অদিতি শুনছো?
৯ মার্চ ২০১৮ ১২:৫৮
প্রিয় অদিতি,
তোমাকে চিনি না। কখনো দেখা হয় নি আমাদের। নিদেনপক্ষে আমরা কখনো ফেসবুকেও কথা বলি নি। তবুও তোমার আহাজারি আমার বুকে বাজে। দিন শেষে তুমি, আমি, আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে বেড়ানো ছোট্ট বাচ্চা মেয়েট সহ সব মেয়েই তাদের অঙ্গ ক’টি নিয়ে ভীত। আহাজারিটা দিন শেষে আমাদেরই থাকে।
যখন কলেজে পড়ি রোজ সকালে ২৭ নম্বর বাসে উঠতাম আজিমপুর থেকে। নারী সিটে বসতে চাইতাম না কখনো। ভাবতাম শুরুর স্টপেজ থেকেই যদি একটা নারী সিট দখল করে রাখি তাহলে বাকি নারীদের জন্যে বরাদ্দ থাকে মোটে তিনটে। থাকুক, চারটাই ওদের জন্যে থাকুক। উত্তরাগামী বাসটাতে উঠতেন কিছু পরিপাটি পুরুষ যাদের প্রধান কাজ মেয়েদের গা হাতড়ানো। দুদিন বাদেই আমাকে ফিরতে হয়েছিল সেই নারী সিটেই। নিজের নিরাপত্তার জন্যে। এত করেও রক্ষা না হওয়ায় রোজ উপর থেকে নিচ অবধি হাতড়ানো শরীর নিয়ে আমি যখন বাস থেকে নামতাম তখন বমি পেত ভীষণ। কলেজের রোজ সকালের প্রতিদিনকার রুটিন ছিল এটা। এখনও সেই বীভৎসতা ভাবলেই শিউরে উঠি!
এখন তো বড় হয়ে গেছি তবুও কী বদলেছে কিছু? গত রোজার সময় দুপুরে ছাত্র পড়িয়ে ফিরছিলাম। রোজার শেষ সময়ে ছাত্রের জন্যে এক গাদা বকবক করে তৃষ্ণায় অন্ধকার দেখছিলাম চোখে। দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসে সিট ছিল না বলে। নিশ্চিত ছিলাম না ইফতারের আগে বাসায় পৌঁছাতে পারব কী না। বাসে উঠতেই এক ভদ্রলোক পেছন থেকে যা করলেন তার বলতে ঘৃণা হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বমি বমি ভাব, গা গোলানো – সব মিলিয়ে জীবনে সেই দিন পানির অভাবে যে পরিমাণ হাঁসফাঁস করেছিলাম মনে হচ্ছিল নরক নেমে এসেছে আমার মাথার কাছে। অথচ দেখো আমাদের দেশ কিন্তু মুসলিম অধ্যুসিত।
এই শহরে দিন দুপুরে মেয়েরা হেনস্তা হয়। মানুষ সেগুলোর ভিডিও করে। দাঁড়িয়ে মজা নেয়। এই শহরে আনাচে কানাচে নিপীড়ক। যে পুলিশের কাছে তুমি যাবে নিরাপত্তার জন্যে সেদিন এই পুলিশই বিনা অপরাধে আমাকে পুলিশ ভ্যানে তুলতে চেয়েছিল ক্ষমতা এবং পৌরুষের চর্চার জন্যে।
দিন বাদ দিলে থাকে রাত। রাতে ছাত্র পড়িয়ে বাসায় ফিরলে শুনতে হয়, “রাতের বেলায় ভালো মেয়েরা বাইরে থাকে?” বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার জন্যে রাতে স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকলে শুনতে হয় “রেট কত?”
অদিতি, বলতে পারো আমি তুমি কখন নিরাপদ?
এই শহরে তোমার ঘর থেকে বের হবার মানেই হল তুমি ‘গণিমতের মাল’। তোমার গা হাতড়ানো জায়েজ করা হবে যে কোন উছিলায়। তোমার গায়ে হাত দিলে পাল্টা মার লাগাতে হবে তোমারই জন্যে। “কারও গায়ে হাত তোলা অপরাধ” – এই বোধ লুপ্ত করে দেয়া শহরে তোমাকে নিরাপত্তা না দিয়ে মধ্যযুগীয় মারামারি করে এগোতে হবে সামনে। কিন্তু কতজনকে মারা যায় এক জিনিসের জন্যে এই জবাব কেউ দেবে না। বড়ই সোন্দর্য!
আজও বাসে চড়েই ফিরছিলাম। রাতে ঘুম হয় নি। বাস থেকে নামার সময় এক পুরুষ নিতম্বে হাত রাখতেই ফিরে তাকিয়ে কঠিন চোখে তাকালাম। ঝাড়লাম। গায়ে হাত তুলতে পারতাম। শরীর খারাপ ছিল বলে পারিনি। হেলপারকে ডাকতেই আমাকে প্রথম জিজ্ঞাসা, “আপনে কিছু কন নাই আপা?” বললাম, “বলেছি।”
আমাদেরই আক্রান্ত হতে হবে, আমাদেরই প্রতিকার করতে হবে, আমাদেরই নিরাপত্তা খুঁজতে হবে। আমাদেরই, হ্যাঁ আমাদেরই!
আমাদের শরীর খারাপ থাকতে নেই, আমাদের মন খারাপ থাকতে নেই, আমাদের বই পড়তে পড়তে উদাসীন থাকতে নেই, আমাদের প্রকৃতি দেখতে নেই, আমাদের কাঁদতে নেই, হাসতে নেই – কিচ্ছুটি করতে নেই। আমাদের দেখতে হবে নিরাপদ আছি তো? আমাদের দেখতে হবে গায়ে কেউ হাত দিচ্ছে না তো! সবসময় নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। একপক্ষ উদ্ধত হয়ে কিংবা ছোঁক ছোঁক করে ঘোরে, আরেকপক্ষ “নিরাপত্তা” “নিরাপত্তা” করে আহাজারি করে বেড়ায় এই শহরে।
আমি কাকে বোঝাই অদিতি, আমাদের বই পড়তে ভালো লাগে! বই পড়া শেষ হয়ে গেলে আমাদের বইয়ের মুগ্ধতায় ডুবে থেকে হাঁটতে ইচ্ছে করে বহুক্ষণ! আমাদের কারো এই শরীরের ক’টি অঙ্গ নিয়ে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না রাস্তায় বের হলেই মারামারি করতে। আমাদের ভাবতে ইচ্ছে করে গাণিতিক সমস্যাটা, যার সমাধানটা খুঁজে পাচ্ছি না তাকে নিয়ে। ল্যাবে কাজ করতে করতে আমাদের কবিতার যে ক্ষুধা চাগিয়ে ওঠে তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। রাত জেগে পড়ার জন্যে তৈরি হওয়া ঘুমহীনতার অবসাদ কাটাতে আমাদের বাসের ভেতরে বসে ঘুমাতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু দেখো ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে এলেও আমাদেরকে শরীর নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। সব সময় আমাদের মাথায় বাজে নিরাপত্তার সাইরেন। আমাদের অর্ধেক ভাবনাক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে এই শহর আমাদের জন্যে “নারী কোটা”র মূলা ঝুলিয়ে রাখে। এই শহর আমাদেরকে রাখার দাবি করতে পারে না। আমাদের শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করা এই শহর ভুগবে, খুব কঠিনভাবে ভুগবে।
দিন শেষে শহরের নোংরাদের বুনো উল্লাসই দেখি। আর আমরা সেই উল্লাস থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে। দুটোই তো মাত্র হাত! তা দিয়ে একই সাথে পাঁচ ফুট শরীর রক্ষা করা যায় বলো?
এসো অদিতি, একসাথে এই শহর ত্যাগ করি!
সারাবাংলা/এমএম