Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: আমার দৃষ্টিতে নারীবাদ


৩ জুলাই ২০২০ ১১:০০

খুব সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি ম্যানিপিউলেট হওয়া বা নিজ নিজ স্বার্থে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত টার্মটি ফেমিনিজম বা নারীবাদ। স্বার্থান্বেষী নারী, স্বার্থান্বেষী পুরুষ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ- নারীবাদের আসল অর্থ বাদ দিয়ে মনমতো রচনা লিখতে কেউই পিছিয়ে নাই। শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীর নেতৃত্বস্থানীয় দেশেও শব্দটিকে বেশ ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখা হয়। আমি জানি, আমার লেখার হেডলাইন পড়েই আমার পরিচিত-অপরিচিত অনেকের ভ্রূ ইতোমধ্যে কুঁচকে গিয়েছে। ভ্রু কুঁচকানোর আগেই বলি, এই লেখাটির উদ্দেশ্য সবার জন্য সহজ ভাষায় আমি নারীবাদ সম্পর্কে পড়াশোনা করে যা বুঝেছি তা তুলে ধরা। লেখার মধ্যেই আমি নারীবাদ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে আমার মতামত তুলে ধরবো।

বিজ্ঞাপন

আমাদের অধিকাংশের কাছেই নারীবাদ এমনই এক ট্যাবু, ভাসুরের নামের মতো যা মুখে আনাও বারণ। একটা সময় পর্যন্ত আমি নিজেকে ‘নারীবাদী’ মনে করতাম না। কারণ, আমার মনে হতো, সমঅধিকার পাওয়ার জন্যে আলাদা কোনো ‘বাদে’র প্রয়োজন নেই কিংবা এই টার্মটার অস্তিত্ব থাকাটা আসলে অপমানজনক। বর্তমানে এই কথাটা মনে পড়লে আমার নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়। বলাই বাহুল্য, আমার এহেন বোকা বোকা চিন্তাধারার কারণ ছিলো নারীবাদ নিয়ে আমার জানাশোনা না থাকা, একমুখী সংকীর্ণ চিন্তা, সোজা বাংলায় বলতে গেলে সীমাহীন অজ্ঞতা। আমি তাই যখন দেখি কোনো মুক্তমনা মানুষ বলছে ‘আমি নারীবাদী না/নারীবাদে বিশ্বাস করি না’, তখন আমার খুব খারাপ লাগে। কারণ, আমি জানি তারা আসলে প্রতিটা মানুষ সমঅধিকার পাক সেটা মনেপ্রাণে চায়, কিন্তু নারীবাদ সম্পর্কে তাদেরকে সবসময় ভুল বোঝানো ও জানানো হয়েছে বলে তারা নারীবাদকে ঘৃণার চোখে দেখছে।

বিজ্ঞাপন

না, আমি নিজেকে বিজ্ঞ কোনো মানুষ হিসেবে দাবি করছি না, আমি সেটি বিশ্বাসও করি না। নারীবাদ সম্পর্কে আমার এখনও অনেক বেশি জানাশোনা কিংবা পড়াশোনা নেই। তবে আমি এটা মনে করি যে, যতটা অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আমার একটা সময় ‘নারীবাদ’ টার্মটিকে obsolete বা অচল বলে মনে হয়েছিলো, ততটা অজ্ঞতার ছায়া বোধহয় এখন আমার মন-মানসিকতায় নেই। নারীবাদ নিয়ে আমি যতটা জানার চেষ্টা করেছি, যতটুকু সামান্য তথ্য নিজের মস্তিষ্কে ইনপুট দিতে পেরেছি , ততটুকু জানার পর আমি দেখতে পেরেছি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কী নির্মম পুরুষতান্ত্রিকতা বয়ে বেড়াচ্ছে, এই পুরুষতান্ত্রিকতার শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত। বুঝতে পেরেছি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে নারীবাদকে ‘ওমা! ছি!ছি! ঘেন্না!’ বলে আমাদের জুজুবুড়ির ভয় দেখিয়ে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে নারীবাদকে। আমাদের বলা হয়েছে ‘নারীবাদীরা ব্যক্তিগতজীবনে পুরুষের সাথে সুখী থাকতে পারেনি বলে তারা নারীবাদী’, ‘নারীবাদীরা পুরুষের কাছে পাত্তা পায় না বলে তারা নারীবাদী’, ‘নারীবাদীরা সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড (sexually frustrated) বলে তারা নারীবাদী’, ‘নারীবাদীরা দেখতে কুৎসিত(?!) বলে তারা নারীবাদী’, ‘পুরুষের মাথা চিবিয়ে খাওয়াই নারীবাদীদের উদ্দেশ্য’ ইত্যাদি। এভাবে মনগড়া ঘৃণার বুলি দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের শিখিয়েছে নারীবাদকে ঘৃণা করতে। আর আমরাও চোখে ঠুলি এঁটে উল্লসিত হয়ে বুলি শেখা টিয়াপাখির মতো বলেছি ‘নারীবাদ খারাপ’।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, নারীবাদ মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়, নারীবাদ মানে পুরুষকে ঘৃণা করা নয়। নারীবাদ কখনোই মীনাকে বলেনা রাজুর প্লেট থেকে ডিম ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলতে। নারীবাদ বরং চায় মীনা ও রাজু দু’জনেই সমান সমান ডিম পাক। হ্যাঁ, নারীবাদের প্রাথমিক লক্ষ্য এটাই, সমঅধিকার। নারীবাদ এটাই চায় যে Regardless of the sen (লিঙ্গের উর্দ্ধে উঠে), একজন মানুষ শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতাবলে পরিচিতি পাক। নারীবাদ চায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষ সমতা অর্জন করবে। অর্থাৎ, নারীকে তার লিঙ্গ নয়, যোগ্যতা দিয়ে বিচার করতে হবে। আগেই বলেছি, নারী তার যোগ্যতার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত সুযোগ পাক কিংবা অন্য কারো অধিকার ছিনিয়ে নিক, নারীবাদ কিন্তু তা চায়নি, শুধুমাত্র লৈঙ্গিক সমতা স্থাপন করাই তার উদ্দেশ্য ছিলো।

নারীবাদ যদি সমতাই চায়, টার্মটা কেন নারীবাদ, কেন মানববাদ না ?
সমস্যাটা আসলে ঠিক এই জায়গাতেই। আমাদের চরম নারীবিদ্বেষী মন নারীবাদতত্ত্বকে প্রথমেই বাদ দিয়ে দেয়। এর প্রধান কারণ হল, নারীবাদ কথাটার প্রথমে নারী শব্দটুকুর উপস্থিতি। নারীর নাম নেওয়া হয় বলে নারীবাদের ব্যাপারে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের বোঝানো হয়েছে রাক্ষুসী! নারীবাদীদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পৃথিবীকে পুরুষশূন্য করা। নারীর নাম নেওয়া হয় বলেই নারীবাদের মূল ধারণা মূল মতবাদের সাথে এই টার্মটাকে পরস্পরবিরোধী ভাবা হয়, ভাবা হয় নারীবাদ চায় উপরি লাভ পেতে। অথচ আদতে নারীবাদের মূল লক্ষ্য লিঙ্গ বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটন করা। চলুন একটু ভাবি, যেই তত্ত্ব সমতা স্থাপন করতে চায়, সেই তত্ত্ব কি কখনো চাইবে যেকোনো একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ (তা পুরুষ, নারী বা হিজড়া) সবক্ষেত্রে গুরুত্ব পাক? নিশ্চয়ই না। এই যে নারীবাদকে এত নেতিবাচকভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, তার জন্যে দায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজ ও তার অধিপতিরা নিজদেরে শ্রেষ্ঠত্ব ব্জায় রাখার স্বার্থে আমাদের নারীবাদের মূল লক্ষ্য জানা থেকে বঞ্চিত করেছে দিনের পদ দিন।

হাজার-হাজার বছর ধরে নারীর সাথে যে বৈষম্য, অত্যাচার ও নিপীড়ন চলে আসছে তা বোধ করি নতুন করে আর কাউকে বলে দিতে হবে না। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, অধিকাংশ ইতিহাসবিদই নারীকে উপস্থাপন করেছেন রাজা-রাজড়াদের স্ত্রী-কন্যা-মা-বোন হিসেবে। যেন একজন মানুষের ব্যক্তিগত অর্জন কিংবা তার অস্তিত্ব শুধুমাত্র থাকতে পারে একজন পুরুষের সাথে সম্পর্কিত হলেই। খুবই দুঃখের ব্যাপার হলো, হাজার বছর পরেও এই পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে বহু সফল নারীর সাফল্য ও অর্জন ঢাকা পড়ে যায় তার সাথে সম্পর্কিত পুরুষটির পরিচয়ের আড়ালে। শুধু তাই নয়, একজন নারীর অর্জন ও সাফল্যের কৃতিত্ব এমনকি সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত একজন পুরুষও অক্লেশে নিয়ে নেন, ইতিহাস থেকে মুছে যায় এর পেছনে থাকা নারীটির নাম। অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্যে ভারী করা হয় সফল নারীদের নিয়ে করা সংবাদের ওজন। আর এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমরা দেখতে পারি যুদ্ধে, বিজ্ঞানে, ক্রীড়াঙ্গনে, রাজনীতিসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। (চলবে…)

লেখক- তরুণ উদ্যোক্তা (ডিজাইনার ও ফাউন্ডার, ময়নার গয়না)

নারীবাদ নারীবাদী নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষতান্ত্রিকতা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর