‘লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের’
৮ মার্চ ২০১৮ ১৪:৪৩
[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’। এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]
।। পূর্ণিমা রাণী শীল ।।
একা একা কোনো নারী এগোতে পারে কি না আমি জানিনা। যদিও কেউ পারে সেটা অনেক কষ্টের। আমার ভেতর জেগে ওঠার শক্তি জেগেছিলো, তৈরি হওয়ার শক্তি জেগেছিলো এসএসসি পরীক্ষার পর। যে পরীক্ষায় আমি ভাল রেজাল্ট করতে পারিনি। সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ার কারনে আমার মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন নির্যাতনের শিকার হই।
একটি বিষয় না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে ২০০১ সাল। তখনকার সরকার এমনভাবে নির্যাতনের ধারা তৈরি করেছিলো যে সেই সময় লেলিয়ে দেওয়া কিছু সন্ত্রাসী, কিছু রেপিস্ট তাদের দ্বারা আমি রেপের শিকার হই। তখন আমার মা বলেছিলো তুমি মুখ খুলবে না। কিছুই বলবে না। কিন্তু আমার বাবা, বাবাতো আমাকে খুব ভালবাসেন, তিনি বলেছিলেন, তুমি মিথ্যা বলবে না। আমি শুধু আমার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো মিথ্যা বলিনি। সেই সময়টা বাবা আমার পাশে ছিলো না। আট-দশদিন আমার কাছ থেকে অনেক দূরো ছিলো, আমিও হাসপাতালে বাবাও হাসপাতালে। পুরো পরিবার আমার পাশে ছিলো না। পুরো পরিবারকে আক্রমন করেছিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার হারিয়ে গেছে। আমার পরিবার কঙ্কালের মতো বেঁচে আছে। আমার কষ্টটা হচ্ছে বিন্দু বিন্দু করে আমি ১৮ বছর ধরে আমার বুকের মধ্যে নিয়ে আমি বেড়ে উঠছি। এই বেড়ে উঠার মধ্যে অনেকের সহাযোগিতা পেয়েছি, সাহস পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি যে ওটা ভুলে যেতে হবে। কিন্তু সেই ভুলে যাওয়াটা যে কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী মাত্র বুঝতে পারবে।
আসলে একজন নারী যখন ধর্ষিত হয় সে বাস্তবে একবারই ধর্ষিত হয়। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ তাকে প্রতিনিয়ত তাকে নানাভাবে ধর্ষণ করে। তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, তুমি ধর্ষণের শিকার। আমি ভুলে গেলেও সামনের মানুষগুলো সেটা মনে করিয়ে দিয়ে ধর্ষণ করে। স্যালাইন দিলে যেমন টিকটিক করে শরীরের ভেতরে যায়। তেমনি প্রতিনিয়ত বিষয়টা এভাবে অনুভব করতাম। আমি ভুলে যেতে চাইলেও আমার আশপাশের লোকজন প্রতি নিয়ত বিষয়টা মনে করিয়ে দেয়। আমি ধর্ষণের শিকার।
আমি ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম সেটি ভুলে যেতে। এটা আমার মধ্যে তৈরি হয়েছিলো সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকের মাধ্যমে। ওই ঘটনার পর আমি তার কাছে আশ্রয় পেয়েছিলাম। তাকে আমি দাদু বলতাম। তার হাতে একটি বই দেখেছিলাম। বইটির নাম মাদার তেরেসা। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার মনে হয় বইটি তোমার পড়া উচিত’। গ্রামের মেয়ে, বই পড়ার অভ্যাস নেই। তবু আমি বইটি পড়া শুরু করলাম। বইটি পড়ার পর আমার কাছে মনে হলো আমার ভেতরে যে জ্বালা যে যন্ত্রণা সেটি হয় বাড়িয়ে দিচ্ছে না হয় কমিয়ে দিচ্ছে। একরম একটা দ্বিধার মধ্যে আমি আছি।
এরপর দাদু একদিন বললেন, এখানে একশজনের জীবনী আছে। আমি পড়লাম। আর নিজে নিজে ভাবলাম আমাকে তৈরি হতে হবে। চেঞ্জ ফর লাইফ। ওয়ান পেন, ওয়ান বুক। এটাই জীবন বদলাতে পারে। সেখান থেকে একটা পরিবর্তনের সাহস পেলাম। এই সময় অনেকে পাশে দাড়িয়েছে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি পড়াশুনা করবো।
আমার বড় মামা আমাকে বের হতে বারন করতেন। আমি ধর্ষিতা বলে আমাকে সবার সামনে আসতে নিষেধ করতেন। পাড়া-প্রতিবেশিও এ নিয়ে অনেক কথা বলতো, হেয় করতো। সমাজতো আছেই একটু সুযোগ পেলে তারা খোঁচাতেই থাকে। এরপর কলেজে ভর্তি হলাম। আমাকে যারা চিনতো, অনেকে অনেক কথা বলতো। কেউ রাস্তায় সামনে এসে বলতো তুমি মুখ দেখাও কি করে। আমি বলেছি, কেন? আমি মুখ দেখাবো না তো তুই দেখাবি? বলতো, লজ্জা করে না? আমি বলেছি -লজ্জা কিসের। লজ্জাতো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের। সমাজ যদি আমাকে নিরাপত্তা দিতে না পারে সে লজ্জা তো আমার নয়। সমাজের লজ্জা। একথাটা আমি শিখেছিলাম মাদার তেরেসার ওই বই থেকে। এভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও চুলের মুঠি ধরে মেরেছে আমাকে।
আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু মাছের দোকানে গেলে মাছ উপর থেকে দেখে ভাল দেখায়। অনেকে পছন্দ করে। কিন্তু মাছের ভেতরে কি তাতো কেউ দেখেনো। তেমনি আমাকে দেখে অনেকে পছন্দ করেছে। কিন্তু ওই যে, ব্যাকগ্রাউন্ডতো ভালো না। আমি বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছি। ওই ভদ্রলোকদের সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি।
এরপর ইউনিভার্সিটিতে পা দিলাম। তখনো একই অবস্থা। কোনো মতে লুকিয়ে শেষ করলাম। এরপর প্রাইভেট চাকরিতে গেলাম, সেখানেও দেখলাম আরেক ঝামেলা। ফেসবুক আসলো, অন্য একটি জীবন। আমার ফেসবুকটা হয়তো একটু চালু করেছি, কিন্তু ওইভাবে না। আমার নাম, ছবি দিয়ে একটা ফেক আইডি তৈরি করা হয়েছে। জানা ছিলো না। মানে চলার পথে যতোটা বাঁধা দেওয়া যায়। আর আমি কি করছি। আমি তেলাপোকা। আমাকে আটকে রাখছে। আমি বের হওয়ার জন্য ছটফট করছি যে আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। আমি বের হয়েছি।
তারপর রাজনৈতিক জীবন। একটা সময় ছিলো আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো মন মানসিকতা আমার পরিবারের ছিলো না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পরিবার আমার পাশে আছে। আমাকে নিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস জেগেছে। যেভাবে আমার জেগেছিলো যে আমাকে তৈরি হতে হবে। আমি শুধু এটাই বলেছি যে, আমাকে যারা আজকে ঘৃণা করছে, তারা যেন আমার পাশে এসে বসে। আমাকে যেনো আদর করে কাছে টানে। আমি জানিনা, পারবো কি না বা কতটুকু পেরেছি। তবে আমি সমাজের যারা নারীবাদী আছেন, যারা সিনিয়র আছেন তাদের কাছ থেকে শিখতে চাই। আমিও কিছু করতে চাই। সমাজের জন্য। দেশের জন্য।
https://youtu.be/YMh2BnI2iYk
যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত
অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে
নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি
মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না
মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম
সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে
অনুলেখন: মেসবাহ শিমুল
সারাবাংলা/এসএস