Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম’


৮ মার্চ ২০১৮ ১৪:২৬

[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’।  এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]

বিজ্ঞাপন

।। তাহসিনা শাহীন ।।

আজকে এই চেয়ারটায় যে বসে কথা বলছি, তার সবটাই আম্মার কাছ থেকে পাওয়া। আমি আসলে চাই না নারী দিবস হোক, তবে তা নিয়ে পরে বলি। আজ বলি একজন মানুষ কীভাবে হলাম সেই গল্পটা।

একজন মানুষ হয়ে ওঠার পিছনে পুরো অবদানটাই আমার মায়ের। আমরা চার বোন খুব ছোট থেকেই জানতাম যে, আমাদের আসলে একজন মানুষ হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ালে তারপর আমাদের বিয়ে হবে। আমার বাবা সরকারি কলেজের শিক্ষক। চারটা মেয়ে সন্তান কিন্তু কোনো ছেলে সন্তান নেই। এমন পরিবারকে কন্যাদায়গ্রস্ত বললে ভুল হবে না। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে ছোট থেকেই ভাবতে শিখিয়েছে যাই করি না কেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবো। স্বাধীনতা মানুষ জন্ম থেকে নিয়ে আসলেও আমার পরিবারই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে যে, আমি স্বাধীন একজন মানুষ আর আমার জীবনটা আসলে আমার নিজের।

তো যাই হোক, লেখাপড়া শেষ করে একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ঢুকলাম। সেখানে পাঁচ বছর কাজ করে তারপর সাদাকালো নামে নিজের ফ্যাশন হাউজ শুরু করি। আমি বিশ্বাস করি, যে কারোরই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তিনটা জিনিস লাগে আর তা হল- কাজ, কাজ আর কাজ। যার যতখানি যাওয়ার কথা সেখানে শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখে পৌঁছানো যায় না। নিজের যোগ্যতা দিয়েই সেখানে পৌঁছাতে হবে। যে যতখানি কাজ করবে সে আসলে ততখানিই যাবে।

আমার ক্ষেত্রে আমার মা আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে একজন মানুষ হতে পারি। তাই আমি বিশ্বাস করি একজন মা ই পারে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে।

আজ আমি স্বাবলম্বী। আমার স্বামীকে বলতেই পারি, আমি যেহেতু কাজ করি তাই তুমি ঘরে বসে সন্তান মানুষ কর। কিন্তু সে কী সেটা করবে? কখনোই না। আর করলেও আশেপাশের মানুষরা তাকে মেরুদণ্ডহীন বলবে। অথচ একজন রিকশাওয়ালাও রিকশা চালিয়ে পাঁচজনের সংসার চালিয়ে সেটা নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু আমাদের সমাজ নারীদের সেই সুযোগ দিচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

 

 

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে এই সোজা মেরুদণ্ডটা প্রত্যেকটা নারীর থাকুক। বিশেষ করে যারা আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাস্টার্স পড়ার সময় এক সহপাঠীকে বলতে শুনেছিলাম সে মাস্টার্স পাশ না করলে তার বিয়ে হবে না। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছিল। কারণ, মাস্টার্স পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ পেরিয়েছে যে সে তো আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর সে এতগুলো ধাপ শুধুমাত্র বিয়ে হওয়ার জন্যই পেরিয়েছে! এটা ঠিক না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের বেশ ভালোই টাকা খরচ হয়। এই টাকাটা তার জন্য ব্যয় না করে অন্য কোনো মেধাবী ছেলে বা মেয়ের জন্য ব্যয় করতে পারত, যে তার শিক্ষাটাকে কাজে লাগাবে। আর যার জীবনের লক্ষই বিয়ে করা সে ইন্টারমিডিয়েটের পড়েই বিয়ে করলে পারে। এতে অন্য একজনের আলোকিত হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়না।

তাই আমার মনে হয় মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না এতে যে শুধু পুরুষেরই দোষ তা নয়। অনেক নারীই আছেন যারা নিজেরাও প্রতিষ্ঠিত হতে চান না। বিশেষত যারা শিক্ষার আলো পায়, তাদের এই বোধ জাগ্রত হওয়া খুব জরুরি। সে যদি ভাবতে থাকে যে সংসারের রান্নার দায়িত্ব তারই তখন তার উপরই রান্না করা না করার দোষ পড়বে।

আমি যেমন কখনো ভাবিনি যে সংসারের রান্নার দায়িত্ব আমার। সেকারণে আমাকে কখনও রাঁধতে হয়নি। তাই বারবার বলি যে নারীরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তারা যেন পিছিয়ে না আসে। তারা পিছিয়ে আসলে ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ বা নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না।

আজ যেমন আমি প্রতিষ্ঠিত বলেই আমার নিজের গাড়ি নিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলে কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না। কিন্তু স্বামী বা শ্বশুরের গাড়ি নিয়ে বেরুলে কোথায় যাচ্ছি, কখন আসব, কতক্ষণ লাগবে কিংবা তেল কতটা খরচ হল সেটা নিয়েও আমাকে ভাবতে হত।

 

 

আবার আমি যখন নিজের টাকা দিয়ে আমার রান্না কিংবা ঘরের কাজ করার জন্য পরিচারিকা রাখতে পারছি তখন আমি রান্না করলাম কি করলাম না সেটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। আমি রান্না না পারলেও আমার একটি পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে সন্তান কিন্তু খুব ভালো রান্না করে। মাস্টারশেফ তার প্রিয় টিভি প্রোগ্রাম আর সে প্রায়ই আমাকে মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়ায়। সে যেমন মজাদার স্টেক রান্না করে, আবার ঘুম থেকে উঠে নিজের বিছানাও গুছিয়ে রাখে। আমি পদে পদে চেষ্টা করি সে যেন একজন মানুষ হয়ে ওঠে।

কারণ আমাদের দেশে অনেক নারীই আছেন যারা নারী থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ হতে পেরেছে কিন্তু মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম। তারা পুরুষ এই বোধটাই তাদের জন্য অনেক বড়। তাই আমার ভীষণ আশা যে, নারী দিবসটা একদিন উঠে যাক আর একদিন একটা মানুষ দিবস হোক। বছরের সেই একটা দিন নারী আর পুরষ দুজন মিলিয়েই বিচার করুক তারা কে কতটা মানুষ হতে পারল।

https://youtu.be/loW9yas5enA


যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত

অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে

সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে

লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের

নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি

মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না

অনুলেখন: রাজনীন ফারজানা

 

সারাবাংলা/এসএস

 

 

তাহসিনা শাহীন স্বাবলম্বী নারী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর