নির্বাচন বিধি পরিবর্তন নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থী
২৩ জুলাই ২০২০ ১৯:৩৫
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ মানুষের অধিকার আদায়ের সব রাজনৈতিক সংগ্রামে এ দেশের নারী সমাজ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এ দেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলনেও নারী শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন বয়সী নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
শুধু একালেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ হয়েছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্রগ্রামে যে বিরাট বিদ্রোহ হয়, তারই শরিক ছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা, কল্পনা সেন, সাবিত্রী দেবীসহ আরও অনেকে।
সূর্যসেনের নির্দেশে প্রীতিলতা চট্রগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অভিযান সফল হয়েছিল। কিন্তু আহত হয়ে যাওয়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে বিপ্লবী দলের নিয়ম মোতাবেক সঙ্গে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনিই ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হওয়া প্রথম নারী। বিপ্লবী দলে প্রথমে নারীদের নেওয়া হতো না। কিন্তু প্রীতিলতা অনেক তর্ক-বিতর্ক করে মাস্টারদা সূর্যসেনকে রাজি করান তাকে দলে নেওয়ার জন্য। এভাবেই নারীদের দলে নেওয়া শুরু হয়। তার যুক্তি ছিল— ছেলেরা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারলে, প্রাণ দিতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না? ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযান চালিয়ে এবং প্রাণ দিয়ে প্রীতিলতা সেই সত্যকে প্রমাণ করে গেছেন। এখানে আরও অনেক নারীর অংশগ্রহণের কথা বলা যায়। আমি এখানে শুধু প্রতীকীভাবে একটি নাম উল্লেখ করলাম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে রান্না করে খাবার জোগান দিয়েছেন, কেউ লুকিয়ে রেখেছেন, কেউ অসুস্থের সেবা করেছেন, কেউ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বলা হয়ে থাকে, ৩০ লাখ শহিদের বিনিময়ে এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। বস্তুত শহিদের এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ৯ মাসে বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর ঘরে ঘরে নারীদের ওপর বর্বর নির্যাত চালায়ন। তারা সব বয়সী নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখে। তারা যে বর্বর নৃশংস ও বীভৎস নির্যাতন চালায়, ইতিহাসে তার নজির খুবই কম।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে সমাজ গবেষণায় দেখা গেছে, দুই লাখ নয়, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা ৬ লাখও হতে পারে। নারীদের এত বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি?
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যেখানে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণিপেশা ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা আগের চেয়ে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশকিছু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার আগের চেয়ে কমেছে। স্কুলে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সাহায্য করেছে ছাত্রী উপবৃত্তি। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভন্ন ক্ষেত্রে পরিচয়ের ক্ষেত্রে মায়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিধান চালু হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। লাখ লাখ নারী এখন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এই অগ্রগতি কিন্তু যথেষ্ট নয়। একদিকে যেমন এই অগ্রগতি হয়েছে, অন্যদিকে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। বরং শিশু ধর্ষণ এবং হত্যা আতঙ্কজনক হারে বেড়ে গেছে। গত ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা চারশরও বেশি।
আর বর্তমানে যে করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, এই সংকটের মধ্যেও ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। নারী ও শিশুরা যারা ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, তারা পুরুষের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বাঁচারও কোনো উপায় নেই।
করোনাভাইরাস প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপীই করোনাকালে নারী নির্যাতন বেড়েছে।
নারী নির্যাতন বিষয়ে সরকার, সমাজ ও নাগরিক সমাজের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা ভাবা উচিত। এই পরিস্থিতির অবসানের জন্য প্রয়োজন আমাদের চিন্তার পরিবর্তন। এ জন্য শুধু নারী শিক্ষার প্রসারই যথেষ্ট নয়, পুরুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার এবং সবার মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালানো প্রয়োজন। প্রয়োজন সচেতনতা। নারীরাও যে মানুষ— এই বোধ নারী-পুরুষ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। আর এজন্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর জোরালো উপস্থিতি প্রয়োজন। আর সেটি নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেই।
বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারপ্রধান নারী, স্পিকার নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী। তারপরও আমরা নারী নির্যাতন হতে দেখছি। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। প্রয়োজন জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান, সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা। তার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে পিছিয়ে থাকা নারীদের সামনে এগিয়ে আনতে হবে। তারপর নারীর ক্ষমতা, দক্ষতা বাড়াতে হবে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। অন্যদিকে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ জোরালোভাবে বাড়াতে হবে। একেই বলা হচ্ছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।
বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার বছর ধরে নারীকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। এর অবসানের জন্যই জাতিসংঘ নারীবর্ষ, নারী দশক পালন করেছে। এই উপলক্ষে করেছে বিশ্ব নারী সম্মেলন। বেইজিংয়ে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে (১৯৯৫) ১২টি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় নির্ধারণ করা হয়। তার মধ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অন্যতম।
এই সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের জাতীয় সংসদে মোট আসনেরর এক-তৃতীয়াংশ পদে নারী থাকতে হবে। সংসদে ১০ জন বা ৩০ জন সদস্য হলেই আমাদের আত্মসন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই।
জাতিসংঘের এই ঘোষণা এবং তার পরবর্তী নারী আন্দোলন এই দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের বিধিমালায় সব রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সব পর্যায়ের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীদের নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয় ২০০৮ সালে। কমিশনের কাছে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য এটি ছিল বাধ্যবাধকতা ও পূর্বশর্ত। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়ে ২০২০ সালের মধ্যে এই শর্ত পূরণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এই শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু এখন সময়সীমা শেষ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেউই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেনি। আর নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি না করে, নতুন সময়সীমা বেঁধে না দিয়ে এখন সময়সীমাই তুলে দিতে চাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন এখন তাদের বিধিমালায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই নতুন বিধিতে কোনো সময়সীমাই উল্লেখ থাকবে না। এটা হলে নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া যতটুকু এগিয়েছিল, তা আবার পিছিয়ে যাবে। অগ্রযাত্রা হবে উল্টোযাত্রায়।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে এরই মধ্যে এই প্রস্তাবিত নতুন বিধান দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯০ নম্বর বিধিতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। ৯০খ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, তিনটির যেকোনো একটি শর্ত পূরণ করলেই চলবে। আর সেখানেই জায়গায় পেয়েছে রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বিধান। তাই এটি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ঐচ্ছিক বিধান হয়ে গেল। এই বিধান যেখানে নারী ক্ষমতায়নের পক্ষে কাজ করছিল, বিধানটি তুলে দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিল।
মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যথাযথভাবে বৃদ্ধি করে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শক্তিশালী করতেই হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন এই বিধানকে অবশ্য পালনীয় হিসেবে রাখা।
অঞ্চলভিত্তিকভাবে নারীদের স্বাবলম্বী না করতে পারলে আমরা জাতি হিসেবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে না পারলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। নারী নির্যাতনও বন্ধ করতে পারব না। আর নারী নির্যাতন বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সব উন্নয়ন, সব অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে।
রাজনৈতিক দলের কমিটিতে সব পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী নির্বাচিত করতে হবে। তাই সময়সীমা তুলে দেওয়া যাবে না। বরং সময়সীমা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের কাজ। জাতীয় সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য যেন নারী হয়, তাও নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বলে মনে করি। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই তার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক নারীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই এই বাংলাদেশ আমাদের প্রাপ্য নয়। নারীসমাজ এটা মেনে নেবে না।
রাজনীতিতে নারীদের উৎসাহিত করতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং তাদেরও দায়িত্ব দিতে হবে। দিতে হবে পর্যাপ্ত সুযোগ।
নারীদের পেছনে রেখে বিশ্ব এগিয়ে যেতে পারবে না। দেশও এগিয়ে যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ কথা মনে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও তা আশা করি মনে রাখবে।
লেখিকা- সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র