এই সংকটে আমরা নারীর প্রতি কতটা মানবিক?
১৯ মে ২০২০ ১০:৩০
করোনা বা কোভিড -১৯ কে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ আন্তর্জাতিক মহামারি ঘোষণা করেছে। দুইমাস অতিক্রম করে এখন মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে তিন লাখ। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক। আক্রান্ত পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ। এর সংখ্যা বাড়ছে প্রতি সেকেন্ডে। এখন পর্যন্ত বিশ্বসুত্র মতে, নারীর তুলনায় পুরুষই বেশী আক্রান্ত। একজন সামাজিক গবেষক ও বিশ্লেষক হিসেবে এর ব্যাখ্যা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনায় আসছি।
সারাবিশ্বের আক্রান্ত এবং মৃতের পরিসংখ্যানের বাংলাদেশি মুখপাত্র আইইডিসিআর। এই তথ্যসুত্রের সত্যতা ও স্বচ্ছতা নির্ভর করে রাষ্ট্রের স্বাধীন গণতন্ত্র চর্চার উপর। স্বাস্থ্য কাঠামো কতটা দরিদ্র মানুষের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছেছে। আইনের ন্যায়বিচার কতটা কার্যকর। জাতি হিসেবে আমরা কতটা সচেতন এবং গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন তার উপর। সমগ্র বিশ্ব আজ স্বাস্থ্য বির্পযয়ের মুখোমুখি। সবাই এক পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছি। স্বাস্থ্য সংকট তৈরী করেছে আরও আরও সংকট। দেশভেদে, আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে এর চেহারা ভিন্ন ভিন্নরূপ। আমাদের আসল সংকট ও দুর্দশা শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক না। স্বাস্থ্য সংকট আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রকেই হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি এখনো পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি অনুধাবন বা উপলব্ধি করতে পারছি।
সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব মানবজাতির স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। করোনাভাইরাস নারীর জীবনকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও নির্যাতনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন কোন না কোন ধরনের শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটা ঘটে তার একান্ত কাছের সম্পর্কের পুরুষ বা জীবনসঙ্গীর দ্বারা। পরিসংখ্যান বলছে দুর্যোগকালীন বিশ্বে এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এবং প্রতিটি দেশের নির্যাতন প্রতিরোধের কল সেন্টারগুলেতে রিপোর্টিং বেড়েছে ৬৫ শতাংশ (ইউএনএফপিএ ২০২০)। আমরা জানি, যে কোন ধরনের জরুরী অবস্থা, যুদ্ধপরিস্থিতি, দুর্যোগ অথবা মহামারি, নারী ও পুরুষকে ভিন্নমাত্রায় প্রভাবিত করে। কারণ বিদ্যমান সমাজে নারী এবং কন্যাশিশুরা অধিক বৈষম্য, বঞ্চনা এবং নির্যাতনের শিকার হয়। পুরুষের তুলনায় নারীর মতামত প্রকাশ এবং সিদ্বান্ত দেয়ার ক্ষমতা অনেক সীমিত। ফলে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, পছন্দ এবং অপছন্দ সকল কিছুই পরিবারে নিয়ন্ত্রিত হয় অন্যের দ্বারা।
বাংলাদেশের মতো সমাজ ব্যবস্থায় নারীর জীবন এবং স্বাধীনতা শুধুমাত্র পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বললে ভুল হবে। বরং বলা যায় গোটা সমাজই তা নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে যে সকল নারী প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে এবং যারা ভিন্ন চাহিদা সম্পন্ন তাদের অবস্থা আরও বেশি নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ সরকারের করোনা রেসপন্সে এখন পর্যন্ত শুধু আক্রান্ত এবং মৃতের তথ্যই আমরা পাচ্ছি। সেখানে জেন্ডার ভিত্তিক প্রভাব বা নির্যাতনের কোন তথ্য আমরা পাইনি। গণমাধ্যমের প্রতিদিনের খবরে দেখি নির্যাতনের পর নারীকে হত্যা করা, শিশু এবং নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা/বাধ্য করা। পুড়িয়ে মারা এখনো চলছে। এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাস্তবে যা ঘটছে তা সব রির্পোটেও আসছে না ।
আমরা সাদাচোখে এবং সাধারণভাবে দেখি করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি বা রোগী চিহ্নিতকরণ করতে। কিন্তু কভিড -১৯ এর প্রভাব শুধুমাত্র চিহ্নিতকরণ সমস্যা নয়। এর প্রভাব একটা জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। যেমন দেখা যাচ্ছে- সামজিক দুরত্ব, লকডাউন, গৃহবন্দী অবস্থা পুরুষদের অস্থির করে তুলেছে। কর্মহীনতা, আয় রোজগার বন্ধ, ভবিৎষতের অনিশ্চয়তা মানসিক চাপ তৈরী করছে। অতএব, পুরুষের এই পরিস্থিতির সব দায় যেন একজন নারীর। যিনি আপনার সবচেয়ে কাছের, তাকে চাইলেই শারীরিক আঘাত ও মানসিকভাবে নির্যাতন এবং নিপীড়ন করা যায়। করোনা কি এই দেশের পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক প্রবৃত্তিতে কোন প্রভাব ফেলতে পেরেছে? আরেকদিকে ক্ষুর্ধাত মানুষের চাল চুরি। রাজনৈতিক নেতা থেকে রাতারাতি ভিক্ষুক বনে যাওয়া। বাড়ি ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করে আটমাসের অন্তস্বত্ত্বাকে পুড়িয়ে মারা। নারী সেবিকাকে দমন করার জন্য ৭ দিন পরিত্যক্ত পুকুরে থাকতে বাধ্য করা। মানবিক বিপর্যয় শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরীসহ যে কোন মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি। আর কবে এই দেশের নির্যাতনকারী পুরুষরা সত্যিকারের মানবিক মানুষ হয়ে উঠবে?
বাংলাদেশে স্বাভাবিক সময়ে ৮০ শতাংশ নারী কোন না কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার। ৯০ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। করোনা পরিস্থিতি নারীর জীবনকে ভিন্নমাত্রায় প্রভাবিত করছে। নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও সমতার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর প্রভাব সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে (এপ্রিল ২০২০) উঠে আসে;
করোনা পরিস্থিতিতে শিশুসহ পরিবারের সকল সদস্যই ২৪ ঘন্টা বাসায় আছে। এই সময়ে আগের তুলনায় গৃহস্থালী কাজের চাপ এবং কর্মঘন্টা বেড়েছে বলে অভিমত দেন ৯০ শতাংশ নারী। যে সকল নারী কর্মজীবি ছিলেন তাদের অবস্থাও প্রায় একই। এক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের নারীদের মধ্যে বিশেষ কোন র্পাথক্য নেই। ঘুম থেকে উঠার পর সারাক্ষণই একজন নারী পরিবারের সদস্যদের কোন না কোন চাহিদা মেটানো, শিশু ও বয়োজেষ্ঠ্যদের যত্নে ব্যস্ত থাকেন। এক্ষেত্রে, জরিপে অংশগ্রহনকারী ৮৯ শতাংশ মনে করছেন নারীর বিশ্রাম ও বিনোদনের সময় কমেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি নারীর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ব্র্যাক জরিপে আরও উঠে আসে, বাংলাদেশের নারীদের জীবনে নির্যাতনের কথা। এর হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এক্ষেত্রে পুরুষ উত্তরদাতারা বলেছেন স্বভাবিক সময়ের চেয়ে ২২ শতাংশ নারী নির্যাতন বেড়েছে । উল্লেখ্য যে, ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা এর কারণ হিসেবে বলেছেন-দীর্ঘ সময় ঘরে থাকা এবং কোন আয় না থাকা। ৩৮ শতাংশ বলেছেন ঘরে খাবার কম থাকা নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ।
নির্যাতিত নারীদের প্রতিবেশী, আত্বীয়-পরিজনের বা অন্যত্র কোন ধরনের সহযোগিতা চাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু সামাজিক দূরত্বের কারণে নারীর চলাচলও নিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একটু আগেই যে নিযার্তন করলো তার সঙ্গেই আবার একঘরে বা স্থানে থাকতে হচ্ছে। ফলে আবার নির্যাতিত হওযার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে হাসপাতাল, ডাক্তার এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী করোনা রোগী শনাক্তকরণ এবং আইসোলেশন নিয়ে ব্যাস্ত। ব্যাস্ততায় এতটাই নিমজ্জিত যে পারিবারিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার কোন নারীকে তারা সহায়তা দিতে পারছেন না। সরকারী হটলাইন নাম্বারে বিগত এপ্রিল ২০২০ এ ৮৫০০ টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট হয়। যেগুলো মুলত: শারীরিক নির্যাতন, মানসিক অত্যাচার এবং ফোনে যৌন নিপীড়ন। ব্র্যাক-কর্মরত ৬৪ জেলার নির্যাতনের তথ্যমতে ৬৮০ টি নারী নির্যাতনের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয় শুধুমাত্র মার্চ ২০২০ সালে। উল্লেখ্য যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
অপরদিকে যে সকল পরিবারে খাদ্য সংকট রয়েছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে পুরুষের তুলনায় নারী কম খাবার খাচ্ছেন। কারণ, পুরুষ পরিবার প্রধান। এতএব পরিবারে তার মুল্য বেশী। করোনাকালীন ব্র্যাক, জেন্ডার জাষ্টিস কর্মসূচীর কর্মীরা মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও জেন্ডার সমতার ম্যাসেজ প্রদান করেন। অনেকেই পর্যবেক্ষণ করেন- করোনা পুরুষদের বেশী আক্রান্ত করে বলে গ্রামে মানুষের মধ্যে একটি আতংক কাজ করছে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থতার সাথে শারীরিক পুষ্টি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার বিশেষ সর্ম্পক রয়েছে। অতএব খাদ্য ও পুষ্টির যত্নে পরিবারে পুরুষ সদস্যদেরই প্রাধান্য বেশী। এমনকি গর্ভবতী নারী ও দুগ্ধদানকারী মায়ের চেয়েও।
কিন্তু আমরা কি একটি বিষয় অনুধাবন করছি- সারাবিশ্বে যখন তখন কারা সবচেয়ে বেশী বাইরে যায়? কোন রকম নিয়ম বা শৃঙ্খলা কারা মানতে চায় না? কারা সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউনের তোয়াক্কা না করে বাড়ীর বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। ফাইন দেন এবং পুলিশ ধরলে মিথ্যে অজুহাত দেন? একজন পুরুষ এত দীর্ঘসময় গৃহবন্দী থাকবেন এটা হয়তো সারা পৃথিবী স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারেনি। তবে আজ কি তারা অনুভব করছেন- তার মা-বোন-স্ত্রী এবং কন্যা সারাজীবন চার দেয়ালে বন্দী থেকে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কি অবস্থা? তাদের কখনো দমবন্ধ হয়ে আসে কিনা? মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস এবং মুক্ত পৃথিবী, শুধুই কি পুরুষের অধিকার? পুরুষ চাইলে নারী বাইরে যাবে, না চাইলে নয়। বাইরের পৃথিবীর সাথে একজন নারীর সম্পর্ক এবং প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করবেন পুরুষ। নারীর মন বা মেজাজ খারাপ হলে, সামান্য ভুল হলে কখনো কি ঘরে ভাংচুর করেছে? অন্যের গায়ে হাত তুলেছে অথবা গালি অথবা হুমকি দিয়েছে?
করোনা সমস্যা মানব জাতিকে আজ মানবিক মুল্যবোধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। যে কাঠগড়ায় ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-জাতিস্বত্ত্বা সব একাকার। করোনা অন্ধ। কাউকে দেখতে পায় না। শুধু সামনে যাকে পায় তাকেই আক্রান্ত করে। ২৪ ঘন্টা গৃহবন্দী অবস্থায় থেকে একবারও কি বিবেকের আয়নায় দাঁড়িয়েছি আমরা। নিজেকে বার বার প্রশ্ন করার সুযোগ এসেছে। প্রশ্নটি করতে পেরেছি- মানুষের মাপকাঠিতে কোথায় দাড়িয়ে আছি আমরা? নাকি অপেক্ষায় আছি পৃথিবী একদিন আবার কবে স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে। আমরা যে যার অবস্থানে ফিরে যাব। পুনরায় নতুন উদ্যমে অন্যায়- অনাচার-বৈষম্য, স্বার্থপরতা এবং নিপীড়নে মেতে উঠবো?
হাসনে আরা ডালিয়া– উন্নয়নকর্মী, সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষক
করোনাকালে নারী নির্যাতন নারী ও শিশু নির্যাতন নারীর প্রতি সহিংসতা