা কাজ করে তা কেটে যাবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজের মানুষেরা কিছু অভ্যাস রপ্ত করে।  সামাজিক সমস্যাগুলো তারা সেই অভ্যস্ততার মাপকাঠিতে নির্বাচন করে থাকে। সেই বিচারে একটি মেয়েকে বারবার বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়। যেসব ছেলে মেয়েরা অভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে বড় হয় তাদের কাছে অনেক সমস্যা কোনো সমস্যাই নয়। আবার যারা ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা বা অসুবিধার মধ্যে বড় হয়, তার প্রভাব কর্মক্ষেত্রে এসেও পড়ে। একজনের জীবনাচারণ-অভ্যাস অন্যজনের জীবন যাপনকে বাধা দেয়।’

যে কোনো মানুষের জীবনে শিক্ষকরাই সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেন উল্লেখ করে ডেইলি বাংলাদেশ.কমের মফস্বল সম্পাদক রনি রেজা বলেন, কিন্তু গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব শিক্ষক পাঠদান করে থাকেন তারা বিভিন্ন বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ পান না। ফলে পারিপাশ্বিক অনেক কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে তাদের অধিকাংশই মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকেন। সেই শিক্ষকরাই যখন শিক্ষাদান করেন তখন তাদের কাছ থেকে কতটুকুই বা আশা করা যায়?

উপায় হিসেবে রনি বলেন, ‘উপায় হলো তাদেরকে ওয়েল ট্রেইনড করা। তারাই পারবে এমন একটি কমিউনিটি তৈরি করে দিতে যারা সময় উপযোগী চিন্তা করতে পারবে। তাহলে নারী পুরুষ বৈষম্যের অন্য বিষয়গুলোও চেইনের মতো সামনে চলে আসবে। আসবে সমাধানগুলোও। গ্রাম পর্যায়ে একটি বড় সমস্যা হলো, মজুরিতে বৈষম্য। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারী সোচ্চার হলেই হবে না তার সহযোদ্ধা হিসেবে পুরুষকেও সোচ্চার হতে হবে।’

নারীর চাকরিজীবনকে সহজ করতে হলে সমাজের মানুষের চিন্তা আর সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করেন সারাবাংলা ডট নেটের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর সিরাজুম মুনিরা। তিনি বলেন, এই দুই পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে চিন্তার উন্নতি না ঘটলে নারী পদে পদে হেনস্তা হবে। সেটা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক তিনভাবেই।  আর সমাজকাঠামোর পরিবর্তন আনতে হলে আইন এবং আইনের যথাযোগ্য বাস্তবায়ন দরকার। পলিসিগত জায়গা থেকে এই পরিবর্তন আসতে হবে।

তিনি বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান চাইলেই তার নারীকর্মীকে রাতের শিফটে কাজ করার সুযোগ দিতে পারে না।   তার কারণ নারী কাজ শেষ করে যে নিরাপদে বা কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না করেই বাসায় ফিরতে পারবে সেই পরিবেশ এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আবার সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন চাকরি ছাড়ার প্রসঙ্গ আসে তখন নারীকেই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। কারণ সমাজ চাকরিহীন পুরুষকে মেনে নিতে এখনো রাজি নয়।’

ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক পরিচালক এবং সাবেক সচিব সৈয়দ মাহবুব হাসান বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মেয়েদের পাসের হার ছেলেদের সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। সরকারি চাকরিতে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্যও নেই। তারপরেও নারীদের চাকরি থেকে ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক। সে কারণে নিজেদের অধিকারের জন্য নারীদেরকেই আওয়াজ তুলতে হবে। কারণ কাগজে কলমে তাদের জন্য অনেক সুবিধার ব্যবস্থা করাই আছে। সেগুলো যেন বাস্তবায়িত হয় সেটাও নারীদের খেয়াল রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানের সভাপতি শারিতা মিল্লাত বলেন, ‘আমাদের সমাজের পুরুষকে মনে করা হয় বেশি শক্তিশালী কারণ তার কাছে টাকা আছে, ক্ষমতা আছে।  আবার অন্যদিকে প্রায় বিশবছর ধরে নারী সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। সেই বিষয়টিও আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক এবং মানসিক উন্নয়ন যতো বেশি ব্যালান্স হবে সমাজে নারী ততোবেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।  এই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য-প্রয়োজন নিজের চেষ্টা, সমাজের ও রাষ্ট্রের। সেইসঙ্গে পরিবার থেকেও ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না।’

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘একজন বাবা চাইলে মেয়েকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়টির ডিরেক্টর এফডিই ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফারজানা আলম তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলেন। তিনি জানান, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান সংখ্যা রাখার চেষ্টা করা হয়। কর্মজীবী মায়েদের জন্য ডে কেয়ার চালুর ব্যবস্থা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। সেইসঙ্গে তাদের নারী শিক্ষার্থীদের চাকরি করার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হবে বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

মতবিনিময়ে আরও বক্তব্য রাখেন ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির পাবলিক রিলেশন অফিসার রাশিদা স্বরলিপি, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মুশফিকা বিনতে কামাল। আলোচনা শেষে শুভেচ্ছা বিনিয়ম করেন ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মকবুল আহমেদ খান।

এই সময় তিনি বলেন, ‘ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য টিউশন ফি এর ওপর সর্ব্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে। কোনো ছাত্রী টাকার অভাবে পড়তে পারছে না এটা আমরা হতে দিতে চাই না।’

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার এ এফ এম গোলাম হোসেন।

কর্মক্ষেত্র কর্মজীবী নারী কর্মজীবী মা নারী-পুরুষ সহাবস্থান নারীর চাকরিজীবন