‘কোচ ২৪১৯ডি’ ও হিটলারের মধুর প্রতিশোধ
১১ জুলাই ২০২০ ১৬:৫৯
২৩ জুন, ১৯৪০। প্যারিসবাসীর জন্য স্মরণীয় এক দিন। তবে আনন্দের নয়, দিনটি তাদের জন্য লজ্জার আর অপমানের। প্যারিসের বুকে সেদিন বেড়াতে এসেছেন সদ্য প্যারিসবিজয়ী জার্মান শাসক অ্যাডলফ হিটলার। জীবনের একমাত্র প্যারিস ভ্রমণে হিটলার ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে। প্যারিসের সৌন্দর্য হিটলারকে মুগ্ধ করেছিল। শোনা যায় দেশে ফেরার পর প্যারিসের চেয়েও অপরূপ এক নগরী তৈরী করতে চেয়েছিলেন হিটলার। তবে বিধাতা তার উপর প্রসন্ন না হওয়ায় হিটলারের এ ইচ্ছেটি পূরণ হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে বিধাতা অবশ্য তার উপর বেশ প্রসন্নই ছিলেন। ভাগ্যবিধাতার কৃপায় প্যারিস ভ্রমণের দুদিন আগে রেলগাড়ির এক ডাইনিং কারে বসে হিটলার নিয়েছিলেন তার জীবনের মধুরতম প্রতিশোধটি। এই মধুর প্রতিশোধটি নেওয়ার জন্যই হিটলার ছুটে এসেছিলেন ফ্রান্সের মাটিতে।
প্যারিস পতন হওয়ার পর নতজানু ফরাসি সরকার ১৯৪০ সালের জুন মাসে হিটলারের কাছে যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করে। যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য হিটলার নিজেই গেলেন ফ্রান্সে। ফ্রান্স যাত্রার আগেই তিনি জানিয়ে দিলেন কোথায় বসে তিনি আলোচনা করবেন। হিটলারের ইচ্ছে পূরণের জন্য প্রথম মহাযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত রেলওয়ের একটি ডাইনিং কারকে জাদুঘর থেকে বের করা হয়। ডাইনিং কারটির সিরিয়াল নম্বর ২৪১৯ডি। জাদুঘর থেকে বের করার পর ডাইনিং কারটিকে ঠিক সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে এটি প্রায় বাইশ বছর আগে ১৯১৮ সনের ১১ নভেম্বর ভোর পাঁচটার সময় অবস্থান করেছিল।
১৯৪০ সালের ২১ জুন হিটলার আলোচনার জন্য ডাইনিং কারটির সাথে উপস্থিত হন। ভেতরে প্রবেশ করার আগে কিছুক্ষণ নীরবে ডাইনিং কারটির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। তারপর সদলবলে ভেতরে ঢুকে তার জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে পড়লেন। হিটলারের অভিপ্রায় অনুযায়ী তাকে ঠিক সেই চেয়ারটিতেই বসতে দেওয়া হয়েছিল যেখানে ১৯১৮ সনের ১১ নভেম্বর ফরাসি সেনাধ্যক্ষ মার্শাল ফার্ডিনান্দ ফোচ বসেছিলেন। ডাইনিং কারের ভেতর দুইটি ভিন্ন সময়ে বসে থাকা হিটলার ও ফোচের মধ্যে একটা জায়গায় বেশ মিল ছিল। তারা উভয়েই আলোচনায় বসেছিলেন বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে। পার্থক্য হল তারা দুজন দুটো বিপরীত পক্ষ থেকে বিজয়ীর বেশে ডাইনিং কারে বসেছিলেন।
চিত্র: ১৯৪০ সালে একই ডাইনিং কার থেকে বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে যাচ্ছেন হিটলার
ফরাসি রেলওয়ের ২৪১৯ডি সিরিয়ালের ডাইনিং কারের ভেতর দু-দুটো ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রথমটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। প্রথম মহাযুদ্ধের এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য জার্মান সরকারের তরফ থেকে জার্মান মন্ত্রী ম্যাথিউস এরসবার্গারের নেতৃত্বে এক জার্মান প্রতিনিধি দলকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। শুরুতে ঠিক হয়েছিল, আলোচনাটি কম্পেনিয়ান শহরে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ওখানে জার্মানদের হাতে নিহত ফরাসিদের স্বজনরা প্রতিনিধি দলের উপর আক্রমণ চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য মিত্রবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ফরাসি সেনাধ্যক্ষ মার্শাল ফার্ডিনান্দ ফোচের নিদের্শে আলোচনার স্থান হিসেবে রেলওয়ের একটি ডাইনিং কারকে প্রস্তুত করা হয়। ১৯১৮ সনের ৮ নভেম্বর জার্মান প্রতিনিধি দলসহ উভয় দলের প্রতিনিধিদেরকে ডাইনিং কারে তুলে নিয়ে একটি ট্রেন পাশ্ববর্তী বনভূমির জনবিরল এলাকায় চলে যায়। ফরাসি মার্শাল ফোচ প্রথম দিনই মিত্র পক্ষের প্রস্তাবিত শর্তসমূহ উপস্থাপন করেন এবং শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য বাহাত্তর ঘন্টার সময় বেঁধে দিয়ে ডাইনিং কার ত্যাগ করে চলে যান। জার্মান প্রতিনিধি দলকে শর্ত নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগই দেওয়া হয়নি। জার্মান মিত্র বাহিনীর সকল শর্ত মেনে নিলে ১৯১৮ সনের ১১ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় ডাইনিং কারের ভেতর যুদ্ধবিরতির এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নিজেদের বিজয়কে কাব্যিক ঢঙ এ উপস্থাপনের জন্য ফরাসিরা তখনই চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ না করে সকাল ১১ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। ১৯১৮ সনের ১১ নভেম্বর সকাল ১১ টায় চুক্তি কার্যকর হওয়ার সংবাদটি প্রচার করা হয়। মহাযুদ্ধ শেষে ডাইনিং কারটি পরিণত হয় ফরাসিদের বিজয়ে স্মারকে। তারা এই স্মারকটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে।
চিত্র: প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ডাইনিং কারের সামনে বিজয়ীর বেশে ফরাসি সেনা অফিসাররা
রাজনীতির ময়দানে হিটলার প্রথম মহাযুদ্ধে ফরাসিদের চাপিয়ে দেওয়া অপমানকর শর্তগুলোকে বারবার নিজের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তাই ফরাসিদেরকে অপদস্থ করার সুযোগ পেয়ে আলোচনার জন্য তিনি স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ডাইনিং কারটিকেই বেছে নেন। ১৯৪০ সনের ২১ জুন ডাইনিং কারটিতে যেন ১৯১৮ সনের ১১ নভেম্বরের অনুষ্ঠানটিকেই পুনরায় মঞ্চায়ন করা হয়। ডাইনিং কারের ভেতর হিটলার সেই আচরনই ফরাসিদের সাথে করেন যা ফরাসি সেনাধক্ষ্য মার্শাল ফোচ ১৯১৮ সনে জার্মানদের সাথে করেছিলেন। শুরুতেই জার্মানদের সকল দাবি উপস্থাপন করা হয়। শর্ত উপস্থাপিত হওয়ার পর হিটলার ফোচেকে অনুকরন করে ডাইনিং কার থেকে বেরিয়ে যান। জার্মানের শর্তে রাজী হয়ে ১৯৪০ সনের ২২ জুন ফ্রান্স তাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর হিটলারের নিদের্শে ডাইনিং কারটিকে বার্লিন নিয়ে যাওয়া হয়। জার্মানদের প্রতিশোধের স্মারক হিসেবে ডাইনিং কারটিকে বহুদিন বার্লিনের রাস্তায় প্রদর্শন করা হয়। যুদ্ধের শেষ দিকে হিটলারের পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত তখন নাৎসীরা ডাইনিং কারটি ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে ফরাসী কোম্পানি ওয়াগন লিটস হুবহু একই মডেলের আরেকটি ডাইনিং কারকে ফ্রান্সের জাদুঘরে দান করে। নতুন এই ডাইনিং কারটির সিরিয়াল নম্বর ছিল ২৪৩৯ডি।
চিত্র: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ধ্বংসের আগে বার্লিনের রাস্তায় ডাইনিং কারটি প্রদর্শন করা হয়