বর্ণবাদ-বর্ণবৈষম্য সমর্থন করে না ইসলাম
৮ জুন ২০২০ ১৭:৩৪
বর্ণবৈষম্যঘটিত একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকা আজ উত্তাল। লকডাউন ভেঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছে হাজার হাজার মানুষ। আমেরিকার জমিনে রচিত হতে যাচ্ছে ভিন্ন এক ইতিহাস। তবে এ ইতিহাস নতুন কোনো ইতিহাস নয়। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও নয়। বহুবার বহুভাবে বর্ণবৈষম্যজনিত বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে এ পৃথিবীতে। আহত-নিহত হয়েছে বহু মানুষ। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ— বিভেদটা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। হয়তো পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই…। কিন্তু এর শেষ কোথায়?
জাহেলি বা বর্বর যুগের কথা না হয় বাদ দিলাম, আধুনিক এই সভ্য সমাজেও কেন বর্ণবৈষম্য ঘটে? বর্ণবাদী মানুষের দাম্ভিকতায় আজও কেন প্রাণ হারায় মানুষ? যে মানুষটি অকপটে স্বীকার করেন, সাদা বা কালো হয়ে জন্মানোর মাঝে তার কোনো কৃতিত্ব নেই, কোনো হাত নেই তার— সেই মানুষটিই আবার কেন ভ্রু কুচকে তাকান ভিন্ন আবরণের অন্য কোনো মানুষ গা ঘেষে দাঁড়ালে?
কী এই বর্ণবাদ? গাত্রবর্ণের ভিন্নতার কারণে কোনো জনগোষ্ঠী সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ করাকে বর্ণবাদ বলে। বর্ণবাদ মানেই বর্ণবৈষম্য। সাদা কালোয় ভেদাভেদ। হাল জমানায় এসে এই বর্ণবাদ কেবল গাত্রবর্ণের বৈষম্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং জাতি-গোষ্ঠী, দেশ-শ্রেণী এমনকি ধর্ম বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেও ‘বর্ণবাদ’ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে আন্দোলন হয়েছে। আইন হয়েছে। হয়েছে নীতিমালাও। এমনটি গঠিত হয়েছে বিভিন্ন সংগঠন-কমিশনও। কিন্তু কেন থামছে না এই বৈষম্যপনা? কেন মানুষ মেনে নিচ্ছে না জন্মগত ভিন্নতার এই আবরণকে? মানবরচিত কোনো বিধান বা নীতিমালায় নয়; বর্ণবাদগত এই বৈষম্য দূরীকরণে ‘ইসলাম’-ই একমাত্র সমাধান। কর্যকরী ফমূর্লা। কারণ ইসলামে কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না ইসলাম। বর্ণবাদকে নির্মূল করে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অনন্য এক উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.)।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্য বলুন অথবা বলুন যুক্তরাজ্য; আফ্রিকা মহাদেশের কথা তুলুন অথবা তুলুন অস্ট্রিলিয়ার কথা— পৃথিবীর বুক থেকে বর্ণবাদের মতো কলঙ্ক মুছতে ইসলামই হতে পারে একমাত্র কার্যকরী ফর্মূলা। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মালকম এক্স একবার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘আমেরিকাকে ইসলাম পূর্ণরূপে বুঝতে হবে। কারণ ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা আমেরিকান সমাজ থেকে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে কার্যকরী সমাধান দিতে পারে।’
শান্তির ধর্ম ইসলামে বর্ণবাদী কোনো আচরণ নেই। নেই কোনো বর্ণবৈষম্য। সাদা-কালোয়, ধনী- গরিবে, উঁচু-নিচুতে এবং বংশ-জাতির বিবেচনায় কোনো তারতম্য কিংবা শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্টের পার্থক্য করেনি ইসলাম এবং ভালো-মন্দের কোনো মানদন্ড হিসেবেও নির্ধারণ করেনি এগুলোকে। এবার আসুন আমরা দেখি, ইসলাম বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যকে নির্মূল করার কী কী উপায়-পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে এবং রাসুল (সা.) কীভাবে বর্ণবাদহীন আদর্শ সমাজ গড়েছেন।
১. ভাষা, ধর্ম বা বর্ণের বিচার-বিবেচনায় কোনো মানুষকে কোনো মানুষর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেনি ইসলাম। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বিশেষত্ব নির্ণয়ের একমাত্র মূলনীতি হলো— তাকওয়া বা আল্লাহভীতি এবং ধর্ম পালন। বর্ণগত সৌন্দর্য বা জাতি-বংশগত উঁচুতা ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) স্পষ্টভাষায় বলেছেন, ‘হে মানবসকল! তোমাদের পালনকর্তা এক আল্লাহ। তোমাদের আদি পিতা এক আদম (আ.)। মনে রেখো! অনারবের ওপর আরবের ও আরবের ওপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনোই বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধু আল্লাহভীতি ও ধর্মপালনের দিক দিয়েই এ বিশেষত্ব বিবেচিত হতে পারে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ২২৯৭৮)
২. বর্ণবাদ এক প্রকার সাম্প্রদায়িকতা। সমাজ শোষণের হাতিয়ার। মানুষরূপি কিছু অমানুষ নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করা উদ্দেশ্যে বর্ণবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বর্ণবাদের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ায়। সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না ইসলাম। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ধর্ম ইসলাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ ও সবকিছুর খবর রাখেন। (সুরা হুজরাত, আয়াত— ১৩)। সুতরাং সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে নির্মূল করার মাধ্যমে প্রকারন্তরে ইসলাম বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যকে নির্মূল করেছে।
৩. বর্ণের বিচিত্রতা এবং ভাষার ভিন্নতা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়; একমাত্র আল্লাহ মহানের দান। আর এগুলো তার পক্ষ থেকে প্রদান করা নিদর্শনও। কোনো মানুষ চাইলেই সাদা হয়ে জন্মাতে পারবে না অথবা শত ইচ্ছা থাকলেও কেউ কালো হয়ে জন্মানোকে ঠেকাতে পারবে না। যার জন্মস্থান বাংলাদেশে নির্ধারিত হয়েছে; কারো ইচ্ছা বা পছন্দের বিবেচনায় সে জন্ম ভারতে স্থানান্তরিত করা সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন, ‘তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম, আয়াত— ২২)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত করেন; আর আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে বিচিত্র বর্ণের পথ- শুভ্র, লাল ও নিকষ কালো। এভাবে আরো রয়েছে রংবেরঙের মানুষ, কীটপতঙ্গ ও জন্তু।’ (সুরা ফাতির, আয়াত— ২৭-২৮) সুতরাং যে ভিন্নতায় মানুষের কোনো হাত নেই, মানুষের কোনো অবদান নেই যে বৈচিত্রে; সে ভিন্নতা বা সে বৈচিত্রের জন্য মানুষকে দায়ী করা বোকামি বৈ অন্য কিছু নয়। এছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা-সুরত, ধন-সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের কর্ম ও অন্তরের অবস্থা দেখেন।’
৪. ইসলাম বলেছেন গোটা পৃথিবীর সব মানুষ একই উপাদান মাটি থেকে সৃষ্ট। সৃষ্টিগত উপাদানে যেহেতু ভিন্নতা নেই সুতরাং সব মানুষ সমান। মানুষে মানুষে উঁচু-নিচুতা এবং ভেদাভেদ সৃষ্টি করাকে সমর্থন না করতেই সৃষ্টগত উপাদানে ভিন্নতা রাখেননি আল্লাহ মহান। আমিও যে মাটির তৈরি আপনিও সে মাটির তৈরি সুতরাং আমায় তোমায় ভেদাভেদ বা উঁচু-নিচুতা এলো কোথা থেকে? হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আদমকে এক মুষ্টি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, যা তিনি সমগ্র জমিন থেকে সংগ্রহ করেছেন। ফলে আদম সন্তানরা জমিনের বিভিন্নতার মতোই ভিন্নভাবে এসেছে। তাদের মধ্যে (মাটির গুণাবলীর দরুন) সবই আছে— লাল, সাদা, কালো, তাছাড়া নরম, শক্ত এবং ভালো ও মন্দ।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং- ২৯৫৫)। সৃষ্টিগত উপাদানের অভিন্নতায় মানুষে মানুষ সমতার কথা শিখিয়েছে ইসলাম। পাশাপাশি মাটির গুণাবলীর কারণে মানুষের বর্ণগত ভিন্নতাকে কুদরতের সৃষ্টিগত কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং কুদরতের সৃষ্টিগত কৌশলকে ভেদাভেদের কারণ হিসেবে গ্রহণ করা মানে কুদরতের বিরোধীতা করা। আর এটা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না।
৫. বর্ণবাদ বিরোধী ইসলাম প্রদত্ত নীতিমালা বা মূলনীতিকে রাসুল (সা.) শুধু মুখে বলে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তার গোটা জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন এসব। যে আরব সমাজে অনারবদেরকে ঘৃণারপাত্র বানিয়ে রাখা হয়েছিল, যেখানে কালোরঙের মানুষগুলোকে অমানুষ ভাবা হতো, রাসুল (সা.) সেই সমাজে ইথিওপিয়ান সাহাবি হজরত বিলালকে (রা.) ইসলামের সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন। হাবশার বিলাল (রা.) ছিলেন কৃষাঙ্গ মানব। অতিশয় কালো আবরণের মানুষ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন কৃতদাস। মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলের (সা.) নির্দেশ মেনে বায়তুল্লাহর ছাদে উঠে হজরত বিলাল যখন আজান দিতে শুরু করলেন, মক্কাবাসী মোশরেকরা তখন লজ্জায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। তারা বলছিল, ‘মুহাম্মদ কি এ কৃষ্ণাঙ্গ কাক ছাড়া আর কাউকে আজান দেয়ার মতো পেল না?’
মানবতার নবী সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘মানুষ হিসেবে সবাই সমান। বর্ণের ভিত্তিতে নয়, শুধু তাকওয়া বা আল্লাহভীতির বিচারেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয়।’(দালায়িলুন নুবুওয়াহ; বায়হাকি : ৫/৭৮)। কৃষাঙ্গ মানব হজরত বিলালকে (রা.) ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ঘোষণা করার মাধ্যমে সমাজ থেকে বর্ণবাদের বীজ উপড়ে ফেলেছিলেন রাসুল (সা.)।
এখানে শেষ নয় তার বর্ণবাদহীন মিশন। কালো বর্ণের একজন নারী মসজিদে নববিতে ঝাড়ু দিতেন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন তিনি। কৃষাঙ্গ সেই নারীর ইনতিকাল হলে সাহাবাগণ গুরুত্বপূর্ণ নয় ভেবে তার মৃত্যুর খবর রাসুলকে (সা.) জানালেন না। কিছুদিন পর রাসুল (সা.) সেই নারীর খোঁজ নিয়ে জানলেন তিনি ইনতিকাল করেছেন। রাসুল (সা.) সাহাবাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা আমাকে কেন জানালে না এই খবর?’ এরপর সরাসরি তিনি তখন সেই নারীর কবরে গেলেন এবং নিয়ম ভেঙ্গে সেই নারীর কবরের পাশে পুনরায় জানাজার নামাজ আদায় করলেন। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বললেন, ‘যে কোনো মুসলমান মারা গেলে তোমরা অবশ্যই আমাকে জানাবে।’ (সহিহ ইবনে খুজায়মা, হাদিস নং- ১২৯৯)
একবার এক সাহাবি অন্য এক সাহাবিকে তার মা কালো বর্ণের ছিলেন বলে তিরস্কার করলো। রাসুল (সা.) তা শুনে ভীষণভাবে রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, ‘তুমি এমন মানুষ, যার মধ্যে এখনও জাহেলি বর্বরতা রয়ে গেছে।’ (বুখারি ও মুসলিম) বর্ণবৈষম্যকে জাহেলিয়াত ও বর্বরতার অন্তর্ভুক্ত আচরণ হিসেবে বিবেচনা করে একথা বলেছিলেন রাসুল (সা.)।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্য। সাদা কালোয় পার্থক্যকরণ। কৃষাঙ্গ ও শেতাঙ্গ হওয়াকে উচুতা এবং নিচুতার মানদন্ড বিবেচনা করা। হাজার বছর আগে মানবতার নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) যেখানে বর্ণবৈষম্যকে জাহিলিয়াত বা বর্বরজাতির আচার-আচরণ বলে ঘৃণা করেছেন, আধুনিক সমাজের সভ্য মানুষ হয়ে আমরা কীভাবে সেই বর্ণবাদকে পুজি করে স্বার্থসিদ্ধির ঝান্ডা উড়াই? এটা নিতান্তই হীন মানসিকতা পরিচয় বৈ অন্য কিছু নয়। সুতরাং বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যর মূলকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলতে হলে আমাদেরকে আবারও ফিরে যেতে হবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এবং আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে রাসুলে আরাবির বাস্তবায়িত আদর্শময় নীতিমালা।
লেখক : সম্পাদক, ইসলাম প্রতিদিন