সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা, জয়া থেকে আফরিন…
২০ মে ২০২০ ১৭:৩৩
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান যেদিন মারা গেলেন সেদিন অভিনেত্রী জয়া আহসান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে স্যারের উদ্ধৃতি সংবলিত একটি ছবি শেয়ার করেন। তাতে শোকের রঙ কালোর সঙ্গে সাদা আর ধূসরের মিশেলে ছিল ড. আনিসুজ্জামানের একটি বাণীর ইলাস্ট্রেশন- ‘ধর্ম মানার পাশাপাশি ধর্ম না মানার স্বাধীনতাও দিতে হবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচলিত নীতিতে স্বনামধন্য অভিনেত্রী জয়া তাঁর ব্যক্তিগত প্রোফাইলে মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন সকল কিছু ব্যক্ত বা শেয়ার করতে পারেন। জানাতে পারেন নিজের অনুভূতিও। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামানের একটি বক্তব্য শেয়ার দিতেই পারেন। এটি যদি তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসও হয়, তাতেও কোন ক্ষতি দেখি না। কারণ, ব্যক্তি জয়া সমাজে ধর্মবিশ্বাসী এবং ধর্মে অবিশ্বাসীর সহাবস্থান চাইতেই পারেন। যে কোনো সুস্থ আর সচেতন মানুষ মাত্রই তা চাইবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সব মানুষ, সব প্রাণি, সব সৃষ্টি একরকম হয় না। বৈচিত্র্যই সুন্দর করে এই জগত সংসারকে।
কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, জয়া আহসান এই ছবিটা শেয়ার দিতেই অনেকেরই ধর্মবোধ জেগে ওঠে এবং তারা জয়ার প্রোফাইলে যেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, গালিগালাজ দেওয়া অধিকাংশই পুরুষ এবং মুসলমান। অথচ আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্য কিন্তু বলেছে ধর্মের কথা, কোনো ধর্মকে স্পেসিফিক করে বলে নি। তাহলে এই বক্তব্যে শুধুমাত্র বাঙালি মুসলমান পুরুষরাই কেন ক্ষেপে উঠলেন? মুসলমান নারী ও অন্যান্য ধর্মের নারী ও পুরুষরা কেন নয়?
এখন আপনারা বলতেই পারেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলবে কেন? সংখ্যালঘু ধর্মের লোকজন যদি ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে ‘অফেন্ডেড’ অনুভব করে এবং সেটা বলতে সাহস না পায়, তবে আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কিছু বলার আগে ভাবতে হবে আবারও। যদিও যে কোন ধর্মের মানুষেরই ধর্ম না মানা কারও সঙ্গে সহাবস্থানে আপত্তি থাকা উচিত নয়। আমাদের ভাবতে হবে নিজে কোনভাবে কারও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিচ্ছি কিনা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কোন না কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে বলে ধর্মে অবিশ্বাসীদের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার চেয়ে একজন জয়া আহসানকে গালিগালাজ করা- এটিও একধরণের নিপীড়ন।
জয়া আহসানের এই মতামত কেন বাংলাদেশি কিছু মুসলমান নামধারী পুরুষের মনে ঝড় তুললো তার জন্য আমাদের আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। একজন জয়া আহসান তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আলোচনায়। অভিনয়গুণের পাশাপাশি সৌন্দর্য, প্রেম, বিয়ে, ডিভোর্স, সন্তানহীনতা- ব্যক্তি জয়ার জীবনকে বারবার করে কাটাছেঁড়া আর ব্যবচ্ছেদ করেছি আমরা।
আলোচনা তুঙ্গে ওঠে যখন নাটকের জয়া সিনেমায় নাম লেখান। তখন থেকে জয়া আহসানের বয়স হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জাতীয় গবেষণার বিষয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সৌন্দর্য আর সুস্থ শারিরীক অবয়ব ধরে রেখে যেন তিনি কোনো মহা অপরাধ করে ফেলেছেন। এরই মধ্যে জয়া আহসান কলকাতার সিনেমায় নাম করতে শুরু করেন। আমরা আবিষ্কার করি নতুন এক জয়াকে। যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মুক্তা। একদিকে সৌন্দর্যের ছটা ছড়িয়ে চলেছেন, অন্যদিকে আমরা তার শক্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেতে থাকি। গণজাগরণ মঞ্চে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নিজের দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে যান তিনি। মূলত তারপর থেকেই জয়া আহসান একটা শ্রেণির চক্ষুশূল। সেই শ্রেণিটার প্রতিনিধিত্বকারী মূলত পুরুষ। তারা কিছুতেই যেন একজন নারীর সাফল্য মেনে নিতে পারেন না।
ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে তাই জয়া হয়ে যান সহজ টার্গেট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতার এই যুগে এতটাই সহজ টার্গেট যে তাঁর প্রোফাইলে গিয়ে তাঁকে যাচ্ছেতাই গালি দেওয়া যায়। সেইসব গালির অধিকাংশ জয়াকে ধর্ষণের ইচ্ছা প্রকাশ করা এবং কোন না কোনভাবে তার সঙ্গে যৌনসংসর্গ স্থাপনের ইচ্ছা জানানো। সেইসব কুৎসিত গালিগালাজ ও যৌন নির্যাতনের ইচ্ছা প্রকাশ করা অধিকাংশ আইডির নামই বাঙালি পুরুষের। তাই সন্দেহ জাগে ধর্ম এদের কাছে যদি এতটাই প্রিয় হয় তবে এরা একজন নারীকে এভাবে গালিগালাজ ও মানসিক নির্যাতন কীভাবে করেন? ধর্ম কি আমাদের এই শিক্ষা দেয়!
কিন্তু নিজ দায়িত্বে ‘মোরাল পুলিশিংয়ের’ দায়িত্ব নেওয়া এই মানুষগুলো কোন যুক্তিতর্ক, ভদ্রতা, সভ্যতার ধার ধারে না। এভাবেই বছরের পর বছর তারা নারীর প্রতি নানামুখী নির্যাতন চালিয়ে যান। জয়া আহসানের ইনস্টাগ্রাম পেইজের কমেন্ট বক্সে চোখ পাতা যায় না বিভিন্ন বয়সী ছেলে এবং পুরুষের কুৎসিত মন্তব্যে। জয়ার বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়ে তাকে আন্টি ডেকে, মায়ের বয়সী বলেই পরবর্তী লাইনে তাঁর সঙ্গে নানাভাবে যৌনেচ্ছা প্রকাশ করছেন তারা। বিকৃতির এই চরম বহিঃপ্রকাশ কেন? এত ঘৃণার উৎস কী?
জয়ার কমেন্ট বক্সে অবশ্য নারীরাও কম যান না। প্রতিনিয়ত জয়ার পোস্ট করা প্রতিটি ছবিতে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর বয়স বেড়েছে। তিনি একজন বাঙালি মুসলিম নারী। তাঁকে এখন সমাজের এসব বিজ্ঞজনের মতামত অনুযায়ী চলতে হবে, পোশাক পরতে হবে। এমনকি পারলে পেন্সিল দিয়ে এঁকে হলেও কয়েকটি বলিরেখা পড়াতে হবে চামড়ায়। কিছুতেই নিজের মতো বলা বা চলার অধিকার যেন জয়াদের নাই। তা তিনি যতই সফল আর ব্যক্তিত্ববান হোন না কেন। স্বাধীন মতামত প্রকাশ করলেই তিনি পুরুষতন্ত্রের চোখে একজন ‘যোনিসর্বস্ব ফ্যান্টাসিতে’ পরিণত হন।!
জয়া আহসানসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসিত আক্রমণের শিকার নারীরা মূলত এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই টার্গেট। এই মানসিকতা চায় পুরুষ সমাজের, রাষ্ট্রের, ক্ষমতার, ধর্মের উর্দ্ধে থাকুক। তাই তারা নারীকে দাবিয়ে রাখার হেন চেষ্টা নাই যে করেন না। ঘরের মেয়েটির পথ চলা বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। যোগ্যতায় না পারলে সহপাঠী আর সহকর্মীদের চরিত্র নিয়ে কথা বলেন যেন সেই মেয়েটি কিছুতেই উপরে না উঠতে পারে। আর এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আইডির পেছনে লুকিয়ে থেকে পুরুষতন্ত্র তার মোরাল পুলিশিং চালানোর চেষ্টা করে। কিছুতেই যখন অন্যমাত্রায় উচ্চতায় পৌঁছানো জয়াদের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারে না, তখন তাদের সাফল্যকে পুরুষের দান বলে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। অমুক পরিচালক, তমুক প্রযোজকের সঙ্গে শুয়ে সিনেমার রোল বাগিয়েছে ধরণের মন্তব্য তখনই আসে। প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা আর সৌন্দর্যকে কল্পিত সামাজিক ছুরিকাঁচির নিচে ফেলা হয় অজস্রবার।
পুরুষতন্ত্র যে শুধুমাত্র পুরুষরাই ধারণ করেন, তা কিন্তু নয়। অনেক নারীও একে মনেপ্রাণে ধারণ করেন ও লালন করেন। কীভাবে? এর সর্বশেষ শিকার আফরিন আনিস রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখে, মাথায় স্যাভলন স্প্রে করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আল্লাহর কাছে তাকে করোনায় আক্রান্ত করার দোয়া চেয়ে আলোচনায় এসেছেন। আমাদের আলোচনা আর সমালোচনা থাকতে পারতো তার এই আচরণ নিয়ে। স্যাভলন অ্যান্টিসেপ্টিক স্প্রে যা সারফেসে ছেটানোর জন্য। কিছুতেই ত্বকে লাগানো যাবে না, এই পয়েন্টে সমালোচনা হলেও অনেকেই তার সেই ভিডিওতে যেয়ে ‘বডিশেমিং’ শুরু করেন। এ ও আধুনিক সমাজে বর্বরতার এক নতুন চর্চা।
বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের নজরে আসায় ভুল তথ্য প্রদানের জন্য তারা জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে ওই নারীকে দিয়ে আরও একটি ফেসবুক লাইভ করিয়ে ক্ষমা চাওয়ান। সেই লাইভে তিনি এসেছেন একদমই মেকআপ ছাড়া সাদামাটা পোশাকে। লাইভের নীচে কুতসিত মন্তব্যের লাইন লেগে গিয়েছে। নারী পুরুষ কেউই বাদ যাচ্ছেন না। তাদের সমালোচনার বিষয় মেয়েটির মেকআপ বিহীন চেহারা। আগের লাইভের পরীর মতো সুন্দর আপুটি এমন কুতসিত পেত্নী কীভাবে হয়ে গেল তাই নিয়ে সবার মাথাব্যথা। এমনকি অনেকেই অন্য একজন মেয়েকে দিয়ে লাইভ করাচ্ছেন কেন বলে খোঁচা দিতেও ছাড়ছেন না। নারী এবং পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যোগ দিচ্ছেন মেয়েটির চেহারার সমালোচনায়। এই মুহুর্তে চোখেমুখে স্যাভলন স্প্রে করা যেন নিতান্ত গৌণ, মেয়েটার চেহারা কেমন সেটিই আসল। সে কেন মেকআপ করল, সে কেন সুন্দর জামাকাপড় পরল সেটিই যেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু! পরবর্তীতে তিনি সেই পোস্ট ডিলিট দিয়েছেন। এবং বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট তাদের ফেসবুক পেইজে আফরিন রহিমানকে সাইবার বুলি করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফরিন আরও একটি লাইভ ভিডিও পোস্ট করেছেন তার আইডিতে যেখানে নতুন করে আবারও শুরু হয়েছে ট্রোলিং এবং বডি শেমিং।
একজন মানুষকে মুখের উপর ‘চেহারা খারাপ’, ‘বয়স বেশি’ ‘এমন পোশাক পরছেন কেন’, ‘মোটা/চিকন’ ‘কালো/ধলা’ বলা যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যপার। একজন জয়া আহসান হোন, কি আফরিন রহমান, সবাই দিনের শেষে চরম জাজমেন্টের মুখোমুখি হন শুধুমাত্র তাদের নারীত্বের কারণে। আমরা ভুলে যাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আইডি থাকার মানেই যাকে যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার পাওয়া নয়। সৌজন্য, ভদ্রতা, ব্যক্তিমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সুন্দর আচরণই নির্ধারণ করবে আপনি মানুষ হিসেবে কেমন।
আফরিন আনিস রহমান জয়া আহসান ড. আনিসুজ্জামান নারী নির্যাতন সাইবার বুলিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম