লড়াইয়ের যোগ্য রাখার সংগ্রাম
৮ মার্চ ২০১৮ ১৬:৪০
“প্রতিবার যখন আমি ঘর থেকে বের হই, আমি শুনতে পাই চাকু শান দেয়ার শব্দ, আমি সূর্যের আলোয় দেখি চকচক করে ওঠে খঞ্জর। তবে তা আমার জন্য ভালোই। এটা আমাকে তীক্ষ্ম রাখে, রাখে লড়াই এর যোগ্য, রাখে সতর্ক, আমার চিন্তা-ভাবনাকে কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে, আমি কি বলছি, কীভাবে বলছি সে সম্পর্কে আমাকে খুব সতর্ক রাখে। মোটের উপর এ পথে চলাটা খারাপ নয়। আমার অসতর্ক হওয়ার হওয়ার বিলাসিতা করার সুযোগ নেই, যা আমার অনেক সমালোচক ভোগ করে থাকেন।”
কথাগুলো অরুন্ধতী রায় বিতর্কিত বিষয়ে লেখা বিষয়ে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, এটা ঠিক যে আমি বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে লিখি। আমার ঘরের কাছেই তা তৈরি করে বৈরিতা। আমরা-বাংলাদেশের নারীরা এক বৈরী পৃথিবীতে বাস করি। ঘর, ঘর থেকে দুই পা ফেলা বাসস্টপেজ, তারপর গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র, বিনোদনকেন্দ্র, জনসমাগম বা ভিড়ভাট্টার স্থান, অনলাইন প্রযুক্তি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত এবং থানা এবং রাষ্ট্র-ঠিক কোনটা নারীকে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা দ্যায় তা এই ২০১৮ সালে এসে নারীর উন্নয়নের নানান চোখ আর মন ধাঁধিয়ে দেয়া সময়ে এসে আমার জানতে ইচ্ছে করে।
পারিবারিক সহিংসতার পরিসংখ্যান কত? কতগুলি আসে গণমাধ্যমের আলোয়? গতবছর বিবিএস মানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই বলা হয়েছিল ৮০ভাগ বিবাহিত নারী নির্যাতনের শিকার হন। গণপরিবহনে ৮৪ ভাগ নারী যৌন হয়রানি মেনে নেয়। ভিড়ভাট্টায় যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৭ শতাংশ নারী। কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এরকম তথ্য রয়েছে। শহরের পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্রগুলো নারীর জন্য নয়, হাসপাতাল নারীর জন্য নয়, উৎসবের দিনগুলো নারীর জন্য নয়, খেলাধুলা আর সংস্কৃতি নারীর জন্য নয়।এই প্রত্যেকটা বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা জরিপ আছে। যেসব তথ্য কোনটাই নারীর পক্ষে নয়।
আমাদের রাষ্ট্র সামাজিক সুরক্ষার নাম করে আর “গরমের দেশে মেয়েদের শরীরে তাড়াতাড়ি যৌবন আসে”-এরকম যুক্তি দিয়ে ১৬ বছরে কিশোরীরে বিয়ে দেয়ার নীতি করেছে। তারপর আছে ধর্ষন।
ধর্ষন কেন হয়? পুরুষ তার ক্ষমতা দেখাতে ধর্ষন করে, যৌন আকাঙ্খা মেটাতে ধর্ষণ করে, রাগ হলে ধর্ষন করে, খুশি হলে ধর্ষণ করে,নারীর বাপ-মা-ভাইবোনেদের ওপর প্রতিশোধ নিতে ধর্ষন করে,রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ধর্ষণ করে, একা পেলে একা ধর্ষণ করে, কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে, শহরে ধর্ষন করে, গ্রামে ধর্ষন করে,পাহাড়ে ধর্ষণ করে, সমুদ্রে করে, ঘরে করে, বাসে-ট্রেনে, ঝোপেঝাড়ে ধর্ষন করে-মোটের উপর এইটা পুরুষের ইচ্ছাধীন একটা ব্যাপার। তার ইচ্ছা হলে সে ধর্ষণ করে। আর অনলাইনে ধর্ষন করেন ধর্ষকামী মনস্তত্বের পুরুষেরা। নারী তাদের কাছে বেশ্যা অ্যাট অল। মতে না মিললে, নারীবাদের কথা বললে অবলীলায় পাবলিকলি অথবা ইনবক্সে তারা ধর্ষণ করে যায়।
ঠিক কতজন নারী ধর্ষণের বিচার পান? সেই বিচার পেতে তাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হয়? আদালতের বারান্দা, আদালতের এজলাস, আদালতের উকিল-আর্দালি কি চোখে দেখে ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে?
এইসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য “সময় এখন নারীর, উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম শহরে, কর্ম জীবনধারা”। নারী দিবসে সব ভালো ভালো কথা বলার রেওয়াজ। কোন নারী পাহাড়ে উঠলো, কোনে নারী প্লেন চালালো বা ট্রেন, কোন নারী প্যারাট্রুপার হলো, প্রশাসন আর পুলিশে নাম লেখালো উচ্চপদে-এইসব কথা আনন্দিত মুখে বলতে হয়।
গ্রামে প্রভাবশালীর ক্ষমতা আর যৌন আকাঙ্খার নীচে পড়াশোনা আর কাজ করার স্বপ্ন ধুলিসাত হওয়া নারীদের তালিকা এইদিন দিতে নেই, বখাটের অত্যাচারে স্কুল ড্রপ আউট কিশোরীর কথা বলতে নেই, বখাটের অত্যাচার থেকে মেয়েকে বাঁচাতে দায়ের কোপে নিহত মায়ের কথা বলতে নেই, রিশা, তনু, মহিমা-এইরকম শতশত চাপা পড়ে যাওয়া নাম বলতে নেই। কিন্তু নারীর কর্ম জীবন ধারা নাকি পাল্টে যাচ্ছে-সেই উদযাপন আমরা করছি।
কাদের নিয়ে আমরা নারী দিবস পালন করি? সরকার করে তার স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে, এনজিও কর্মীরা করেন নানা মাত্রায়, কর্পোরেট অফিসগুলো করে সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে। সেই পালনে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কথা বলা হয়। কাদের থেকে নিরাপদ পরিবেশ করার কথা বলি আমরা? জ্বী পুরুষের থেকে। তো এই নারী নির্যাতন আর ধর্ষনের ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রামে আমরা পুরুষদের কতটা সম্পৃক্ত করতে পেরেছি বলেন তো। না এনজিওর পুরুষ নয়। আমার-আপনার ঘরের পুরুষ। আমার বাবা, আমার পার্টনার আমার পুত্রসন্তানকে কতটা সম্পৃক্ত করতে পেরেছি? কয়টা বাবা, পার্টনার, পুত্র তাদের নিজেদের কন্যা, স্ত্রী আর মায়ের বাইরে নারীদের পুরো মানুষ ভাবে? নিজেদের সমান ভাবে? ভিকটিম নারীর বাইরে ঘাড় সোজা করে হাঁটা নারীদের মেনে নিতে পারে?
এইসব এখন জেনে নেওয়াটা জরুরী। ছদ্ম কিছু নারী উন্নয়ন আমরা ক্রিয়েট করেছি বটে সেটা শেষপর্যন্ত কদ্দুর টেকে তা দেখার বিষয়। পুরুষতান্ত্রিকতা যেহেতু ক্ষমতা কাঠামো তাই সমাজ আর রাষ্ট্রের আর পাঁচটি ঘটনা যে পথে চলছে এই কাঠামোর ঘটনাগুলোও সেভাবেই চলবে। যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদে মানুষ গুম হয়, খুন হয়, রাষ্ট্রীয় মদদে চুপ করিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবাদকারীদের।
নারী নির্যাতনের প্রতিবাদকারী অথবা নিজের প্রতি ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদকারী নারীকেও ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, মেরে, কেটে, ধর্ষন করে চুপ করানো হবে-এটা মেনে নিয়েই নারীকে গলা তুলতে হবে। গলা তুলতে হবে ঘরে, গণপরিবহনে, কর্মক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। চিৎকারের বিকল্প নাই।
অরুন্ধতী রায় থেকে প্রথমে কোট করেছিলাম। সেখান থেকেই বলি। নারীর আসলে নিজেকে তীক্ষ্ম, সতর্ক আর লড়াই এর যোগ্য রাখা ছাড়া উপায় নাই। যা কিছু আমরা বলবো, নিজের স্বপক্ষে, সমতার স্বপক্ষে তা থেকে প্রথমেই বৈরিতা তৈরি করবে ঘরের কাছে। কিন্তু একটা সমতার পৃথিবীর জন্য আমাদের লড়ে যাওয়াই হয়তো এই মানবজন্মের সার্থকতা।
সারাবাংলা/এসএস