Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাথর খোদাই শিল্পে অনন্য ‘শুশুনিয়া’


১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:০৬

পলাশের সৌন্দর্যে আর রূপে মোহিত হতে চাইলে আমার স্মৃতিতে যে নামটি আসবে তা- ‘শুশুনিয়া’। যে সৌন্দর্য ৪৪২ মিটার (১৪৫০ ফুট) পাহাড়ের বিশালতা নিয়ে গড়ে উঠেছে। যার অবস্থান ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে। বাঁকুড়া জেলার উত্তর পশ্চিম অংশজুড়েই শুশুনিয়া। যা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রূপ নিয়েই বসে নেই। গর্ভে ধারণ করে আছে পাথর শিল্পের সৌন্দর্যকেও। শিল্পীর অসাধারণ দক্ষতায় আর পরিশ্রমে বিশাল মার্বেল পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের পাথরের সাহায্যে ফুটে উঠেছে অসাধারণ শিল্পকর্ম। যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে ‘Rock Climbing Centre’ হিসেবে শুশুনিয়া বিশেষভাবে পরিচিত। ছাতনার ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এর অবস্থিত। বাঁকুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এই ছাতনা।

পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো পাথর খোদাই, এই শুশুনিয়া’য় আছে বলে মনে করা হয়। একে ‘নরসিংহপাথর’ও বলা হয়। অনেকেই মনে করেন, সম্রাট নরসিংহ নিজ হাতে এই পাথর খোদাই করেছিলেন। রাজা চন্দ্রবর্মন এখানে একটি ফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। চতুর্থ শতকের কিছু খোদাই এখানে পাওয়া যায়। যার নাম ‘Pushkarana’।

সবুজে ঘেরা পাথরের অসাধারণ পাহাড় চোখকে বিমোহিত করে। এটি ‘Last green hill’ হিসেবে পরিচিত পাহাড়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানাকাজে ব্যবহৃত গাছপালার জন্যও বিশেষভাবে বিখ্যাত।

গন্দেশ্বরী নদী- যা শুশুনিয়া থেকে প্রবাহিত হয়, যাকে মনে করা হয় দক্ষিণেশ্বরের নদীর অবদান। যদিও সাধারণত এই নদীকে দেখলে ছোটখাট স্রোত মনে করা হয় তবে জ্যোৎস্নায় এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করার মতো। বাঁকুড়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা হিসেবে শুশুনিয়া পরিচিত। সেই সময়কার বিশেষ করে পাথর যুগের ইতিহাসের বিশাল সাক্ষ্য বহনকারী জায়গা হিসেবে ধরা হয় একে।

পশ্চিমবঙ্গের শুশুনিয়া হিল পাথর খোদাই শিল্পের জন্য সমাদৃত। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে করা হয় ওখানকার কাঁচামাল। কেননা খুব সহজে সেখানে পাথর পাওয়া যায়। এক একটি পাথর দৈর্ঘ্যে ২০- ২৫ ফুটের মতো। আবার খুব ছোট আকারের (যেমন এক ইঞ্চি) পাথরও আছে। এই পাথরগুলো খোদাই করে বিভিন্ন ধরণের কারুকার্য করা হয়।

পাথরে খোদাই করা অপরূপ শিল্পকর্ম

পাথরে খোদাই করা অপরূপ শিল্পকর্ম

বর্ধমান জেলার দেইনহাটে এখনও পাথর খোদাই করা হয়। জীবিকানির্বাহের তাগিদে সেখানকার অনেক মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। মেঝের টাইলস হিসেবে অনেকদিন ধরে এখানে পাথরের কাজ চলছে। এছাড়া হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীদের মূর্তি খোদাইয়ে এই পাথর ব্যবহার করেন শিল্পীরা। গত ৫০ বছর ধরে এমন ধরনের পেশাদারি কাজ চলছে। নানারকম নকশা, শিলালিপি আকৃতি বা শিলালিপির ন্যায় সূক্ষ্মাকৃতি নকশা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে পাথরের সহজলভ্যতা শিল্পীদের কাছে অনেকটা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শুশুনিয়ায় খ্যাতিসম্পন্ন, পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে এবং রাজ্য সরকারের সহায়তায় পাথর খোদাই শিল্প এখনো টিকে আছে। অনেক শিল্পী বিনামূল্যে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে বংশপরম্পরায় এখনো অনেক পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত।

নানারকম বিষয়বস্তু কিংবা ভাবনা শুশুনিয়ার পাথর খোদাই শিল্পকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। তবে প্রধানত, ধর্মীয় বিষয় সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। বিশাল সব মূর্তি পাথর দিয়ে খোদাই করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর মূর্তি। বর্তমানে অনেক প্রখ্যাত ইউরোপিয়ান শিল্পীদের ভাস্কর্য খুব ছোট আকৃতির পাথরে খোদাই করা হয়েছে।

পাথরে ফুটিয়ে তোলা দেব-দেবীর মূর্তি

পাথরে ফুটিয়ে তোলা দেব-দেবীর মূর্তি

বাঁকুড়ার প্রতিরুপ, টেরাকোটার বিষয়বস্তু, জীবদেহ, প্রতিমূর্তি ও মানুষের দেহাকৃতি এই শিল্পে অনন্য মাত্রা পায়। বিশেষ করে দূর্গা, শিব, কালী মূর্তি কখনও বড় আকারে আবার কখনও অত্যন্ত ছোট পরিসরে নিঁখুতভাবে তৈরি করা হয়। ২-৬ ইঞ্চির পাথরে অতিক্ষুদ্র সূক্ষ্মকাজের মাধ্যমে দূর্গা প্যানেল তৈরি করা হয়। যা অবাক করার মতোই ব্যাপার।

বর্তমানে অলঙ্কার হিসেবেও এই পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। লকেট, কানের দুল এবং আংটি হিসেবে এই পাথরে অনেক সূক্ষ্মাকৃতি কাজ ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। অতি ক্ষুদ্রাকৃতির এই সূক্ষ্ম কাজ মুগ্ধ করতে বাধ্য।

পাথর খোদাইয়ে অনেক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আছে। আবার শিল্পীরাও নিজেদের সুবিধামতো কিছু যন্ত্রপাতি গড়িয়ে নেন। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতির নাম আমাদের অজানা। তারপরও কিছু যন্ত্রের নাম জানার চেষ্টা করেছি।

 Karat-Hand saw
 Hammar
 Chisels
 Files
 Mechanized tools

শুশুনিয়ার শিল্পী নয়ন দত্ত পাথর দিয়ে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম রচনা করেছেন। খুবই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে নিপুঁনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একটি কারখানায় আমাদের নিয়ে যান। সেখানে দেখলাম, যে যার মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সবার কাজ আলাদা আলাদা ধরনের। একেকজন একেকরকম কাজে পারদর্শী।

শিল্পী নয়ন দত্ত ও লেখক

শিল্পী নয়ন দত্ত ও লেখক

কিছু ইউরোপিয়ান বা বিদেশী পোশাক নিপুন দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একই সঙ্গে দেহের গড়ন, চোখ, ঠোঁটের সূক্ষ্মতা এবং চেহারায় নমনীয়তা প্রকাশের কাজগুলো যে কাউকে তাক লাগিয়ে দেবেই।

বাদ্যযন্ত্র, বিদেশী সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই পাথর শিল্পের মাধ্যমেই। পাশাপাশি ভারতীয় হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর সৌন্দর্যও পাথর শিল্পেই উঠে এসেছে। শিল্পী নয়ন দত্তের স্ত্রীর হাতে গড়া ক্ষুদ্র আকারের শিব, কালী, গণেশও দেখলাম আমরা। প্রত্যেকটি মুখোশের দাম ২০ টাকা। এগুলো মূলত গলার লকেট এবং কানের দুল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তৈরি।

ক্ষুদ্র আকারের পাথরের গায়ে আঁকা শিল্পকর্ম

ক্ষুদ্র আকারের পাথরের গায়ে আঁকা শিল্পকর্ম

শুশুনিয়ার পাথর খোদাই শিল্পের অন্যতম আকর্ষণ হলো এই অতি ক্ষুদ্রাকৃতির দেব-দেবীর মুখোশ। এই অপটু হাতের তৈরি মুখোশই প্রমাণ করে শুশুনিয়া পাথর খোদাই শিল্পে কতটা সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ।

লেখক- শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর (শেষ বর্ষ), শিল্প ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

পাথর খোদাই পাথর খোদাই শিল্প শুশুনিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর