Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীদের কেউ ‘দাবায়া’ রাখতে পারবে না


৭ মার্চ ২০১৮ ১২:০৪

বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলমানের তীর্থভূমি সৌদি আরব। ইসলামের এক লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বরের বেশিরভাগের জন্ম আরবে। তারচেয়ে বড় কথা, ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম, বেড়ে ওঠা, নবুয়ত পাওয়া, ইসলামের বিকাশ সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল আরব। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল মদিনা। মহানবীর জন্ম মক্কায়, ওফাত মদিনায়। ধ্যান করতেন হেরা পর্বতের গুহায়। সেখানেই নবুয়ত পেয়েছেন। পবিত্র কোরান নাজেল হয়েছে সেখানেই। পবিত্র কাবা শরিফ মক্কায়, হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর রওজা মদিনায়।

বিজ্ঞাপন

মক্কা-মদিনা এখনকার সৌদি আরবে অবস্থিত। ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি হজ, যা পালন করতে যেতে হয় মক্কায়। এই পূণ্যভূমি সৌদি আরবের প্রতি তাই বিশ্বের মুসলমানদের অগাধ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কাছে সৌদি আরব মানেই অন্যরকম ভালোবাসার নাম।

দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি রাজবংশের রক্ষণশীল শাসনে শাসিত হয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু যুবরাজ সালমান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বদলে যাচ্ছে সৌদি আরব। রক্ষণশীলতার অর্গল ভেঙে সৌদি আরবে এখন বইছে প্রগতিশীলতার হাওয়া। সৌদি রাজবংশের সদস্য এবং আরব শেখদের অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অঢেল অপচয়, কখনও কখনও অনৈসলামিক জীবনযাপনের অভিযোগ থাকলেও সেখানে নারীরা বরাবরই অবগুণ্ঠণে ঢাকা ছিল। সৌদি আরবের নারীদের সাধারণ অধিকার তো দূরের কথা অনেকগুলো মৌলিক মানবাধিকারও ছিল না। সেখানে গত কয়েকবছরে, বিশেষ করে গত একবছরে যেন রীতিমত নারী বিপ্লব ঘটছে। এই নারী জাগরণের প্রতিটি খবরই আমাকে আপ্লুত করেছে, আনন্দিত করেছে।

সম্প্রতি সৌদি আরবে নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে, সৌদি নারীরা এখন স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতে পারবে, কনসার্টে যেতে পারবে, সৌদি সেনাবাহিনীতেও নারীদের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতদিন এসব অধিকার ছিল না, এটা জেনে অনেকে চমকে যেতে পারেন। আসলে তাদের কোনো অধিকারই ছিল না। সৌদি নারীরা ছিল শেখদের হারেমের সৌন্দর্য, নিছকই তাদের যৌনদাসী। তাই এসব সুযোগ পেয়ে সৌদি নারীরা নিশ্চয়ই যুবরাজ সালমানের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। শুধু সৌদি নারীরা কেন, বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে, বিশ্বের সকল নারী, সকল মানুষের পক্ষ থেকে যুবরাজ সালমানকে ধন্যবাদ। আমরা যেমন একটি বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ গড়তে চাই; তাতে বড় অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হবে সৌদি আরবের এই উদার হাওয়া; নিছক হাওয়া নয়, এ আসলে ঝড়।

বিজ্ঞাপন

আমার বিবেচনায় এ ঝড়ের সবচেয়ে বড় ঝাপটার কথাই বলিনি এতক্ষণ। সৌদি নারীদের জন্য এখন আর আবায়া বা বোরকা পরা বাধ্যতামূলক নয়। সৌদি নারীদের এতদিন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা যে পোশাক পড়ে চলাফেরা করতে হতো, তাকেই আবায় বলে। বাংলাদেশে আমরা যেটাকে বোরকা হিসেবে চিনি। এটা এতদিন আইনী বাধ্যবাধকতা ছিল। সৌদি আরবের ‘কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারস’ বা সবচেয়ে সিনিয়র ধর্মীয় চিন্তাবিদদের কাউন্সিলের সদস্য শেখ আবদুল্লাহ আল মুতলাক সম্প্রতি এ বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছেন। তবে নারীদের আব্রু বজায় রেখে পোশাক পরতে হবে। আব্রু বজায় রেখে পোশাক পরা শুধু সৌদি আরব নয়, সব দেশের নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবে শুধু নারীদের কেন, সব মানুষেরই শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পড়া উচিৎ। কারণ, পোশাক সভ্যতার জন্য। বন্য পশু পোশাক পরে না, মানুষ পরে, কারণ মানুষ সভ্য। তবে পোশাক মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। এটা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বদলে যায়। শীতকালে আপনি যেমন হাফপ্যান্ট পরে ঘুরবেন না, গরমেও নিশ্চয়ই আপনি ওভারকোট পরে হাঁটবেন না। বিকিনি পরে যেমন অফিস করবেন না, তেমনি শাড়ি পরে নিশ্চয়ই সমুদ্রে যাবেন না।

সৌদি নারীদের আবায়া পরার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়াকেই আমি এই ঝড়ের সবচেয়ে বড় ঝাপটা বলছি, কারণ যুগ যুগ ধরে বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মুসলিম নারীদের অবগুণ্ঠনের আড়ালে রাখার চেষ্টা হয়েছে, উন্নয়নের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা হয়েছে। সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা যখন নারীদের বোরকা পরার বাধ্যবাধকতা তুলে নেন, তখন বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা আল্লামা শফির নারীদের বিষয়ে ভাবনা কী?

আল্লামা শফির কাছে নারী তেঁতুলের মত, যাদের দেখলে তার লালসার লালা ঝরে। তিনি মনে করেন, নারীদের ‘কেলাশ ফোর ফাইভ’ পর্যন্ত পড়লেই যথেষ্ট, যাতে তারা স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। নারীদের উপার্জনকে তিনি মনে করেন হারাম। বাংলাদেশের মুসলমানরা কার কথা মানবেন, সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতার নাকি বাংলাদেশের শফি হুজুরের?

আমি সবসময় বলি পোশাক মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ। সবারই নিজ নিজ পছন্দের শালীন পোশাক পরার অধিকার আছে। কেউ যদি বোরকা পরেন তাতে আমার আপত্তি নেই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, আমার মা বোরকা পরেন। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। দেখতেও ভালো লাগে। কিন্তু কেউ যদি বোরকা না পরে তাতেও আমার আপত্তি নেই। পোশাকের প্রসঙ্গটা আসলো, কারণ ইদানীং বাংলাদেশে এক নতুন ফ্যাশন হয়েছে হিজাব। আগেই বলেছি, পোশাক নিয়ে আমার ছ্যুৎমার্গ নেই। কেউ যদি হিজাব পরেন; সেটা ধর্মীয় কারণেই হোক আর ফ্যাশনের কারণেই হোক; আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু হিজাবের বহুল ব্যবহারেই বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে আমরা বদলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সৌদি আরবের নারীরা যখন অবগুণ্ঠন ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, তখন কি আমরা আরো বেশি আড়াল করে রাখছি নিজেদের? সৌদি আরব যখন এগুচ্ছে, আমরা কি তখন পিছিয়ে যাচ্ছি?

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় ভোরবেলায় গেলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের মিছিল যেন বাংলাদেশের অগ্রগতিরই চিত্র। কিন্তু সম্প্রতি সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। আমি বলছি না, শফি হুজুরের কথা শুনেই বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন। কিন্তু নারী শ্রমিক কমে যাওয়াটা খুবই শঙ্কার। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ইদানীং ঢাকার রাস্তায় স্কুটিচালক মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবা ‘পাঠাও’এও নারী চালক আছে। কখনো কখনো দেখি মোটর সাইকেল চালাচ্ছে নারী, পেছনে যাত্রী পুরুষ। ঢাকার রাস্তায় যখন নারীরা সাহসের সাথে মোটর সাইকেল চালিয়ে ধুলা উড়িয়ে চলে যায়, আমার সব শঙ্কাও উড়ে যায়। আমি আশ্বস্ত হই, আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমাদের নারীদের কেউ ‘দাবায়া’ রাখতে পারবে না

 

সারাবাংলা/এসএস

আবায়া গাড়ি চালানো নারী প্রভাষ আমিন বোরখা সৌদি আরব সৌদি নারী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর