‘মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না’
৮ মার্চ ২০১৮ ১২:৩৩
[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’। এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]
।। গীতি আরা নাসরীন।।
আমার কাছে সফল শব্দটি অস্বস্তিকর, তবে সংগ্রামী কথাটা ঠিক। আমরা সবাই কোন না কোন সংগ্রামে রত। আমার জন্যে শুধু নিজের কাজে নয় অন্য অনেক মানুষের জন্যেও সুযোগ তৈরি করার কাজটি করতে পারাই সফলতা।
নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে আমি খুবই আনন্দিত। নারীবাদী লেখিকা বেল হুকসের মতে, প্রান্তিক অবস্থায় থাকাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমিও তার সাথে একমত, কারণ যতক্ষণ আমরা প্রান্তিক অবস্থানে থাকি ততক্ষণ আমাদের মধ্যে একটা প্রতিবাদের প্রতিরোধের ব্যাপারটা থাকে। আমি যত কেন্দ্রে যাবো তত আমি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব। আমি অনেকদিক থেকে প্রিভিলেজড অবস্থানে আছি বলে আমি মনে করি। আমি এইদেশে সংখ্যাগুরুর যে ধর্ম সেই ধর্মীয় পরিবারে জন্মেছি। আর্থিক দিক থেকে আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে জন্মগ্রহন করেছি, সেটি আরেকটি সুবিধাজনক অবস্থান। আমি সমতলের মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছি। এই দেশের সংখ্যাগুরু জাতি বাঙালিদের একজন আমি। তাই অন্যান্য প্রান্তিক মানুষদের কোন সমস্যাই আমাকে পোহাতে হয়নি। সেইদিক থেকেও আমি প্রিভিলেজড।
আমি যেহেতু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন ব্যাপারটাকে আমি অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখি। পরিবর্তনের জন্যে যোগাযোগ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বড় হবার সাথে সাথেই আমাকে নিজের নারী পরিচয়টি নিয়ে সচেতন হয়ে যেতে হয়েছিল। মূলত আমি যে একজন নারী সেই বিষয়টি বারবার আমাকে মনে করিয়ে দেয়া হত।
আমার কৈশোরের শুরুতেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন সময় পার করেছি। তখন প্রথম আমি ধর্ষণ শব্দটির সাথে পরিচিত হই। সেই বয়সে আমাদেরকে সারাক্ষণই এই ধরণের ভয় ভীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সেই সময়কার যে ট্রমা যে আমি যে কোন সময় ধর্ষণের স্বীকার হতে পারি এটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। বহু বছর ধরেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম। সেটাই আমার প্রথম নারী হিসেবে সমাজ ও রাজনীতির মুখোমুখি হওয়া।
এরপর বড় হতে হতে দেখা গেল আমার পরিসর কমে যাচ্ছে। বাইরে যাওয়া বন্ধ, পোশাক আশাকের ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ যুক্ত হল। আস্তে আস্তে আমার হাতে পায়ে একটা একটা করে শেকল পড়ছিল এবং আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছিল যে আমি নারী। যথেষ্ট শিক্ষিত একটি পরিবারে বড় হবার পরেও ব্যাপারটা এমন ছিলো যে উচ্চশিক্ষা পাবার যে সুযোগটি আমি পাচ্ছি সেটা আমার জন্যে একটা বাড়তি সুবিধা, সেটি আমার অধিকার নয়।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই আমার বড় বোনকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের অনেক চাপ থাকে একটা মেয়ের দ্রুত বিয়ে হয়ে যাবার পেছনে। সেরকম একটা সময়ে আমি যে পড়াশুনার ‘সুযোগ’ পাচ্ছিলাম সেটি আমার অধিকারের চেয়েও বেশি মনে করা হত আমি ‘বাড়তি সুবিধা’ পাচ্ছি। আমার বোন দুঃখ করে বলতো, “তোকে তো পড়তে ‘দেওয়া’ হয়েছে”। অর্থাৎ পড়াশুনাটা আমার ঠিক অধিকারের বিষয় নয়, কেউ দিলেই তবে আমি পড়তে পারবো ব্যাপারটা এমন ছিলো। আমার যোগ্যতা আমার চেষ্টা সেসব ছিল গৌণ বিষয়।
যেসব বিষয় নিয়ে আমি সমালোচনা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি তার মধ্যে একতা অন্যতম বিষয় ছিলো আমার বন্ধুরা। ছেলে মেয়ে সবার সাথেই আমি সমানভাবে মিশতাম, আমার বন্ধুদের মধ্যে উভয়েই ছিলো। সেটা সেই সময় খুব প্রশ্নবিদ্ধ একটা ব্যাপার ছিলো। আমার মনে আছে আমার ডিপার্টমেন্টের এক সহপাঠী বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমরা যারা এত ‘ফ্রি’ তারা কি যৌনতার দিক থেকেও এত উন্মুক্ত কি না”। এটি ছিলো ১৯৭৯ সালের ঘটনা। এখন আমি মনে করি বন্ধুদের এই সম্পর্কটা স্বাভাবিক চোখে দেখা হয়।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি তখন ডাকসু ছিলো। আমার মনে হয় যে সে সময় শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বেশ সক্রিয় ছিলো। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি জানার সুযোগ পায় এবং অনেক জানে তাই তারা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি চটপটে। পড়াশুনার পরে আসে আমাদের ক্যারিয়ারের বিষয়টা। নারীদের ক্যারিয়ার নিয়ে সে সময় চিন্তাই করা হতনা। আমি খুব ঘুরতে পছন্দ করতাম। সবাই বলতো ওকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে যে বিদেশে থাকে। অর্থাৎ নারী হিসেবে আমি যা করতে চাই তা বিয়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে এমনটাই মনে করা হত। এখন পৃথিবীর প্রায় ৫০টার মত দেশে আমি ঘুরেছি নিজের যোগ্যতাতেই, বেশিরভাগ জায়গায় একাই ঘুরেছি। সেসময় চিন্তাটাই এমন ছিলোনা যে একটা মেয়ে একা একা বিদেশে ঘুরে বেড়াবে। এসব দিক দিয়েও আমি বলবো আমার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে আমি প্রিভিলেইজড ছিলাম। কারন আমি পড়াশুনা শেষ করে, কর্মক্ষেত্রে ঢুকে তারপর নিজের পছন্দ অনুযায়ী নিজের সুবিধামত সময়ে বিয়ে করেছি।
সেভাবে বলতে গেলে আমার পেশাটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং ছিলোনা। শিক্ষকতাটা তো খুব গ্রহণযোগ্য পেশাই। সেদিক থেকে আমি আসলে খুব ভয়ঙ্কর কোন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছি বলে আমার মনে হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি আমার কাজ হল ছাত্রদেরকে প্রশ্ন করতে শেখানো। যে পৃথিবীতে আমি থাকি সেই পৃথিবীতে প্রশ্ন করতে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমার জন্যে।
প্রশ্ন করা, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো সেটি আমার শিক্ষকতারই একটা অংশ। আমার অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে ওঠা সেটিও আমি মনে করি পরিপূর্ণ শিক্ষক হবারই একটা অংশ। আমি মনে করিনা যে আমি এমন একটা দেশে বা সমাজে বাস করি যেখানে শিক্ষক বলে আমার কাজ হবে শুধু চেয়ারে বসে বসে বই পড়া। এটা সম্ভব না। তখনই আমি নিজেকে বিফল মনে করবো যখন আমি প্রশ্ন করা বন্ধ করবো। আর নিজেকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে সরিয়ে কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাইবো তখনই আমি ব্যর্থ হব।
নারীরা উচ্চশিক্ষাতে এসেছেনই অনেক পরে। তাই নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় হয়তো এখনো তাদেরকে খুব বেশি দেখা যায়না। এখন আমরা জুনিয়র লেভেলে অনেক বেশি নারী শিক্ষক দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রশাসনিক পর্যায়ে গিয়ে সেই পরিমান নারী দেখছিনা। এর মধ্যে আমি খুব স্পষ্টভাবেই একটা জেন্ডার পলিটিক্স দেখতে পাই। অনেক যোগ্য নারী আছেন তারা আসতে পারেন। অথচ এখনো মনে করা হয় এই জায়গাগুলো শুধু পুরুষের জন্যেই বরাদ্দ। এছাড়া দলীয় রাজনীতির প্রভাবও এর মধ্যে আছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক পদে নারীকে অনেক কম দেখতে পাই আমরা।
নারীদের এগিয়ে যাবার ব্যাপারটা কখনোই সহজ ছিলোনা। এখনো সেটি সহজ হয়নি। তবে এখন মেয়েদের চিন্তার জায়গাটা আরো পরিষ্কার হয়েছে। এখন প্রচুর মেয়েরা তাদের প্রতি যে বৈষম্য সেসব নিয়ে চিন্তা করছে, কথা বলছে। এটা একটা বেশ বড় ব্যাপার। এখন বিভিন্ন মাধ্যমে মেয়েদেরকে অনেক বেশি লিখতে দেখছি আমরা। এখন সহিংসতা অনেক বেড়েছে সেটা ঠিক, তবে সহিংসতা বাড়াটাও নারী যে বাইরে কাজ করছে তার অন্যতম প্রমাণ। একইসাথে এই সহিংসতাগুলোকে আমরা চিহ্নিত করছি। এটাও অনেক বড় ব্যাপার। এখন আমরা যৌন নিপীড়ন বলে যে একটি শব্দবন্ধ আছে সেটি বুঝতে শিখেছি। আগে আমরা এই যৌন নিপীড়নকে ‘ছেলেরা এরকম একটু করবেই’ বলে ছেড়ে দিতাম।
সহিংসতা কমাতে অবশ্যই রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়া নিয়ে যে সবাই হইচই করছে আমি কিন্তু এটিকেও ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ার মানে হচ্ছে আগে পরিবারে নির্যাতনগুলো মেয়েরা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করত এখন আর সেটা করছেনা। নারীদের সংগ্রামের জায়গাটা অবশ্যই অনেক কঠিন এবং পথটা অনেক লম্বা। বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা বঞ্চনার দেয়াল একরাতেই ভাঙ্গা যাবেনা। কিন্তু সংগ্রামটা চালিয়ে যাওয়াটাই অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের আগের নারীদের অনেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই আজ আমরা এতদুর আসতে পেরেছি। এরপরে আমরা আরো সামনে যাবো, এই বিশ্বাস আমার রয়েছে।
https://youtu.be/LLLHnyLni-4
অনুলিখনঃ জান্নাতুল মাওয়া
অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে
যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত
মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম
সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে
লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের
নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি
সারাবাংলা/এসএস