সাকিব আল হাসানের শিশুকন্যা আলাইনা। নিষ্পাপ মুখশ্রীর বছর চারেকের মেয়েটি এরই মধ্যে ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির সবার পরিচিতমুখ। সম্প্রতি তারই একটি ছবি প্রকাশিত হয় একটি নিউজ পোর্টালে— সূর্যমুখীর বাগানে দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলাইনা। ছবিটি দিন চারেক আগে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন সাকিব। নিউইয়র্কের ওই সূর্যমুখীর বাগানে স্ত্রী শিশির ও দুই মেয়ে আলাইনা ও ইরামকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। আর সেখানেই অন্য সবার ছবির সঙ্গে ছিল আলাইনার ছবিটিও।
তারকা নিজের ও পরিবারের এমন ছবি হরহামেশাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে থাকেন। তাতে ভক্তকুল প্রিয় তারকাদের পারিবারিক জীবনের সামান্য ঝলক দেখে আনন্দবোধ করেন। সাকিব আল হাসানও তার ব্যতিক্রম নন। স্ত্রী শিশির ও মেয়ে আলাইনার সঙ্গে তার ছবি নিয়মিতই দিয়ে থাকেন ফেসবুক-ইনস্টায়। সেসব ছবিতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা যেমন দেখা যায়, তেমনি এক শ্রেণির মানুষের ‘নোংরামি’ও চোখে পড়ে। শিশির কেন মাথায় কাপড় দেন না, শিশির কেন এটা করেননি, শিশির কেন ওটা করেননি— সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী এক শ্রেণির মানুষের প্রধান গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেটিই। আমরা ভুলে যাই, ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা, পারস্পারিক সম্মান ও সৌজন্যবোধের আড়াল।
তবে আজ যেন সব সীমা পার হয়ে গেছে। ছোট্ট আলাইনার সূর্যমুখীর বাগানে দাঁড়ানো ছবিতে একদল মানুষ নোংরা সব মন্তব্য করে বুঝিয়ে দিয়েছে, জাতি হিসেবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে। পাটক্ষেতের সঙ্গে যে কুৎসিত যৌনতার আভাস জড়িয়ে, একটি নিষ্পাপ শিশুকে জড়িয়ে কেন সেই কুৎসিত ইঙ্গিত? কেন এমন ভয়াবহ বিকৃতি? কী বলছেন বিশিষ্টজনেরা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই আচরণকে তিনি কীভাবে দেখছেন। সাদেকা হালিম সারাবাংলাকে বলেন, এটি আসলে সামাজিক-মনস্তাত্বিক বিষয়। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিই এমন যে আমরা নারী-শিশুকে যৌনতা দিয়ে বিচার করি। আমাদের চোখে নারীর একটিই পরিচয়— সেটি তার লৈঙ্গিক পরিচিতি। একইভাবে আমরা শিশুকেও দেখছি, যেন সেও একটি যৌনবস্তু ছাড়া কিছু না। পাটক্ষেত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শুধু নিষিদ্ধই নয়, একটি অপরাধস্থলও বটে। এখানে নারীকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলে রাখার ঘটনাও ঘটে।
‘সাকিব আল হাসানের মেয়ের ছবিতে পাটক্ষেতের কথা বলা তাই একরকম মানসিক বিকৃতি। নারী ও শিশুকে মানুষ হিসেবে না দেখার ফলাফল। এটি যে বিকৃতি, সেটা আবার তারা বুঝবে না। কারণ তারা যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে, তাতে এগুলো তাদের কাছে স্বাভাবিক আচরণ,’— বলেন সাদেকা হালিম।
সাকিব আল হাসান ও তার স্ত্রী-কন্যাকে ব্যক্তি আক্রমণ করা, তাদের নিয়ে ‘জাজমেন্টাল’ হয়ে ওঠা— এর কারণ তুলে ধরে ঢাবি’র এই অধ্যাপক বলেন, এটি আসলে আমাদের এই উপমহাদেশের একরকমের সাবকালচার। আমরা তারকাদের নিজেদের সম্পদ মনে করতে থাকি। তাই তাদের ব্যক্তিজীবনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ দেখাই না। সমাজের একটি জাজমেন্টাল অংশ তারকাদের চরিত্রহনন করে আনদ পায়। এর সঙ্গে হীনমন্যতা আর ঈর্ষাবোধও কাজ করে কিছুটা। কোনো তারকা যখন প্রতিষ্ঠান হয়ে যান, তাকে কিছুটা ডিমোরালাইজ করার চেষ্টাও থাকে কারও কারও। এভাবেই আমরা স্ত্রীর পোশাক, সন্তানের ছবি নিয়ে নোংরা মন্তব্য করি। ভয়ানক পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ এটি। আবার এগুলো সাইবার ক্রাইম, যা থেকে নারী ও শিশুকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র কেন যেন এসব অপরাধের বেলায় নিশ্চুপ থাকে। তাই একশ্রেণির মানুষ দিনের পর দিন এমন আচরণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিই বাড়িয়েছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন হয়ারনিমূলক আচরণ— এমনটি মন্তব্য করলেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তিনি বলেন, বারবার অপরাধ করলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে একের পর এক সাইবার ক্রাইম করেই যায় একটি শ্রেণি।
কেন এই বিকৃতি?— সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মনে করেন, আমরা পরিবার ও সমাজ থেকে এগুলো শিখি। আর পেছন থেকে ইন্ধন জোগায় আমাদের সামন্ততান্ত্রিক পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্র শেখায়, সমাজ ও পরিবারে পুরুষই শ্রেষ্ঠ। এমন আচরণ করেও সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে এবং এমন অসংবেদনশীল আচরণকে কোনো অপরাধই মনে করে না।
‘শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, সমাজ এসবই আমাদের এমন আচরণ শেখায়। সবজায়গাতেই নারীকে নীচ হিসেবে দেখার ফলে আমরা এসব আচরণকে স্বাভাবিক ভাবি। একইসঙ্গে আমাদের পরিবারগুলোর অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও দায়ী। পরিবারে পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাই তারা বাইরেও তেমন আচরণ করে। আবার অনেক নারীও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করে, যারা মনে করে পুরুষই শ্রেষ্ঠ। এ ধরনের নারী-পুরুষ উভয়েই ছেলেবেলা থেকে নারীকে শুধুই ভোগের বস্তু মনে করে এবং মিসোজেনিস্ট আচরণকে পুরুষের পৌরুষ মনে করে। তাই সমাজে এসব আচরণ বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়,’— মন্তব্য ইশতিয়াক রেজার।
এর থেকে মুক্তির জন্য নারীদের এগিয়ে আসতে হবে, সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে হবে বলে পরামর্শ এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের।
সাকিবের মেয়ের ছবিতে আপত্তিকর মন্তব্য, জড়িতদের খুঁজছে পুলিশ
সাকিবের সন্তানের ছবিতে এমন বিকৃত সব মন্তব্যের পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়ের পাশাপাশি মানসিক দৈন্যের বিষয়টিও দায়ী বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, মানুষের তিন ধরনের প্রবৃত্তি থাকে— পাশবিক, মানবিক ও ঐশ্বরিক। আমরা পাশবিক ও ঐশ্বরিক প্রবৃত্তি দমন করে মানবিক আচরণ করি। যখনই কারও মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই সে নানারকম বিকৃত আচরণ করে। এটি ওই দমনেরও ফলাফল অনেকটা। নিজেকে এভাবে প্রকাশ করে সে পরিতৃপ্তি পায়। অনেকে মনে করে, সে অন্যকে জ্ঞান দিচ্ছে। কিংবা সে নিতান্ত মজা করছে। কিন্তু এগুলো যে অস্বাভাবিক আচরণ, সেটা তারা বুঝতেও পারে না। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে জনপ্রিয় হওয়ার দৌড়ে মত্ত আমরা অনেকসময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমরা ভুলে যাই, পাবলিক প্লেসে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত। তাই এমন কুৎসিত মন্তব্য করে সুখানুভব করি।
‘আমরা যেমন ঘরের সাজপোশাকে বন্ধুর বাড়ি যাই না, কিছুটা হলেও পরিপাটি হয়ে নেই, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও যে আমাদের কিছুটা সামাজিক কায়দাকানুন মেনে চলা উচিত— তা আমাদের মনে থাকে না। ফলে, আমরা এমন আচরণ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি, আলোচনায় থাকতে চাই,’— বলেন এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, এমন বিকৃতির জন্য সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব দায়ী। একটি শিশু পরিবার থেকেই আচরণ শেখে। বড় হয়ে সে কেমন মানুষ হবে, তার ভিত্তি গড়ে ওঠে পরিবার থেকে। শিশু যখন পরিবারে দেখে তার বাবা তার মাকে পরিহাস করছে, গায়ে হাত তুলছে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, সেও নারীকে সম্মান করতে শেখে না। তারা নিজেরাও যখন পরিবার গঠন করে, ওই একই আচরণ করে।
এর থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এটিকেট’ মেনে চলতে শেখাও জরুরি বলে মনে করেন ডা. হেলাল। তিনি বলেন, এটি একটি পাবলিক প্লেস। তাই এখানে আমদের যথাসম্ভব সভ্য আচরণ করতে হবে। এই বিষয়টি অবশ্যই আমাদের মাথার রাখতে হবে।
ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার শাড়ি, ডা. সাবরিনার সাজপোশাক কিংবা শিপ্রার জীবনযাপন— ঘটনাকে ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে এগুলোই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন আমাদের ব্যক্তিগত বিচারালয়, যেখানে আমরা নিজেরাই বিচারক হয়ে অন্যের বিচার করি। শুধু বিচার করেই থেমে নেই, অনেকসময় আমরা রায়ও শুনিয়ে দেই। কাকে সমাজ বিচ্যুত করতে হবে, কার উপাধি কী হবে— সব আমরাই ঠিক করে দেই। আর আমাদের এই বিচারিক মনের অ্য্যন্টেনা নড়ে ওঠে যখন আমাদের নাগালে থাকে কোনো নারী বা শিশু।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে এক হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ হিসাবে মাসে ৮৪টি বা গড়ে প্রতিদিন প্রায় তিনটি করে শিশু দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অথচ শিশুদের বলা হয় স্বর্গীয়। তবে কি অবদমিত যৌনতার তাড়নায় শিশুদের আমরা স্বর্গচ্যুত করছি? বাস্তবেও শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো ঘটনায় যেমন অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে, সাইবার স্পেসে নিরাপত্তার বিধান থাকলেও সেখানেও নারী-শিশুদের এমন ভয়ানক আক্রমণকারীদেরও আনা যায় না শাস্তির আওতায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে সাইবার আইন অন্তত আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা দিক সাইবার বুলিংসহ সব ধরনের যৌন আক্রমণ থেকে। একইসঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুকাল থেকেই সেই শিক্ষা দেওয়া হোক, যেন একজন নারীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া যায়। তবেই হয়তো সমাজ থেকে দূর হতে পারে এমন বিকৃতি।