নিজের কিশোরী স্বত্ত্বার কাছে মার্তার চিঠি
১২ জানুয়ারি ২০২০ ১০:০০
প্রিয় ১৪ বছরের মার্তা,
বাসটিতে ওঠো।
আমি জানি তোমার মনের মধ্যে এখন কী চলছে। বুঝতে পারছি তোমার অনুভূতি।
জানি তুমি কতটা ভীত… কতটা চিন্তিত… কীভাবে সবাই বলতো তুমি এটা পার না… তোমার এটা করা উচিৎ না… এসব নিয়ে ভেবো না।
এগুলোর কিছুই ভাবার প্রয়োজন নেই।
তুমি শুধু বাসটায় উঠে বস।
এখন তোমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এই বাসটাই তোমাকে তিনদিন পর রিও ডি জেনেরিও নিয়ে যাবে।
এই বাসটি ছেড়ে যাবে তোমার পরিবারকে, তোমার প্রিয় ডোয়েস রিকো শহরের ১১ হাজার মানুষকে ছেড়ে ছুটে চলবে এই বাস। সেই ধুলোবালিময় রাস্তা ছেড়ে, তোমার গ্রামের সবুজ ঘাসগুলোকে ছেড়ে বাসটা প্রথমে যাবে পাহাড়ের দিকে, তারপর আসবে একটা বড় শহরে।
এই বাস…. যা তোমাকে তোমার স্বপ্নের কাছে নিয়ে যাবে। তোমার মনের গভীরে আজন্ম লালিত একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন।
এবং এটা আরো অনেক গন্তব্যেই পৌঁছে দেবে তোমাকে।
এটা তোমাকে নিয়ে যাবে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে, বিশ্বকাপ, অলেম্পিকে। একসময় ফিফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হবে তুমি। যেখানে এখন তুমি আছ তখনো এই ভ্রমণ শুরু হয় নি।
এটা তোমাকে এমন একটা মাঠে নিয়ে যাবে যেখানে তুমি হাজার হাজার দর্শকের সামনে খেলবে।
পৌঁছে দেবে এমন এক স্থানে, যেখানে ফুটবল খেলার বিশেষ জার্সি এবং বুটগুলো শুধু তোমার জন্যই তৈরি হবে।
এটা তোমাকে সারা পৃথিবী ঘুরাবে, যেখানে তোমার পদার্পন মানে হবে বিশেষ কিছু। আমেরিকায় খেলাটা প্রতিষ্ঠা করায় তুমি অন্যতম মাধ্যম হবে। নতুন ক্লাব অরলান্ডো তৈরি হবে তোমাকে ঘিরে।
যে খেলায় আজ তোমার তেমন কোন অবস্থান নাই, সেখানে মেয়েদের জন্য খেলাটা প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম মাধ্যম হবে তুমি।
আমি জানি এখন তুমি এসবের কিছুই দেখতে পারছো না। এবং এটাও জানি এই বাসটায় উঠে বসার সিদ্বান্ত কতটা কঠিন ছিল তোমার জন্য। কিন্তু তুমি এখনো জানো না কি ঘটতে যাচ্ছে যখন তুমি রিও তে পা রাখবে। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস কর আমি যখন তোমাকে এগুলো বলছি তখন ইতোমধ্যে এসব পার করে এসেছি আমি। তাই আমি জানি, তুমি পারবে।
আজ পর্যন্ত আসা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছো তুমি। তোমার ধারণার থেকেও অনেক বেশি বেশি শক্তিশালী তুমি। তোমার বেড়ে ওঠার জন্য ছোট্ট ডোয়েস রিকো শহর ঠিকঠাক হলেও, তোমার প্রতিভা বিকাশের জন্য নয়। এখানে তুমি প্রতিদিন মানুষের তীর্যক দৃষ্টি আর কটু কথা শুনতে পাও, কারণ তুমি একটা মেয়ে। একটা মেয়ে, যে ফুটবল ভালবাসে। তুমি ছাড়া এই শহরে আর কোন মেয়েই ফুটবল খেলেনা।
… এবং যখনই তুমি ফুটবল খেলতে মাঠে আস এখানকার মানুষগুলো সেই খবর তোমার মাকে জানিয়ে দেয়।
তারা বলে, ‘তোমার মেয়ে স্বাভাবিক না’, ‘মেয়েরা ফুটবল খেললে খারাপ দেখায়’, ‘তুমি কেন তোমার মেয়েটাকে ফুটবল খেলতে দাও?’ ইত্যাদি নানা কথা আর প্রশ্ন।
তুমি ভাবো, মা হয়তো তোমার পাশে নেই। এক রকমভাবে দেখতে গেলে সে আসলে থেকেও নেই। তোমার বাবা তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর তোমাদের চারজনকে মানুষ করা পুরো দায়িত্ব তার ঘাড়ে এসে পড়ে। সেই ভোর ৫টায় উঠে ফসলের কাজ করতে যায়। সারাদিন ফসল বোনার জন্য জমিকে উপযুক্ত করে তোলে, ফসল বোনে তারপর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসে। বৃষ্টির দিনে সে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে চেষ্টা করে। যে পানির সাহায্যে ফসল ফলিয়ে সে তোমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। যখন ক্ষেতের কাজ থাকে না, তখন সে শহরের সিটি হলে চলে যায়। সারাদিন সেটা পরিষ্কার করে এবং কফি বিক্রি করে। তাই তুমি তাকে কখনোই তেমন একটা দেখতে পাও না। তোমার ম্যাচ দেখতে আসার বা তুমি কেমন খেল সেটা দেখার সময়ই পায়নি সে কখনো।
কিন্তু সে তোমার পাশেই আছে। কারণ, প্রতিবার- প্রতিটি বার শহরের লোকগুলি যখন তার কাছে এসে তোমার নামে বিচার দিয়েছে তোমার মা তাদের বলেছে, ‘তাকে তার মত থাকতে দাও।’
বিষয়টা হল মায়ের চোখ আসলে সেই শহরের বাকিদের মত নয়। সে কখনোই তোমাকে ভিন্ন চোখে দেখে নি। এমনকি তোমাকে মেয়েদের মত চলতে শেখানোর সময়ও তার ছিল না। আর তুমিও টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে নিজেও একদিন পেশাদার ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেছো। তুমি চাইতে তাড়াতাড়ি বড় হতে আর শহরের মাঠে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে।
কিন্তু সেই সুযোগ একমাত্র তখনই পাবে, যখন তারা তোমাকে তাদের সঙ্গে খেলায় নিত।
তাদের মাথায় সারাক্ষণ দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যেত। ‘ঠিক আছে তুমি খেলতে পারবে’ একথা বলার পাশাপাশি তারা শর্ত জুড়ে দিত। তোমাকে সেই প্রতিবেশী দলটার হয়ে খেলতে বলত যারা একদমই ভালো খেলতে পারে না।
এটা কোন ব্যপারই না। যেকোন দলের সঙ্গেই খেলতে পারবে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে তুমি। কারণ সঙ্গের ছেলেগুলো যতই খারাপ খেলুক না কেন, তুমি যতবারই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছ সেই দল জিতেছে প্রতিবার। তুমি দ্রুত ড্রিবল করার ক্ষমতায় প্রতিপক্ষের ছেড়ে দেয়া ছোট জায়গাটাকে তুমি কাজে লাগাবে। তোমার চিন্তার গতিও হবে দ্রুত।
তুমি বার বার তাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করবে।
প্রতিবার তাদের দেখাবে, মেয়ে হলেও তুমি কতটা ভালো একজন ফুটবল খেলোয়াড়।
তুমি যতগুলোই গোল কর না কেন সেই লোকদের কথা, তাদের বিচার, তাদের অপমানসূচক মজাগুলো থামবে না। এমনকি যখন তুমি স্থানীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নেবে, তখনো তোমার প্রতিদিনের চলার পথে তাদের তীক্ষ্ণ বাক্যবানে জর্জরিত হবে তুমি। কিন্তু তুমি ভালো করেই জান, তোমার প্রতিভা তা সেইসব লোকের ধারণা বদলে দেবার জন্য এখনো যথেষ্ট নয়।
আর সেই মুহূর্তগুলি, যখন তুমি ছেলেদের সঙ্গে একই লকার রুম ভাগ করতে হত তোমাকে। পাশের ছোট্ট বাথরুমে ছেলেদের গায়ের সাইজের জার্সির হাঁটু ছাড়ানো শর্টসের মধ্যে বড় আকারের টি-শার্ট গুঁজতে গুঁজতে কতটা একা লাগত তোমার।
কিছুটা সময়ের জন্য ফুটবল বড় একা হয়ে পড়ত।
কয়েক সপ্তাহ আগের সেই ট্যুরনামেন্টের কথা মনে আছে? দিয়োস রিকো থেকে তোমাদের দল প্রাদেশিক কাপের জন্য সান্তানা দো ইপানিমাতে খেলতে আসে। আরও আগেই এই টুর্নামেন্টটা খেলার দরকার ছিল তোমার। তোমার যে স্কিল ছিল, তাঁতে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেতে পারতে তুমি।
কিন্তু এসবের কোন কিছুই হল না।
কারণ, এবছর অন্য এক দলের কোচ বলেন, তুমি খেললে তারা টুর্নামেন্ট খেলবে না। তার কাছ, ‘এটা কোনভাবেই মেয়েদের জায়গা নয়।’
তুমি ভাবলে কর্তৃপক্ষ বা তোমার দল তোমার পক্ষে কথা বলবে। কিন্তু তুমি ভাল করেই জানতে এমনটা কখনো হয়না, না কখনো হয়েছে। তাই তারা তোমাকেই টুর্নামেন্ট থেকে বাদ দেয়। তারা বলে মেয়েটাকে বের করে দাও, যেন ছেলেরা এখানে খেলতে পারে।
সেই চোখের জলের কথা এখনও কী মনে পড়ে তোমার?
আমি জানি এগুলোর আর কোন মূল্য নাই তোমার কাছে। তবুও প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রশ্ন করে যাও তুমি, ‘কেন ঈশ্বর তোমাকে এত প্রতিভা দিল যদি খেলতেই না পারো?’
তোমার এই রাগ ব্যবহার কর, শক্তি এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে।
ব্যবহার কর লড়াই করতে। নিজেকে প্রমাণেরর জন্য সারাক্ষণ লড়ে যাও, তাদের সবার সঙ্গে একাই লড়ে যাও যারা বলে ফুটবল মাঠে মেয়েদের কোন স্থান নেই।
লড়ে যাও সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, তোমাকে না দেয়া সব সমর্থনের বিরুদ্ধে। সে সব ছেলেরা যারা তোমাকে খেলতে নেয়নি, সেসব লোকেরা, যারা বলে তুমি পারবে না, সকলের বিরুদ্ধে তুমি লড়াই কর।
ততক্ষণ লড়াই কর, যতক্ষন না তুমি গ্রহণযোগ্যতা পাও।
কারণ, আমরা দু’জনই জানি যেকোন একজনের সমর্থন আর গ্রহনযোগ্যতাই বদলে দেবে এই পরিস্থিতি। আর এ কারণেই আজ তুমি এখানে অপেক্ষা করছো, দাঁড়িয়ে আছ এই বাসটার সামনে, তাই না? তোমার সঙ্গে আছেন মার্কোস নামের একজন ব্যক্তি যিনি তোমার কাজিন রবার্তোর বন্ধু। তিনি রিও থেকে এসেছেন। তোমাদের সঙ্গে আরও আছে তোমার বন্ধু লুইস ইউকলাইডস। মার্কোসের কিছু জানাশোনা লোক আছে। তারাই তোমার জন্য রিওতে যাবার ব্যবস্থা করেছে যেন তুমি ‘ভাস্কো দা গামা’ মেয়েদের দলের হয়ে ট্রায়াল দিতে পারো।
সেখানে তোমার খেলার একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। সেটা তেমন কোন ঘটনা হয়ত না, তবুও বিশেষ কিছু। তোমার নিজের শহর দায়োস রিকোসে পড়ে থাকার চেয়ে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে তোমার জীবনে।
রবার্তোই মার্কোসকে বলেছিল তোমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে। সেই তোমার রিও যাবার বাসের টিকেটের টাকা দিয়েছে। আমার মনে হয় রবার্তো বুঝতে পেরেছিল যে, দায়োস রিকোস থেকে বের হতে পারলে তুমি বড় কিছু হতে পারবে। এবং সেটা তুমিও জানো।
ফুটবলই সেই রাস্তা যা তোমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করবে, তোমার সফাল্যের একমাত্র উপায়, তোমার সব আনন্দের উৎস। এটা একদমই সহজ হবে না, কিন্তু বিশ্বাস কর, ধীরে ধীরে সবকিছুই বদলে যাবে।
কিন্তু রিওতে পৌঁছে তোমাকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তুমি মার্কোসের ফ্ল্যাটে তার পরিবারের সঙ্গে থাকবে, আর অপেক্ষা করতে থাকবে কবে তোমাকে তারা ট্রায়ালের জন্য ডাকবে। তুমি তাদের বসার ঘরের সোফায় ঘুমাবে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই তোমার চোখ যাবে নতুন কেনা ফুটবল বুট জোড়ার দিকে যা সেই ঘরের এক কোনে রাখা। সেও তোমার মতই অপেক্ষায় রয়েছে।
এখানে ট্রায়াল দেয়ার জন্যই নতুন বুটজোড়া কিনে এনেছো তুমি। প্রতিবার বুটজোড়ার দিকে তাকালে পুরনো বুটজোড়ার কথা মনে পড়বে তোমার যা তোমাকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
তোমার সেই বুট জোড়া।
দামী কোন ব্র্যান্ডের না, তোমার নিজস্ব পায়ের সাইজ থেকে বড়, ভেতরে কাগজ গুঁজে পরতে হতো যেন তোমার পায়ে শক্তভাবে লেগে থাকে।
সেটাই দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ফুটবল বুট।
কিন্তু এই জায়গায় এসে তোমাকে বেশ পেশাদারীত্ব দেখাতে হবে। রাখতে হবে নিজের উপর বিশ্বাস, যার অপেক্ষায় রয়েছে নতুন কেনা বুটজোড়াও।
একদিন একদিন করে যাবে, কোন ফোন আসবে না।
কেন এখানে এসেছো ভেবে অবাক হবে তুমি। সামান্য ট্রায়ালেরও কোন ঠিক নেই। আছে শুধুই আশা।
নিজেকে একটু শান্ত কর, আরেকটু ধৈর্য ধর। আর কিছুদিনের মধ্যেও আসবে না কাঙ্ক্ষিত সেই ফোন। কিন্তু একদিন ঠিকই ফোনটা বেজে উঠবে।
ফোনটা তোমাকে বলবে, ‘আজই ট্রায়াল।’
এবং সঙ্গে সঙ্গেই তুমি তোমার বুটজোড়া নিয়ে মাঠের দিকে চলে যাবে। মাঠে তুমি এমন কিছু দেখবে যা আগে কখনোই দেখ নি।
একটা মাঠ, যেখানে শুধুই মেয়েরা ফুটবল খেলছে।
একটু খেলতে দেয়ার জন্য কোন লড়াই নয়, না কেউ তীর্যকভাবে দেখছে বা কিছু বলছে। মাঠে তারা শুধুই খেলছে।
অবিশ্বাস্য লাগবে তোমার কাছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লজ্জা ঘিরে ধরবে তোমাকে। যেখানে ট্রায়াল দেবে সেখানে সিনিয়র টিম থাকবে, থাকবে অনূর্ধ্ব-১৯ দলও। অবশেষে তুমিও ফুটবল খেলবে এমন দলে যেখানেই সবাই মেয়ে। তবুও তোমার ভিতর কিছুটা অদ্ভুত অনুভূতি হবে। তুমি ভাববে সবাই তোমার থেকে বড়, সবাই বড় বড় শহর থেকে এসেছে, স্মার্ট এবং তাদের আছে চমৎকার পেশাদারীত্ব।
আর তুমি?
লিকলেকে শরীরের ছোট্ট এক মেয়ে, যে এক দরিদ্র শহর থেকে এসেছে। যার মুখের ভাষায় গ্রাম্য টান। তারা তোমাকে ‘বিচো দো মাতো’ বলে ডাকবে। যার মানে নীচু শ্রেণীর মেয়ে।
তুমি কথা বলতে ভয় পাবে, মুখ খুললেই তারা তোমার বাচনভঙ্গি নিয়ে মজা করবে, সেই ভয় পাবে। সুতরাং তুমি সেটাই করবে যা সবসময় করে আসছিলে।
তোমার খেলাই তোমার হয়ে কথা বলবে, নিজেকে প্রকাশ করবে তুমি ফুটবল মাঠে।
ফুটবলে সজোরে লাথি মেরে ফুটবলকে প্রথমবারের মতো ছোঁবে তুমি। সেই বল ফেরাতে যেয়ে গোলকিপার পিছনদিকে পড়ে যাবে। জাল ছুঁয়ে গোল হবে সেই বল।
মাঠে থাকা সবগুলো মাথা তোমার দিকে ঘুরে যাবে। কিন্তু এদের চাহনী তোমার শহরের লোকদের চাহনীর মত না। ‘মেয়ে হয়ে ফুটবল মাঠে কেন’- প্রশ্নের চাহনী এটা নয়।
সবার চোখে একটাই প্রশ্ন, ‘তুমি কি সত্যি নাকি চোখের ভ্রম?’
কিছুটা সময় পর অবশেষে কেউ একজন কথা বলবে। তিনি হলেন, হেলেনা প্যাচেসো। নারী ফুটবল দলের কো-অর্ডিনেটর। তিনি বলবেন, ‘মেয়েটাকে আমাদের দলে চাই।’
‘আমাদের সাথে!!’
হ্যা, এটিই বলেছে। তুমি এ মাঠেই থাকবে, বাকি সবার সঙ্গে। খেলাতির একটি অংশ হয়ে।
কিন্তু এটা মাত্র শুরু। তুমি আরও বড় কিছুর অংশ হবে। তুমি এই খেলায় মেয়েদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে। মেয়েদের জায়গা মাঠে নয়, শুনে যে মেয়েরা মাঠে আসতে চাইবে না, তুমি তাদের পথ দেখাবে। আর তাদের বলে যাবে এই ৯০ গজের মাঠটা ঠিক তারও, যতটা একটা ছেলের।
মেয়েদের জন্য এই খেলার পরিসর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তোমার পরিচিতি, সম্মান আর অবস্থান। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন মেয়েদের জন্যও জাতীয় লীগ শুরু করবে। এবং প্রথম লীগেই তুমি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড় হবে।
রাস্তাটা বড় কঠিন। টাকা? সেটা অবশ্য খুব বেশি আসবে না। মাসে মাসে হাত খরচ চলার মত কিছু হাতে আসবে, যা তুমি আবার মায়ের জন্য পাঠিয়ে দেবে। আবারও মার্কোস আর তার পরিবারের সঙ্গে থাকা শুরু করবে তুমি। এর বেশি সামর্থ্য ছিল না তোমার তখন।
তুমি একজন পেশাদার ফুটবলার।
আমি চাই তুমি সবসময় এটা মাথায় রাখো। কারণ, এই একটা জিনিসই তোমার জন্য গুতুত্বপূর্ণ।
বিষয়টা কখনোই ভুললে চলবে না তোমার। বিশেষ করে এক-দেড় বছর পর যখন তোমার কানে কিছু কথা আসবে। শুনতে পাবে, ক্লাব প্রেসিডেন্ট মেয়েদের দলটা বন্ধ করে দিচ্ছে। এটিকে অন্য সব বাঁধার মতই নতুন এক বাঁধা মনে করবে। তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবেই তুমি ফুটসাল খেলা শুরু করবে। এভাবে সপ্তাহ শেষে অল্প কিছু টাকা পাবে। নাহয়, তোমাকে আবারও দায়োস রিকোসে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু তুমি তা কোনভাবেই পার না, অন্তত এখনই না।
কারণ, তোমাকে কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য ডাকা হবে। আবার বেলা হরিজেন্তের অন্য একটা ক্লাবও তোমার প্রতি আগ্রহী হয়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
তুমি ২০০২ সালে ফিফা আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে কানাডা যাবে। পরের বছরই আমেরিকায় ফিফা বিশ্বকাপ খেলতে যাবে।
এবং তারপরই আশ্চর্য কিছু ঘটবে।
সুইডেনের একটি সংবাদ চ্যানেল ব্রাজিলের রোবিনহোকে নিয়ে একটি ফিচার করবে। সে তখন সান্তোসের হয়ে অসাধারণ খেলছে। সেখানে তারা মেয়েদের ফুটবলের জন্যও কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখবে।
সেই অনুষ্ঠানে বলা হবে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলা এক তরুন উদীয়মান নারী খেলোয়াড়ের কথা যার নাম মার্তা ভিয়েরা দা সিলভা…
বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি ভাবার প্রয়োজন মনে করনি তুমি। কারণ, এটা সুইডেনে দেখানো হবে। এখানে কেউ অত জানবে না।
কিন্তু তারপর তোমাকে সুইডেন থেকে ফোন করা হবে…
তুমি হ্যালো বলার পর ওপাশ থেকে বলবে, ‘আমি ওডিন বারবোসা। আমি ইউমিয়া আই কে ক্লাবের প্রেসিডেন্টের হয়ে কাজ করি। আর আমরা তোমাকে আমাদের ক্লাবে আনতে চাই।’
ওডিন তোমার সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলবে। তুমি ভাববে কেউ তোমার সঙ্গে মজা করছে হয়ত। কারণ, তোমার মনে হবে কেনই বা কেউ একজন তোমাকে সুইডেন থেকে ফোন করবে? আর পর্তুগিজ ভাষায়ই বা কেন কথা বলবে? এমনকি তুমি এটাও জানো না সুইডেন দেশটা ম্যাপের কোন অংশে রয়েছে। তাদের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও দেশটা সম্পর্কে কিছুই জানো না। সুতরাং সে লোকটা যেই হোক বা সে নিজেকে যে পরিচয়ই দিক না কেন, তুমি বলে বসবে,
ফা… অফ।
আমাকে একটু সাহায্য কর, তুমি ভালো করে উত্তর দিতে চেষ্টা কর। এটুকু কী তুমি আমার জন্য করবে? আর ওডিনের কথা ভালোভাবে শুনে দেখ। এই ফোন কলটা তোমার সঙ্গে হওয়া কোন মজা না। তুমি এটা আর কিছুদিন পর জানবে, যখন সেই সংবাদ চ্যানেল যারা তোমার কথা তাদের অনুষ্ঠানে বলেছিল তারা তোমাকে বলবে ওডিন বলে সত্যিই কেউ আছে। আর ক্লাব ইউমিয়া আই.কে ও বাস্তব।
আমি জানি, যদি আমি তোমাকে বলি একদম আলাদা এই দেশটা তোমার দ্বিতীয় বাড়ি হতে যাচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। যখন তুমি প্লেন থেকে নামবে তখনো এটা অনুভব করতে পারবে না। তখন চারদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তুমি ভাববে এর মধ্যে ফুটবলই বা খেলা হবে কেমন করে।
তুমি ভাববে ‘আমি এখানে করছিটা কি?’
তুমি যেটা করছো, তা হল তোমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্তটা নিতে যাচ্ছো। মেয়েদের খেলাটা এখানে অন্যরকম। খেলাটাকে এখানে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়। সুইডেনই তোমাকে একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করবে। সুইডেন না গেলে তুমি কখনোই সেই খেলোয়াড় হতে পারতে না, যা তুমি আজ হয়েছো।
এবং এটাই সে জায়গা যেখান থেকে তোমার সুখের দিন শুরু।
মনে আছে আমি তোমাকে বলেছি তুমি বিশেষ কিছুর অংশ হতে যাচ্ছো। সুইডেনে এসে তুমি নিজের ব্রাজিলিয়ান সুবাস পুরো ফুটবল মাঠে ছড়িয়ে দিতে পারবে। এখানে খেলাটা ব্রাজিলের মত নয়। আগের চেয়ে একটু বেশি টাইট, একটু বেশি কঠিন, তবে নিয়ম কানুন খুব সুন্দর।
মার্তা তাদের শিখিয়ে দাও কিভাবে কঠিন সময়ে প্ল্যান ইম্প্রোভাইজ (নতুন পরিকল্পনা) করতে হয়, মাঠে কীভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়।
পাশাপাশি কিছুটা ইতিহাসও তৈরি কর।
একটা উয়েফা ওম্যান্স কাপ, সাতটা লীগ শিরোপা… ৮৭ মিনিটে গোল করে জেতা সুইডিশ কাপ… তারপর আরও একটা সুইডিশ কাপ জেতা।
এভাবেই তুমি ছুটতে থাকো পুরো পৃথিবীজুড়ে। আর খেলতে থাকো ফুটবল।
যেভাবে মেয়েদের এই খেলাটা বদলে গেল, তা অসাধারণ বললে কম বলা হবে। কিন্তু তুমি সবসময়ই জেনে রাখবে যে মেয়েদের জন্য এটা সবসময়ই অনেক কঠিন। অনেক লীগ আর ক্লাব শুরু হয়ে আবার বন্ধ হয়ে যায়।
এবং তুমি সাথে এটাও উপলব্ধি করবে যে প্রতিটা মেয়েরই কিছু গল্প আছে। সেটা ব্রাজিলে হোক বা সুইডেনে বা যুক্তরাষ্ট্রের অরলান্ডো প্রাইডে।
সবার গল্পটাই কঠিন বাস্তবের… সবারই ফুটবলের প্রতি গভীর প্রেম যা তাদের জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তুমি যতগুলো ক্লাবেই খেলবে সবখানেই ভাষার বাঁধা তোমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মিয়া হাম, এবি ওয়াম্ব্যাচ, ক্রিশ্চিয়ান সিনক্লেয়ার দের মতো খেলোয়াড়দের পক্ষে-বিপক্ষে খেলতে গিয়ে দেখবে তোমার কোন শব্দের প্রয়োজন নেই। সবার মধ্যেই একই ক্ষুধা, একই ইচ্ছাশক্তি আর একই সংগ্রাম খুঁজে পাবে মাঠে।
এটা তখনই তৈরি হয়, যখন তোমাকে বছরের পর বছর বলা হয়, ‘তুমি এটা করতে পারবে না’ বা ‘তোমার জন্য এ জায়গা নয়।’
যখন তুমি সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়বে, সবসময় নিজের সম্মান আর গ্রহযোগ্যতার জন্য যুদ্ধ করবে, তখন মাঠে তোমার সেই স্পৃহা ফুটে উঠবেই।
যখন তোমার নিজেকে বড্ড একা মনে হত সে সময়টাকে ভুলবে না আর আমার কথাটা শোন। পৃথিবীজুড়ে আরও অনেক মেয়েই আছে, যাদের একই রকম সংগ্রামের গল্প আছে। যারা রাস্তায় বের হলে লোকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখে, কেন বের হয়েছে সেই প্রশ্ন করে আবার মেয়ে হওয়ার অপরাধে টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়।
কিন্তু এই নিজেকে প্রচন্ড একা মনে হওয়া এই সময়গুলো বেশিদিন থাকবে না। এবং খুব বেশিদিনও নেই যখন তোমার মত বাকিরাও সবাই মিলে একসঙ্গে একই মাঠে খেলবে।
আমি এখন জানি ১৪ বছরের তুমি যে কোনভাবে দায়োস রিকোস থেকে বের হতে চাও। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, তোমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা আনন্দের মুহূর্ত কিন্তু সেখানেই তৈরি হবে। সারা দুনিয়া ঘুরলেও দায়োস রিকোস তোমার মনে আলাদা জায়গায় রয়ে যাবে।
তুমি ঘরে ফিরে আসবে। সেটা হবে ২০০৬ সাল এবং সেবার তুমি তোমার প্রথম ফিফা বর্ষসেরা নারী খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি জিতবে। আমাকে ঠিকই শুনেছো, সেবারই প্রথমবারের মতো এই শিরোপা জিতবে তুমি (সামনে আরও কয়েকবার এই শিরোপা জিতবে)। তোমাকে স্বাগত জানাতে ভীড় উপচে পড়বে। সবাই তাদের ঘরের নায়ককে এক নজরে দেখতে চাইবে এবং তারা তোমাকে খোলা ট্রাকে করে পুরো শহর ঘুরাবে।
তোমাকে আর কেউই অবজ্ঞার চোখে দেখবে না। যে মানুষগুলো বলতো তুমি পাগল, তুমি খেলতে পারবে না, তোমার খেলা উচিৎ না, তারাই তখন তোমার উদ্দেশ্যে হাত তালি দিবে।
তুমি একজন নারী এবং তুমি একজন ফুটবলার।
আমি জানি এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই বাসের দিকে তাকিয়ে এগুলো অনেক দূরের অলীক কল্পনা মনে হবে। কিন্তু এর সবই সত্যি। আর তার জন্য তোমার প্রথম পদক্ষেপ অপেক্ষা করছে এখান থেকে ২০০০ কি.মি. দূরে।
নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো, বিশ্বাস রাখো নিজের সহজাত প্রবৃত্তিতে। দেখে নিও তুমি ঠিকই খুঁজে পাবে, কেন ঈশ্বর তোমাকে এ প্রতিভা দিয়েছেন।
তোমার আর নিজেকে এই প্রশ্ন করতে হবে না, না অন্য কেউ তোমাকে কিছু বলার সাহস করবে।
তুমি শুধু এই বাসটায় উঠে বস।
-মার্তা
লেখাটি দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউন ডট কমে প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদক রেহমান মোস্তাফিজ।
পেশাদার ফুটবলার ফিফা বর্ষসেরা নারী খেলোয়াড় ফুটবলার মার্তা ব্রাজিল ব্রাজিল জাতীয় নারী ফুটবল দল ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার মার্তা মার্তা