অসহায় আকুতি নয়; বরং প্রতিরোধ
৮ মার্চ ২০১৮ ১২:০২
পৃথিবীর অনগ্রসর এলাকাগুলোতে নারীর পক্ষে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে হাঁটাই যখন অনিরাপদ আর অস্বস্তিকর; সেখানে নারীর অগ্রসর হবার বিষয়ে যে কোন আলোচনাই সোনার পাথর বাটি মনে হয়। প্রতিটি পরিবারের মনে শৈশবে শোনা রাক্ষসের গল্পের মতোই একটি মিথ বিরাজ করে, বাড়ির বাইরে পুরুষ রাক্ষস থাকে। তাই নারীদের ঘরে থাকাই ভালো; বাইরে গেলে খুব সাবধানে থাকতে হবে। সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী তড়িঘড়ি ঘরে ফিরতে হবে।
কোন মেয়েকে পথে দেখলে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকাটা পুরুষদের একটা অবশ্য কর্তব্যের মাঝে পড়ে যেন। নারীদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকাটা কোন জনপদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। অগ্রসর পৃথিবীর পুরুষেরা যখন মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে; তখন অনগ্রসর পৃথিবীতে শুধু এই নারীর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকার পেছনে পুরুষের বিপুল কর্মঘন্টা অপচয় হয়।
এরপর এই মনোবিকৃতির অন্যান্য যে ক্রিয়াকলাপ; বাসে উঠে অতি-কৌশলে নারী শরীর স্পর্শ করার যে কসরত; নারীকে রাস্তায় একা পেয়ে জাপটে ধরার ফন্দি আঁটা; বাজারে-মেলায়-যে কোন ভিড়ের মধ্যে নারীর শরীরে হাত-চালান করে দেয়া; এই যে আজো সভ্যতার কস্টিউম পরে অসভ্য আচরণ; এসবের চেয়ে বড় অনগ্রসরতার সূচক তো থাকতে পারে না। অনগ্রসর সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে; আদিম-মানসের সমস্যা জর্জরিত পুরুষের আচরণ সংস্কার না করে উলটো নারীকে নিজেকে ঢেকে-ঢুকে রাখতে বলা; পারলে অসূর্যস্পর্শা হতে নির্দেশ দেয়া।
অনগ্রসর সমাজের মাতবরেরা নিজেদের জানার বাইরের পৃথিবীকে অস্বীকার করে। নিজের কোণা-কাঞ্চিকেই সকল জ্ঞানের আধার বলে মনে করে। ফলে অগ্রসর সমাজে নারী যে পুরুষের সমান্তরালে সমান অধিকার বা মানুষের অধিকার ভোগ করছে, সেই বাস্তবতাকে বিন্দুমাত্র না বুঝে নাকচ করে দেয় অনগ্রসর সমাজের পঞ্চায়েত প্রধানরা। কারণ এদের কাছে ইংরেজি নাটক-সিনেমা-মিউজিক ভিডিও-বিজ্ঞাপনে দেখা পশ্চিম, কিংবা দু’দিনের জন্য পশ্চিমে ঘুরতে গিয়ে সে সমাজকে বুঝতে না পারা , কিংবা সারাজীবন পশ্চিমেই নিজের অনগ্রসর চিন্তার বস্তির ঘিঞ্জিতে বসবাস করে সন্দেহের চোখে দেখা পশ্চিমই অগ্রসরতা সম্পর্কে একটি প্রাচীন ভীতি তৈরি করে। এর ফলে অনগ্রসর সমাজের পুরুষেরা পশ্চিমকে বেলেল্লাপনার দুনিয়া বলে রায় দিয়ে ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকে। আর অনগ্রসর সমাজের অগ্রসর সাজা নারী-পুরুষও কেবল পশ্চিমা পোশাক পরে কফি খাওয়া আর বেশি বেশি ইংরেজি বলাটাকেই নিশ্চিত অগ্রসরতা বলে জ্ঞান করে।
অথচ অগ্রসর সমাজের যে মূল বৈশিষ্ট্য নারী-পুরুষ উভয়ের ব্যক্তি হিসেবে বিকাশ, মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন, নারীর জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা। এগুলো অনুধাবনের ক্ষমতা অনগ্রসর সমাজের আজো হয়নি।
অগ্রসর সমাজে নারী-পুরুষের সম্মিলিত জনশক্তি সক্রিয়। অথচ অনগ্রসর সমাজে জনসংখ্যার অর্ধেক শক্তি নারীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার অচল চিন্তাগুলো ক্রিয়াশীল। চিন্তার ক্ষেত্রে কারো পিছিয়ে থাকাটা দোষ নয়, বরং এটা তার নিয়তি। কিন্তু এই পিছিয়ে থাকা চিন্তাকে আদর করে লালন করাটা আত্মঘাতি। শুধু আইন করে বা বুঝিয়ে পুরুষের নারীকে উত্যক্ত করা, গায়ে হাত দেয়া, নির্যাতন, এসিড ছোড়া বা ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো সমাজ থেকে দূর করা কঠিন হবে।
পাকিস্তানের অনগ্রসর সমাজে দু’টি সাম্প্রতিক কেসস্টাডিতে দেখা গেল, পথে এক তরুণ একটি তরুণীকে অশালীন ইঙ্গিত করায় তরুণী তরুণটিকে শার্টের কলার ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়ে দিল। এই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ায় বিপুল সংখ্যক তরুণী ভবিষ্যতে হাত গুটিয়ে অপমান হজম না করে উল্টো অপরাধীকে পিটিয়ে দেবার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হলো।
আরেকটি ঘটনায়, হাসপাতালে এক পুরুষ সহকর্মী এক নারী নার্সের গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করায় সংঘবদ্ধভাবে অন্যান্য নারী নার্সরা পুরুষ সহকর্মীকে পিটিয়ে দিয়েছে। এইসব দৃষ্টান্ত আদিম চিন্তার পুরুষদের জন্য অশনি সংকেত।
বলিউডের দাঙ্গাল ছবিটিতে দুজন তরুণীর রেসলিং শিখে তরুণদের পরাজিত করা কিংবা বাস্তবের বাংলাদেশের কলসিন্দুর গ্রামের তরুণীদের ফুটবল খেলা শিখে শারীরিকভাবে ক্ষমতায়িত হবার উদাহরণগুলো অনুপ্রাণিত করে। কন্যাশিশুদের জীবনের প্রথম পাঠ শরীরচর্চা ও আত্মরক্ষাকৌশল শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের নীতি নির্ধারকদের সক্রিয়তা খুবই জরুরী। নারী সমাজ তাকে বাঁচানোর জন্য সমাজের কাছে বার বার অসহায় আকুতি জানাবে এই পুনরাবৃত্তিকর দৃশ্যে কোন সমাধান নেই। নারী শারীরিকভাবে দুর্বল এই নারীনির্যাতন বান্ধব মিথটি ভেঙ্গে দেয়াই সময়ের দাবী।
[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]
সারাবাংলা/এসএস