Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড: বঙ্গোপসাগরের এক অতল রাজ্য


১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:৩৮

আমিনুল ইসলাম মিঠু

বাংলাদেশের দক্ষিণে যেখানে সুন্দরবন শেষ,সেখান থেকেই শুরু সমুদ্র যাত্রা। এ যাত্রায় আরো ১৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলে নীল জলরাশির বিস্তীর্ণ রাজ্য- যার নাম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এর অর্থ যার কোনো তল নেই। বঙ্গোপসাগরের ১৭৩৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত এলাকা এই ‘সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড’।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলটি পৃথিবীর ১১তম গভীর সমুদ্রখাদ। যা সৃষ্টি হয়েছিল এক লাখ ২৫ হাজার বছর আগে। সুন্দরবনের দুবলার চরের দক্ষিণাঞ্চলে ক্রমশ এগিয়ে গেলে ১ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার দীর্ঘ উপত্যকাটি। তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর ও কচ্ছপের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র।

সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড একটি সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। এর নামকরণ করা হয়েছিল কারণ যেখান থেকে এ অঞ্চলের শুরু সেখানেই হঠাৎ পানির গভীরতা বেড়ে গেছে। আর তাই সমুদ্রের এই অঞ্চলে জরিপকাজে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশদের ধারণা ছিলো সমুদ্রের এই খাদের কোন তল নেই।

সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডকে স্থানীয় জেলেরা বলে ‘নাই বাম’। কারণ তারা সাগরে ফুট কিংবা মিটারে হিসাব না করে বাম, দশ বাম, বিশ বাম, আর ঐ জায়গা নাই বাম, মানে এই জায়গাটির কোন হিসেব নেই। যা অনেকটা প্রশান্তমহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো। বাংলায় বলে অতলস্পর্শী।
বঙ্গোপসাগরের অন্যতম মৎস ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি আছে বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রাণী। প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এলাকাটি বিরল জীববৈচিত্রের নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র, যা প্রস্তাবিত ব্লু -ইকোনমির জন্য হয়ে উঠতে পারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ওই এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এমন তথ্য দিচ্ছেন গবেষকরা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলটির নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি রহস্য। আঠারশো শতকের শেষ দিকে ডুবে যাওয়া একটি বৃটিশ যুদ্ধজাহাজের খোঁজে এসেছিল দেশটির আরো কয়েকটি জাহাজ। এর সঙ্গে ছিল একদল জরিপকারীও। কোনো নিশানা না পেয়েই এর নাম দেয় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গোপসাগরের অতল এই অঞ্চলে রয়েছে, ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, ইন্দো-প্যাসিফিক ডলফিন ও পাখনাহীন ইমপ্লাইস ডলফিনসহ বহু সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা এই গভীর খাদটি সমুদ্রের অন্যান্য অংশ থেকে গভীর বলে এটি নানা সামুদ্রিক প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল।
এসব সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো তিমি, পপাস ডলফিন, পৃথিবীর বৃহত্তম ইরাবতী ডলফিন, গোলাপি পিঠের কুঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন ও মসৃন পিঠের (পাখনাহীন) ইমপ্লাইস ডলফিন। এছাড়া এটি ডলফিন পরপাস ও তিমির প্রজননক্ষেত্রও। বিজ্ঞানীর জানাচ্ছেন এটিই পৃথিবীর একমাত্র সোয়াচ যেখানে এই তিন প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসঙ্গে দেখা যায়।

গত বছরের শেষভাগে বঙ্গোপসাগরের অতল এই নীল জলরাশিতে ১৩ জন অভিযাত্রী, গবেষক ও স্কুবা ডাইভাররা চষে বেড়িয়েছেন জীববৈচিত্রের সন্ধানে। ইসাবেলা ফাউন্ডেশন নামে একটি জরিপসংস্থার তত্ত্বাবধানে নৌবাহিনীর জাহাজ করতোয়ার সহযোগিতায় এ অভিযানটি পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার ছিলেন এই অভিযানের দলনেতা।
অভিযানে সাগরতলের এই মহিসোপানটিতে হ্যামারহেড শার্ক ও চার প্রজাতির ডলফিন সনাক্ত করা হয়েছে। মাছ ধরার ট্রলারে উঠে দেখা হয়েছে কি কি ধরনের মাছ ধরা পড়ছে। সোয়াচের আকাশে কোন ধরনের পাখি আছে তাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

সম্প্রতি ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার জানান, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাংলাদেশ যে সমুদ্র বিজয় করেছে,তার পরিমান এক লক্ষ কিলোমিটারের বেশি, যা আরেকটি বাংলাদেশের সমান। আর এই নতুন অঞ্চলটিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে এই গবেষণাটি খুব প্রয়োজনীয়।

বিজ্ঞাপন

কবির বিন আনোয়ার আরো জানান, সরকারের সব সংস্থার সমন্বয়ে ব্যাপক আকারে পরবর্তী গবেষণা শুরু করবে ইসাবেলা ফাউন্ডেশন। এবারের অভিযাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে নৌ-বাহিনীর ম্যাপিং। এতে সিসমিক সার্ভে ও তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ সম্পর্কে জানতেও অনুসন্ধান চালানো হবে। এছাড়া সোয়াচকে সংরক্ষণে আরো কি কি করা যায় তা নিয়েও কাজ করা হবে।

ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমান সরকার এসডিজির আওতায় শুধুমাত্র সাগরের উপরিভাগ নয়, সাগরতলের জীবন নিয়ে কাজ করছে। এখন প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকাগুলোকে শুধুমাত্র সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণাই নয়, সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। আর ব্লু -ইকোনমির সম্ভাবনার বিষয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও কোথায় কি আছে তা অনুসন্ধানও শুরু করা জরুরি মনে করা হচ্ছে। এজন্য প্রাথমিকভাবে মৎস্য ও জলজ প্রাণী, পাখিসহ সমুদ্রে যা আছে তা লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু করা হবে। ’

সাগর ও জীবনের সন্ধানে দলের প্রধান গবেষক হিসেবে গবেষণা কাজ শুরু করেছেন ড. আনিসুজ্জামান খান। তিনি জানান, সাগরতলের গভীর উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালির পানির রং পরিবর্তিত হয়ে নীল রঙ ধারন করেছে। সোয়াচের মূল্যবান জীববৈচিত্রের তথ্যভান্ডারও অবাক করেছে গবেষকদের।

ড. আনিসুজ্জামান খানের মতে, বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলে সীমিত পরিসরে জাহাজ চলাচল করায় ও ব্যাপকভাবে মাছও আহরণ না করার কারণে সোয়াচ এখনো বাংলাদেশের সাগরে অনাবিস্কৃত ইকোসিষ্টেম হিসেবে কাজ করছে। এবারের অনুসন্ধানে এমন কিছু প্রাণী পাওয়া গেছে, যেগুলো বিশ্বে বিলুপ্তির তালিকায় রয়েছে।

গবেষক আনিসুজ্জামান খান জানান, বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ইকোলজিকালি, জিওলজিকালি, হাইড্রলজিকালি এবং আন্তর্জাতিক বায়োডাইভারসিটি হটস্পটও। বিভিন্ন গবেষকদের তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯১৪ সালের ২৭ শে অক্টোবর এই এলাকাটিকে বাংলাদেশের প্রথম মেরিন প্রটেক্টেড অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর দেখে এই জরিপ করা হয়েছিল। কিন্তু পানির নিচে যে জীববৈচিত্র্য আছে ঝিনুক-শামুক, সাপ, সি-উইডস এসবের তথ্য জানতে পানির নিচের ডুবো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলোরও তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর সোয়াচের পানি খুবই পরিস্কার। এই পানির গুনগতমান শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার ও মালদ্বীপের চেয়েও উন্নত। আর তাই এটি এ অঞ্চলের জন্য ইকোলজিকাল ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে।

সোয়াচে ইসাবেলার অভিযানে প্রধান ডুবুরি হিসেবে কাজ করছেন ডুবুরি এস এম আতিক রহমান। তিনি পানির তলদেশ ঘুরে জেলি ফিস, সুইমিং ক্র্যাবসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক উদ্ভিদের চিত্র ধারণ করেন। তিনি জানালেন, সোয়াচের তলে ভিজিবিলিটিও খুবই স্বচ্ছ। সোয়াচের আরও অজানা তথ্য জানতে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই আরও বড় আকারের অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের।

সারাবাংলা/ এসবি

ডলফিন তিমি প্রজনন ক্ষেত্র সুন্দরবন হাঙ্গর ও কচ্ছপ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর