জাহানারা ইমাম: আমৃত্যু সংগ্রামী এক মহাপ্রাণ
২ মে ২০২০ ১৫:৫৭
‘রুমির সাথে কদিন ধরে খুব তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মত বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে বাবা মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলে এক দিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ঐ যে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমী আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে, সে আমার কাছ থেকে মত আদায় করেই ছাড়বে।
—-আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়ত যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?
আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করলাম বললাম, না তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা তুই যুদ্ধেই যা।’
ঘটনাটি এক মুক্তিযোদ্ধা জননীর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের শৈল্পিক সৃষ্টি। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ডায়েরি থেকে নেয়া। একজন শহীদ রুমীর মা কিভাবে লক্ষ কোটি মানুষের জননীতে পরিণত হতে পারেন তার বিরল সংগ্রামের দৃষ্টান্ত, মহান আদর্শ ও চেতনার নাম জাহানারা ইমাম যিনি‘শহীদ জননী’হিসেবেও আমাদের কাছে পরিচিত।
আমৃত্যু সংগ্রামী জাহানারা ইমামের জন্ম ৩ মে ১৯২৯। মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে। বাবা সৈয়দ আব্দুল আলী, পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা আলী, গৃহিনী। বাবা আধুনিক ও উদারমনা ছিলেন। মা অত্যন্ত সাহসী, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমতি ও প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে জাহানারা ইমামের বেড়ে ওঠা। এই রক্ষণশীল পরিবেশে মেয়েদের বাংলা লেখাপড়া করা ছিল বেশ কঠিন। কিন্তু বিরুদ্ধ পরিবেশকে জয় করার জন্য এক অদম্য সাহস ছিল জাহানারা ইমামের। বাল্যকাল থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর তীব্র ঘৃণা, আর মানুষের প্রতি ছিল অসীম ভালবাসা। উদারমনা বাবার হাত ধরেই তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু। বই পড়া ছিল তাঁর বাবার নেশা। তিনি নিজে যেমন বই পড়তেন তেমনি সন্তানদেরও উদ্ধুদ্ধ করতেন।
জাহানারা ইমাম নিজেই বলেছেন, ‘বাবা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন লেখকের বই, বড় মানুষের জীবনী ইত্যাদি পড়তে অনুপ্রাণিত করতেন এবং সবসময় সাদাসিধে জীবন ও উন্নত চিন্তা করার কথা বলতেন।’ বাবার এই শিক্ষা জাহানারা ইমাম সারা জীবন লালন করেছেন। উন্নত সংস্কৃতি ও রুচিশীল সাদামাটা জীবন-যাপন ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।
বাবার ছিল বদলীর চাকুরী। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবন স্থির ছিল না। কুড়িগ্রামে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। এসময় থেকে স্কুলে যাওয়া, সাইকেল চালালো সবকিছু ছিল বন্ধ। ইংরেজী ও অংকের সাথে রেওয়াজ মতো ‘রন্ধন শিক্ষা’ তাঁর কাছে কঠিন ছিল। ফলে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এসময় তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল ওয়াহেদ, যিনি তাঁদের পরিবারে ‘মটকা চাচা’ নামে পরিচিত ছিলেন, তার সংস্পর্শ জাহানারা ইমামের জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। মটকা চাচার উৎসাহে তিনি পুনরায় লেখাপড়া করা সিদ্ধান্ত নেন। তখন মেয়েদের স্কুল না থাকায় তাকে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। ফলে স্কুলে গিয়ে আর পড়া হয়নি। বাড়িতে দু’জন গৃহশিক্ষকই তাকে পড়িয়েছেন। এই দুই গৃহশিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই তিনি সাহিত্যে অনুরাগী হয়ে ওঠেন। পাঠ করেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের বই।
এছাড়া পিতৃবন্ধু মটকা চাচা তাঁকে প্রচুর সাহিত্য ও অন্যান্য বই কিনে দিতেন। বাইরের জগৎকে চেনা এবং চিন্তা জগৎকে প্রসারিত করতে এই বইগুলো জাহানারা ইমামকে সাহায্য করেছে। সংগীতেও ছিল জাহানারা ইমামের অনুরাগ। বাড়িতে গ্রামোফোন থাকায় আঙ্গুরবালা, কমলা ঝরিয়ে, ইন্দুবালা, আব্বাসউদ্দিন, কনকদাস প্রমুখের গান শুনতেন নিয়মিত। সংগীত ও সাহিত্য তাঁর মনকে করে তুলেছিল পরিশীলিত।
জাহানারা ইমাম মেট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বি.এ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এম.এ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কলেজ সময়টি ছিল জাহানারা ইমামের শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় পরিচয় ঘটে শরীফ ইমাম ও সহপাঠী অঞ্জলী দাশগুপ্তের সাথে। অঞ্জলির মাধ্যমে জাহানারা ইমাম বাম রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হন এবং অল্প বিস্তর রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও যুক্ত হন। কিন্তু বাবার আপত্তির কারণে তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি।
তবে অঞ্জলির জীবনের একটি ঘটনা তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। অঞ্জলী নিজের আদর্শ ও মর্যাদাকে ত্যাগ করবেন না বলে প্রথম প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর এই ত্যাগ ও আদর্শের দৃঢ়তা জাহানারা ইমামের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। নিঃসঙ্গ অশ্রুজলের ভিতর দিয়ে জাহানারা ইমাম রাজনীতি থেকে সরে আসলেও সেই যন্ত্রণা হৃদয়ে বহন করেছিলেন যা পরবর্তীকালে নানা কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয়।
ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন জাহানারা ইমাম নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট শরীফুল আলম ইমামকে বিয়ে করেন। শরীফ ইমাম ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সেই সময় তাঁদের বিয়ে ছিল বাহুল্যবর্জিত যা প্রগতির ধারাকেই বহন করেছে।
জাহানারা ইমাম ১৯৪৮-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ৩টি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এরপর ১৯৬৬-১৯৬৮ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসাবে এবং ক্যান্সার অপারেশনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে খন্ডকালীন চাকরি করতেন।
উচ্চশিক্ষিত জাহানারা ইমাম কর্মজীবনের পাশাপাশি ষাটের দশকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত তিনি শিশু সাহিত্যিক হিসাবে লেখালেখি শুরু করেন। ছোটদের জন্য কয়েকটি প্রয়োজনীয় বই তিনি অনুবাদ করেন। বইগুলি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আশির দশক থেকে তিনি গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘অন্য জীবন’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘জীবন মৃত্যু,‘চিরায়ত সাহিত্য’, ‘বুকের ভিতরে আগুন’, ‘নাটকের অবসান’, ‘দুই মেরু’, ‘নিঃসঙ্গ পাইন’, ‘নয় এ মধুর খেলা’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ ও ‘প্রবাসের দিনলিপি’। শহীদ রুমিকে ঘিরে তিনি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ রচনা করেন। এই গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় দলিল।
এই গ্রন্থটি রচনা করে তিনি পৌঁছে যান পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে। সাহিত্যে অনুরাগ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জাহানারা ইমাম। তিনি একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, টিভি সমালোচক, টিভি উপস্থাপক এবং সংবাদপত্রে কলাম লেখক ও খেলোয়ার। ছিলেন সচেতন ও সুস্থ সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিভু।
১৯৬৮ সালের পর থেকে জাহানারা ইমামের জীবন অন্যদিকে মোড় নেয়। ’৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন নীরব দর্শক হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চে লেখক কমিটির ডাকে মিছিলে যোগদান করেন। এই মিছিলে যোগদান তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় সূচনা করে। অন্তরের তাগিদেই তিনি প্রতিরোধের আগুনে নিজেকে রাঙ্গিয়ে নেন।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা জুড়েই তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম সাহায্য করে গেছেন। তিনি গোপনে নিজে গাড়ি চালিয়ে অস্ত্র ও রসদ পৌঁছে দিতেন নির্দিষ্ট স্থানে। পরিচিতদের নিরাপদে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া, আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ সবকিছুই তিনি করতেন। আর শরীফ ইমাম ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে তিনিও ব্রিজের নকশা তৈরি করে দিতেন, মুক্তিসেনাদের সহায়তা করতেন এবং কিভাবে ব্রিজে আঘাত করলে মুক্তিযুদ্ধের পর এই ব্রিজগুলো দ্রুত সংস্কার করা যাবে তারও পরামর্শ দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন অসংখ্য তরুণ মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীতে নাম লিখেছিল। সেই সময়ে বড় ছেলে তরুণ রুমিও গেরিলা বাহিনীতে নাম লেখার জন্য জাহানারা ইমামের অনুমতি চায়। সত্যনিষ্ঠ ও যুক্তিবাদী জাহানারা ইমাম সন্তানের অকাঠ্য যুক্তি মেনে নিয়ে অনুমতি দেন রুমিকে যুদ্ধে যোগদান করার। গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করে ধানমন্ডিতে এক বীরত্বপূর্ণ সফল দুঃসাহসিক অভিযানের পর রুমি নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু পাকবাহিনী রুমিসহ বাবা শরীফ ইমাম ও ছোট ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যায়। অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন সবাই। দু’দিন পর পাকবাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন শরীরে ও হৃদয়ে বহন করে শরীফ ইমাম ও জামী ফিরে এলেও রুমি আর কখনো মায়ের কোলে ফিরে আসেনি। রুমির শোকে শরীফ ইমাম স্বাধীনতার মাত্র দুইদিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর হৃদযন্ত্রের বৈকল্যে হঠাৎ মারা যান।
রুমি ও শরীফকে হারিয়ে জাহানারা ইমাম কখনো একা হননি। রুমির মত লাখো তরুণ শহীদের মা জাহানারা ইমাম। লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হল বটে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার রাজনৈতিক কারণে বার বার ব্যাহত হয়েছে। স্বাধীনতার পর জামায়াতের চিহ্নিত নেতাদের ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
কিন্তু ‘দালাল আইন’এ চিহ্নিত অপরাধী ব্যতিত অন্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় গণধিকৃত এই অপশক্তি বিভিন্ন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনরায় জনগণের মাঝে নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকে। যার ফল স্বাধীনতার দুই দশক পরে আমরা দেখতে পাই।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গণধিকৃত গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। আন্দোলনকে বিস্তৃত করার স্বার্থে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’গঠিত হয়। এই কমিটিরও আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই কমিটি ‘গণআদালত’এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে জামিন অযোগ্য মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি বিদেশেও নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন – আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো: কামরুজ্জামান, আব্দুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মাওলানা মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং কাদের মোল্লা।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় খুব দ্রুত জাহানারা ইমামের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। কারণ আশির দশকের শুরুতে ১৯৮২ সালেই তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এজন্য প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাকে। ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়টে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম।
২২ এপ্রিল চিকিৎসকরা জানান, তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাঁর মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারের বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা সম্ভব নয়। বাকশক্তি হারিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় তার। এ সময় ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন তিনি।
১৯৯৪ সালের ২২ জুনের পর থেকে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। সব ধরনের খাবার গ্রহণ ও ওষুধ প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ জুন মিশিগানের ডেট্টয়টে নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তাঁর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী আজন্ম সংগ্রামীকে আমরা হারালাম।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি দেশবাসীর কাছে শেষ আহ্বান রেখে যান, ‘মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই । তাই আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গিকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান – সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবে।’
জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। উপরন্তু দেশের মন্ত্রীসভায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজাকার-আলবদরদের নির্লজ্জ দাপট নিরবে সহ্য করেছে দেশের মানুষ। তাই স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এবং জাহানারা ইমামের মৃত্যুর ১৯ বছর পর ২০১৩ সালে তার ডাকে সারা দিয়ে বাংলার তরুণ সমাজ পুনরায় জেগে ওঠে। অবিরাম শ্লোগানে দিন-রাতের তফাৎ ঘুচে শাহবাগে রচিত হয় গণমানুষের মহাসমুদ্র। আর এ সমুদ্রের ঢেউ আলোড়িত হয় পুরো বাংলাদেশে এমনকি বিদেশেও।
গণআদালত কর্তৃক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাসহ একাত্তরের সব ঘাতক দালালদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডসহ ৬ দফা দাবিতে এই আন্দোলন গড়ে উঠে। এই আন্দোলনের চাপে সরকার বিভিন্ন মেয়াদে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলেও মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা অসাম্প্রদায়িক, শোষণ- বৈষম্যহীন রাষ্ট্র এখনও সুদূর পরাহত। এখনও ধর্মীয় বিভক্তি আছে, আছে শোষণ। এখনও হেফাজতী মতাদর্শ পাঠ্যপুস্তকে স্থান পায়। নারী বিদ্বেষী মত প্রচার করা হয়।
করোনা ভাইরাসের কালেও বিজ্ঞানকে অমান্য করে ধর্মীয় কুসংস্কার- কূপমন্ডুকতা প্রচার করা হয়। ফলে দেশ স্বাধীন হলেও মানুষ শোষণ থেকে যেমন মুক্তি পায়নি তেমনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাও বিকশিত হতে পারেনি। আজকের দিনে জাহানারা ইমামের মত সত্যনিষ্ঠ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যুক্তিনিষ্ঠ, আদর্শবাদী মানুষ প্রয়োজন। তাই আজও জাহানারা ইমাম আমাদের কাছে স্মরণীয়। আমৃত্যু সংগ্রামী এ জননীর জন্মদিনে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র
একাত্তরের দিনগুলি
অন্যজীবন
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম- তাহমীদা সাঈদা
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মারক গ্রন্থ
শতবর্ষের কৃতি বঙ্গ নারী, সম্পাদনা- শ্যামলী গুপ্ত
ইন্টারনেট