Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গেল বছরের প্রাপ্তি ও নতুন বছরের প্রত্যাশা


১ জানুয়ারি ২০২০ ২০:২০

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের লড়াইটি এখনো বিদ্যামান। রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে এখনো সার্বজনীনভাবে নারীর পদযাত্রা অতটা মসৃণ নয়। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, হত্যা, পারিবারিক নির্যাতনসহ নানাভাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন নারীরা। এসব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচারও সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না।

বেতন কাঠামো, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও পেশাগত জায়গা থেকে নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য অনেকটাই প্রকট। তারপরও প্রাপ্তির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বিভিন্ন সময়ে নারীদের নানা প্রাপ্তির আলোয় হেসে উঠেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে বাংলাদেশের জেতা ১৯টি সোনার মধ্যে ৬টি ব্যক্তিগতসহ মোট ১১টি সোনা জিতেছেন লাল-সবুজের মেয়েরা। এই প্রতিযোগিতায় আর্চারিতে তিনটি সোনা জিতেছেন চুয়াডাঙ্গার মেয়ে ইতি খাতুন।

বিজ্ঞাপন

নারীর জন্য কেমন ছিল ২০১৯ সাল? নতুন বছর তথা নতুন দশকের কাছে তাদের প্রত্যাশাই বা কী? জানতে চাওয়া হয়েছিল পেশাগতভাবে সফল কয়েকজন নারীর কাছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েদের ভালো ফলে পরও কর্মজীবনে টিকে থাকতে না পারার বিষয়ে কী করণীয়— সেটিও জানতে চাই তাদের কাছে। এসব বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কমিশনার কবিতা খানম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বিপিএম, বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ফারাহ কবির, বেলার নির্বাহী পরিচালক পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ক্রীড়াবিদ ইতি খাতুন।

বিজ্ঞাপন

কবিতা খানম

কমিশনার, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন

বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। বিচার বিভাগে কাজের দীর্ঘ ৩১ বছরের অভিজ্ঞতা তার। দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনোই নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা করে ভাবেননি অথবা ভাবার সুযোগও হয়নি।

নির্বাচন কমিশনের আইন সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান তিনি। এই কমিটির অধীনে অনেকগুলো কাজ হয়েছে, এর মধ্যে বেশকিছু আইন পাসও হয়েছে। এর বাইরে ২০১৯ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (The Representation of the People Order 1972) বাংলায় ভাষান্তর করে আইন হিসেবে প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের পথে। আইন হিসেবে পাস হয়ে এলে ২০১৯ সালের জন্য তা বড় একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়াও ১৯৭৬ সালের একটি সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশও (The Delimitation of Constituencies Ordinance 1976) বাংলায় ভাষান্তরের কাজ চলছে। এর আগের বছর নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারসহ ছোটখাটো কিছু আইন সংশোধনের কাজও হয়েছে আইন সংস্কার কমিটির মাধ্যমে।

কবিতা খানম বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আমার ওপর অর্পিত যে দায়িত্ব, তা যথাযথভাবে প্রতিপালনের চেষ্টা করেছি। তা করতে গিয়ে নারী হিসেবে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তেহয়েছে— এমন নয়। আবার নিজেও কখনো নারী হিসেবে আলাদা সুবিধা বা অনুকম্পা নেওয়ার কথা চিন্তাও করিনি।

আগামী বছর আরও বেশি নারী এগিয়ে আসবে, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ পদে আসীন হবেএমনটিই প্রত্যাশা কবিতা খানমের। আর এ প্রত্যাশা অর্জনে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

কবিতা খানম বলেন, ‘একজন নারীকে সফল হতে গেলে অনেক বেশি ‘স্ট্রাগল’ করতে হয়। এর কারণ, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ এখনো নারীর জন্য অনুকূল নয়। ফলে তারা অনেক ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শহর এলাকায় মেয়েরা কিছুটা এগিয়ে গেলেও গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েরা এখনো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক সময় শিক্ষিত অভিভাবকরাও মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তানকে তুলনামূলক বেশি সুযোগ দেন। মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার মেয়েদের সমান চোখে দেখে বা এগিয়ে আসার পথে ভূমিকা রাখে। মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে তাই একটি মেয়েকে অনেক বেশি মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়।’

কবিতা খানম মনে করেন, সংসার ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কাজের ভূমিকা নিয়ে এখনো দেশের মানুষের মধ্যে প্রাচীনপন্থি ধারণা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ এখনো মনে করে, সংসার ও সন্তান সামলানোর দায় শুধুই নারীর। একই পেশার দম্পতির মধ্যেও দেখা যায়, পুরুষ সঙ্গীটি ঘরের কাজ বা সন্তানের দেখাশোনার মতো দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী। স্ত্রীকেই ঘরে ফিরে সবকিছু দেখাশোনা করতে হয়। এমনকি স্বামীর বাড়ির আত্মীয়দেরও মেয়েটিকেই দেখতে হয়। কোনো স্বামী এখনো চিন্তাও করতে পারেন না যে স্ত্রীর বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবেন অথবা তাদের দেখাশোনা করবেন।’

বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলার জন্য সন্তানের নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা এবং তার বোঝা কেবল নারীর ওপরেই থাকাকে একটি বড় সমস্যা মনে করেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, সন্তান কার কাছে থাকবে, কীভাবে থাকবে এই পুরো চিন্তাটাই যেন মায়ের। তাই অনেক ক্ষেত্রেই পেশাজীবী একজন নারীকে সন্তানের জন্য ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়। যারা সন্তান রেখেও চাকরি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই সন্তানের নিরাপত্তার চিন্তায় কাজে ঠিকভাবে মনযোগও দিতে পারেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবারেও শিশুদের নির্যাতিত হওয়ার প্রবণতা, যা মায়েদের আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে।

নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কবিতা খানম বলেন, ‘আমার সন্তানকে দেখাশোনার জন্য মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ির সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু সবার জন্য সেই সহযোগিতা পাওয়ার বাস্তবতাও নেই। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনে আমরা একটি শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। প্রস্তাবটি আমারই ছিল। অন্যরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করে সে প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করেছেন। ফলে এখানে কর্মজীবী নারীরা বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছেন।’

এসব বিষয় নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা নারীসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম নারীর প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরতে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন কবিতা খানম। তিনি বলেন, মেয়েরা লেখাপড়ায় এগিয়ে এলেও পেশা, রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ফলে আমাদের সমাজ এখনো নারীবান্ধব নয়। দেশ ও সমাজকে নারীবান্ধব করার জন্য সুবিধাপ্রাপ্ত ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নারীদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে, একইভাবে পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেসব নারী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে ভূমিকা রাখছেন, তাদের নিরাপত্তা সমাজকেই দিতে হবে। পরিবারগুলোতে ছেলে ও মেয়ে সন্তানকে সমান চোখে দেখতে হবে। সমাজকে নারীবান্ধব করতে না পারলে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। একজন শিক্ষিত ও উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত নারীকে অন্যদের তুলে আনার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে।

অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার

উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৯ সালে তার প্রত্যাশা ছিল প্রাণপ্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। এখানেই কাটিয়েছেন জীবনের অনেক মূল্যবান সময়। স্বপ্ন ছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে শিক্ষার মানোন্নয়ন ভূমিকা পালন করবেন। সেই স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ হয়েছে বলে জানান ড. শিরীণ আখতার। তিনি বলেন, ‘একজন নারী হিসাবে এ পর্যন্ত আসা খুব সহজ ছিল না। এটা আমার বড় প্রাপ্তি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক কল্যাণে নিজেকে আত্ম নিয়োগ করতে চাই।’

নতুন বছরের প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্য বলেন, দেশের সব জেলা যেমন শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে, তেমনি দেশের সব জেলা শতভাগ শিক্ষিত মানুষের জেলা হবেএটিই চাই। আমার প্রত্যাশা, শিক্ষায় দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে। একজন মানুষও নিরক্ষর থাকবেন না।

সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন শিরীণ আখতার। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা অর্জন করে চাকরির আশায় বসে থাকলে চলবে না, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যেকোনো ধরনের কাজের সুযোগ থাকলে তা গ্রহণ করতে হবে, চ্যালেঞ্জ নিতে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। এককথায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।’ বিশেষ করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত করেন, সেটিই চান উপাচার্য শিরীণ।

আমেনা বেগম বিপিএম

অতিরিক্ত কমিশনার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান পুলিশ (সিএমপি)

বাংলাদেশ পুলিশের উচ্চপদে কর্মরত এই নারী সদস্য নিজেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দেখেন, নারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিয়ে কেবল কর্মদক্ষতার মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে চেয়েছেন সবসময়। সে লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত সফল বলা যায় আমেনা বেগমকে। পেশাগত দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)। বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি হিসেবে তিনি বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত নারী সদস্যদের জন্য একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর। তিনি চান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হোক।

আমেনা বেগম জানান, ২০১৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ককে আরও সংগঠিত করা। এর জন্য বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করা এবং পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছেন। এই নেটওয়ার্কের কাজ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল এবং অনেকখানিই সফল হয়েছেন সে লক্ষ্য অর্জনে।

নতুন বছরের প্রত্যাশা জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সবসময়ই চেয়েছি, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’এই কথাটিকে কাগজে বন্দি না রেখে বাস্তবে রূপ দিতে। জনগণ যেন সত্যিকার অর্থেই পুলিশকে ‘আমাদের পুলিশ’ বলতে পারে, এটিই চাওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবেন বলে জানান তিনি।

সংসার ও সন্তানের দেখাশোনা করতে গিয়ে নারীদের পেশাগত জীবন বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিশুদের জন্য মানসম্মত ডে-কেয়ার সেন্টার বা শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র থাকলে নারীদের জন্য পেশাগত দায়িত্ব পালনে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পুলিশে এমন সুবিধা রয়েছে কি নাজানতে চাইলে আমেনা বলেন, ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একটি ডে কেয়ার সেন্টার আছে। চট্টগ্রামেও এমন একটি ডে কেয়ার সেন্টার খোলার পরিকল্পনা চলছে। আমরা ধীরে দেশের প্রতিটি থানায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

একইসঙ্গে নারীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য পুরুষদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। আমেনা বেগম বলেন, সারাবিশ্বেই ‘মেন ফর উইমেন’ কথাটি প্রচলিত আছে। অর্থাৎ একজন নারীর এগিয়ে আসার জন্য পরিবার ও সমাজের পুরুষ সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে। আমি নিজে বাবা, ভাই, স্বামীর কাছে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। তবে সবাই সেটা পায় না। কিন্তু সব পরিবার থেকেই নারীকে এভাবে সহযোগিতা করা হলে তাদের সামনে এগিয়ে আসার পথটি মসৃণ হয়।

এগিয়ে আসার পথে শিক্ষা অর্জনের বাইরে নারীদের আর কী করার আছেএমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বেগম রোকেয়া নারীদের সমঅধিকারের কথা লিখেছেন সেই প্রায় একশ বছর আগে। এখন দেশের বড় বড় অনেক পদেই নারীদের উপস্থিতি রয়েছে। তবে দায়িত্বশীল পদগুলোতে নারীদের উপস্থিতি আরও বাড়াতে হবে। সে জন্য সবাইকেই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখাতে হবে। আর নারীদের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা এলেও সেগুলো সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, নিজেকেই তৈরি করতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য।

বছর

রুবানা হক

সভাপতি, বিজিএমইএ

তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি হিসেবে বিদায়ী বছরে রুবানা হকের লক্ষ্য ছিল এই সংগঠনের জন্যই নিজের সিংহভাগ সময় ব্যয় করা এবং বিজিএমইএ’র মাধ্যমে দেশের তৈরি পোশাক খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা। গেল বছরটিতে সে লক্ষ্য অর্জনের পথে সঠিক পথেই ছিলেন বলে মনে করেন রুবানা হক। নতুন বছরেও একই লক্ষ্য ধরে রেখে সেই সঠিক পথেই হাঁটতে চান বলে জানিয়েছেন তিনি।

রুবানা হক মনে করেন, দেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথ এখনো বেশ জটিল। তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় এই খাতের নারী ক্ষমতায়নের পরিস্থিতি তিনি বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করেন। তার মতে, নারী শ্রমিকদের ক্ষমতায়নে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে তাদের উন্নয়নের জন্য এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

রুবানা হক বলেন, যেসব নারীরা পেশাগত জায়গায় একটু এগিয়ে যান, তাদের অনেককেই শুনতে হয় তারা সেই পদের জন্য ততটা যোগ্য নন কিংবা নারী হিসেবে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন তারা। এমন বক্তব্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ প্রকৃতপক্ষে এ দেশে মেয়েদের দক্ষতা প্রমাণের জন্য দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। সবাই একদিন এই সত্যটি বুঝতে পারবেনএটিই প্রত্যাশা রুবানার।

ফারাহ কবীর

কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ

ব্যক্তিগতভাবে ২০১৯ সাল ছিল তার জন্য শোকের। কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততা আর কর্মোদ্যমকে পুঁজি করে সেই শোক কাটিয়ে উঠেছেন ফারাহ কবীর। তবে বছরজুড়ে একের পর ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পীড়িত করেছে তাকে। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘শব্দে জব্দে নারী’ শীর্ষক আয়োজনের মাধ্যমে বুঝতে পেরছেন, এ দেশের নারীরা সাংস্কৃতিকভাবে কত অবমাননার শিকার হন। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীদের সামাজিক এই অবমাননার অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

গেল বছরের পেশাগত বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে উৎরে গিয়েছেন ফারাহ কবীর। ২০২০-এ গত বছরের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলপত্র অনুযায়ী এগিয়ে যাবেন, সেই আশাবাদ জানান তিনি। লক্ষ্য— বাংলাদেশের নারীদের আর্থিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন ও বৈষম্য রোধে কাজ করা।

এ দেশের মেয়েদের এগিয়ে আসার জন্য লেখাপড়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। ফারাহ কবীর বলেন, তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সফল হতে চাইলে সার্টিফিকেটই সব নয়, মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন শেষে আরেক ধাপ এগিয়ে আসার জন্য মানসিক জোরের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে নারী যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকেই। নারীর মূল্যায়ন তুলে ধরার ক্ষেত্রে মিডিয়াকে ভূমিকা রাখতে হবে । সর্বোপরি মেয়েদের শেখাতে হবে— ‘তুমিও পারো। দেশের জন্য তোমার অনেক অবদান আছে।’ এভাবে নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর মাধ্যমেই তারা এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নির্বাহী পরিচালক, বেলা

২০১৯ সাল নারীর জন্য ভালো-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে বলে মনে করেন পরিবেশ অধিকারকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারীর মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। তারা নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পেরেছেন, দেখাতে পেরেছেন নিজস্ব স্বত্বা। আবার রাষ্ট্রও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক নারীবান্ধব রীতি ও চর্চা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কিন্তু এতে নারীর অবস্থানের খুব একটা উন্নতি হয়নি। বিশেষত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একজন মধ্যবিত্ত নারীর পদচারণা খেয়াল করলে সেটি স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। একজন মধ্যবিত্ত নারীর রাস্তায় চলাচল, তার বাসে ওঠা, নিরাপদে চলাচল নিশ্চিত করা যায়নি। তিনি নিজেই রাস্তাঘাটে পর্যবেক্ষণ করেন, একজন নারীকে কতটা সংগ্রাম করে গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়।

আবার যেকোনো নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে নারীদের একটি বড় অংশ। উল্টো নারী নির্যাতন মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। কমেনি ইভ টিজিংও। কিছু আইন ও নীতি তৈরি হলেও সেগুলো নারীর সপক্ষে প্রয়োগ করে একটি সাম্যভিত্তিক, সমতাভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও নির্যাতনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

একবছরেই সংকট উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন না সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি মনে করেন, নারী যত সংগঠিত হবে, তার বিরুদ্ধ শক্তিগুলো আরও দ্রুততার সঙ্গে আরও বেশি শক্তি নিয়ে সংগঠিত হবে। এক্ষেত্রে নারীর জন্য সুন্দর ও সমঅধিকারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে নারী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করে দেখিয়ে দিতে পারলে নারীর জন্য এগিয়ে চলা আরেকটু সহজ হবে।

বড় বড় পদে নারী থাকার মানেই নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, সেটি ধরে নেওয়ারও কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন রিজওয়ানা। তার মতে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে তাকে সমান অধিকার দিতে হবে। একইসঙ্গে নারীদের নিজেদেরও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে ও প্রতিকার চাইতে হবে। আর নারী নির্যাতন রুখতে অনেকেই মেয়েদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন। কিন্তু মেয়েদের এটা বুঝতে হবে, এটি ধৈর্যের বিষয় নয়, বিচার হতে হবে।

ইতি খাতুন

এসএ গেমসে সোনাজয়ী আর্চার

বছর শেষের সময়টা ছিল স্বপ্নের মতো— বলছিলেন সাউথ এশিয়ান গেমসে তিনটি সোনার পদক জয়ী আর্চার ইতি খাতুন। এসএ গেমসের সিলেকশনের সময় তিনি এক নম্বর অবস্থানে থাকলেও মাঝখানে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেকের বিরতি পড়েছিল খেলার মধ্যে। সারাবছর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এবারে অনুষ্ঠেয় জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। তখন থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় অবস্থানে চলে যান। তখন ভাবতে পারেননি, সাউথ এশিয়ান গেমসে এমন সাফল্য আসবে। মা-বাবাসহ দেশবাসীর মুখ উজ্জ্বল করতে পেরে তিনি দারুণ খুশি। এবার ২০২০ সালে জাপানে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিক গেমসে কোয়ালিফাই করতে চান।

তিনি নিজে ১২ বছর বয়সে বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে সফল হয়েছেন ক্রীড়াক্ষেত্রে। দৃঢ় মনোবলের এই কিশোরীর কাছেও জানতে চাই, বাংলাদেশের মেয়েদের এগিয়ে আসার জন্য কী করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। ইতি বলেন, মেয়ে হিসেবে ঘরে বসে থাকার চিন্তা করেননি কখনো। আমি বিশ্বাস করি, মেয়েরা চাইলে পারে না— এমন কোনো কাজ নেই। দারুণ প্রতিভার অধিকারী তারা। তবে নানা কারণে মেয়েরা যে পিছিয়ে পড়ে তার থেকে উত্তরণের জন্য মেয়েদের মনের জোরের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই ইতি শিখেছেন, প্রথমদিকে হেরে গেলেও হাল ছাড়া যাবে না। এসএ গেমসে শুরুর দিকে তিনি ভালো করতে পারছিলেন না। তখন মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন, তাকে পারতেই হবে। এভাবে ফিরে পান মনের জোর এবং ছিনিয়ে আনেন বিজয়। তাই তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, মেয়েদের মনের জোরই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আমেনা বেগম বিপিএম ইতি খাতুন কবিতা খানম নারী ক্ষমতায়ন ফারাহ কবীর রুবানা হক লিঙ্গ বৈষম্য শিরীণ আখতার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

বিজ্ঞাপন

ড. ইউনূসের ৬ মামলা বাতিল
২১ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর