৪ নারীর হাতে নোবেল-বুকার এক অনন্য অনুপ্রেরণা
১৫ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১৪
শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের দাপট চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব পুরস্কার ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেগুলোতেও তাই পুরুষদের দাপট থাকে স্বাভাবিকভাবেই। তবে এ বছরের নোবেল ও ম্যান বুকার পুরস্কারে নারীরাও সেই দাপট কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছে। সাহিত্যে যেমন নোবেল পেয়েছেন পোলিশ নারী লেখক ওলগা তোকারচুক, তেমনি অর্থনীতিতেও দু’জন পুরুষের সঙ্গে হলেও নোবেলজয়ী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন আরেক নারী ফরাসি-আমেরিকান নাগরিক এস্থার দুফলো। আর এ বছর যে দু’জনকে দেওয়া হয়েছে ম্যান বুকার পুরস্কার, তারা দু’জনেই নারী— কানাডার মার্গারেট অ্যাটউড ও ব্রিটেনের বার্নারডাইন এভারইসটো।
একই বছরে দুই নারীর নোবেল ও দুই নারীর বুকারজয় সারাবিশ্বের লাখো নারীদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন নারীরা। তারা বলছেন, যথাযথ সুযোগ পেলে যে নারীরাও পুরুষের মতো করেই সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারেন, তারই চার নারী— ওলগা তোকারচুক, এস্থার দুফলো, মার্গারেট অ্যাটউড ও বার্নারডাইন এভারইসটো।
আজ মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) চলতি বছরের ম্যান বুকার প্রাইজ-২০১৯-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ ও ১৯৯২ সালের পর এবার তৃতীয়বারের মতো এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় দু’জনের হাতে, যাদের দু’জনই নারী। যৌথভাবে পুরস্কারটি পেয়েছেন কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক ৭৯ বছর বয়সী মার্গারেট অ্যাটউড ও ব্রিটিশ লেখক ৬০ বছর বয়সী বার্নারডাইন এভারইসটো।
দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল সিরিজের উপন্যাস দ্য টেস্টামেন্টস-এর জন্য মার্গারেট অ্যাটউড এবং ‘গার্ল, ওম্যান, আদার’ বইটির জন্য এভারইসটোকে বুকার পুরস্কার অর্জন করেন। এভারইসটো প্রথমবারের মতো ম্যান বুকার পুরস্কার পেলেও দ্বিতীয়বারের মতো এই পুরস্কার জিতেছেন অ্যাটউড। এর আগে ২০০০ সালে ‘ব্লাইন্ড অ্যাসাসিন’ বইয়ের জন্য বুকার জিতেছিলেন তিনি।
এর আগে, সোমবার (১৪ অক্টোবর) ঘোষণা করা হয় অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার। আরও দুই অর্থনীতিবিদের সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার অর্জন করেন ফরাসি-আমেরিকান নারী অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো। এস্থার দুফলো’র সঙ্গে নোবেলজয়ীর তালিকায় রয়েছেন তারই স্বামী ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিক অভিজিৎ বিনায়ক। অন্যজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমার।
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিন অর্থনীতিবিদকে এবারের নোবেল দেওয়া হয়। নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের মাত্র দুই দশকের গবেষণায় উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। গোটা বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে এবং অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।
এদিকে, গত ১০ অক্টোবর ঘোষণা করা হয় ২০১৮ ও ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। ২০১৯ সালের জন্য এ পুরস্কার পান অস্ট্রিয়ার লেখক পিটার হ্যান্ডকে, তবে গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পান পোল্যান্ডের সাহিত্যিক ওলগা তোকারচুক।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা ‘হ্যাশট্যাগ-মিটু’ ঝড় আছড়ে পড়েছিল রয়্যাল সুইডিশ একাডেমিতেও। একাডেমির সদস্যদের যৌন কেলেঙ্কারি ও অর্থনৈতিক অনিয়মের খবর সামনে চলে এলে ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল স্থগিত রাখা হয়। এবারে এসে সেই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেলজয়ের মাধ্যমে ১৫তম নারী হিসেবে নোবেল জিতলেন পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকারচুক। ৫৭ বছর বয়সী এই লেখক আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে বেশ পরিচিত মুখ না হলেও ২০১৮ সালে ‘ফ্লাইটস’ উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
একই বছরে চার জন নারীর বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত দুই পুরস্কার অর্জন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ম্যান বুকার প্রাইজের ৫০ বছরের ইতিহাসে এ নিয়ে ১৯ জন নারী সাহিত্যিক সম্মানিত এই পুরস্কারটি অর্জন করেন।
অন্যদিকে, নোবেলের ১১৮ বছরের ইতিহাসে ৫৩ জন নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এই সম্মান অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে নারী বিজ্ঞানী হিসেবে একমাত্র ম্যারি কুরি দু’বার এই সম্মানে ভূষিত হন। তিনি ১৯০৩ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে ও ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল সম্মান অর্জন করেন।
চার নারীর এই অর্জন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান কাবেরী গায়েন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি নারীর অগ্রগতির একটি স্বীকৃতি। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নারীরা যে কতদূর এগিয়ে যেতে পারে, সেটা প্রমাণিত হলো।’
তিনি বলেন, ‘মেধার দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। বিকাশের সুযোগ পেলে নারী ও পুরুষ উভয়ই অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। শিক্ষা, সাহিত্যসহ নানা ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের অনেক পরে শুরু করেও এগিয়ে এসেছেন বলেই আজ স্বীকৃতি পাচ্ছেন এবং অন্য নারীদের এগিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন।’ তাদের প্রতি নিজের অভিনন্দন জানান তিনি।
নোবেল বা ম্যান বুকার প্রাইজের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জনে নারী-পুরুষের সংখ্যার বিপুল পার্থক্য বিষয়ে কাবেরী গায়েন বলনে, ‘সংসার-সন্তান ইত্যাদি দায়িত্বের ভিড়ে নারীর এগিয়ে চলা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়। শুধুমাত্র লেখালেখি বা গবেষণায় মনোনিবেশ করা অনেকের জন্যই সম্ভব হয় না।’ যারা পেরেছেন তাদের প্রতিভা ও প্রতিজ্ঞা অনেক জোরালো বলেই পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কাবেরী গায়েন বলেন, সমাজ ও সংসারের দায়িত্ব নারী-পুরুষের মধ্যে সমভাবে বণ্টন হলে আরও অনেক নারী এগিয়ে আসার সুযোগ পেতেন।
২০১৯ সালে চার নারীর গুরত্বপূর্ণ সম্মাননা পাওয়া বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোমা দে বলেন, ‘সাহিত্য, গবেষণা, বিজ্ঞান, অর্থনীতির মতো বিষয়ে সবসময় পুরুষরাই ডমিনেট করে আসছে।’ এ বছর সাহিত্য ও অর্থনীতিতে চার নারীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলে, ‘এতে অনেক নারী সামনে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা পাবেন।’ এছাড়া একজন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারীর এই অগ্রযাত্রায় তিনি সন্তুষ্ট।
নোবেল ও ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জনে নারী ও পুরুষের সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীকে অনেক সংগ্রাম করে এগিয়ে আসতে হয়। একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারীর প্রতি সমাজের দ্বিগুণ প্রত্যাশা থাকে। সেইসব প্রত্যাশা ও দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে নারীর জন্য শিল্প-সাহিত্য বা অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইটা বলতে গেলে দ্বিগুণ।’
তারপরও বাধা অতিক্রম করে যেসব নারী এগিয়ে আসছেন, তারা অন্যদের জন্য সাফল্যের উৎসাহ তৈরি করছেন— বলেন সোমা দে।
এ বছর দু’জন নারীর নোবেলজয় ও দু’জন নারীর ম্যান বুকার পুরস্কার জয়ে ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ মুভমেন্টের কোনো তাৎপর্য আছে কি না— জানতে চাইলে কাবেরী গায়েন জানান, তিনি মনে করেন না এর সঙ্গে মিটু আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক আছে। কারণ যে নারীরা এ বছর সম্মানিত হলেন, তারা তাদের দীর্ঘদিনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই এই পুরস্কা অর্জন করেছেন বলে মনে করেন তিনি।
সোমা দে বলেন, ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ মুভিমেন্ট নারীর অগ্রগতির অন্যতম প্রতীক। এই আন্দোলনের ফলে নারীরা নানা অবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নোবেল পুরস্কার কিংবা ম্যান বুকার পুরস্কার ঘোষণায় এই আন্দোলনের কোনো তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করি না। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতেই তাদের আজকের এই অর্জন।