নারী স্বাধীনতাঃ প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
১০ মার্চ ২০১৮ ১৪:৪৬
এখন স্বাধীনতার মাস। কালের হাত ধরে বহু বেদনার স্বাক্ষী আমরা, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা শব্দটি বড় প্রিয় আমাদের কাছে, বড় মূল্যবান। মানুষ মাত্র স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, বলতে চায়। কিন্তু সবসময় কি তা পারা যায়?
ধরা যাক নারীকূলের কথা। বর্তমান সমাজ ও সময়ে তারা কতটা স্বাধীন? অনেক বড় একটি প্রশ্ন এটি, হয়তো অনেকেই ভ্রু কুঁচকে বলবেন, এখনকার থেকে মেয়েরা আর কবে এত স্বাধীন ছিল! এখন মেয়েরা ঘরের বাইরে যাচ্ছে, চাকরি করছে, সংসার করছে, অমুক তমুক কত সুবিধা তাদের জন্য বরাদ্দ ইত্যাদি, ইত্যাদি। আগের যুগে এমন ছিল নাকি? আহা, সেসময় তো মেয়েদের অসূর্যস্পশা দশা ছিল। এখন মেয়েরা মুক্ত স্বাধীন।
সত্যি কি তাই? এখনও তো মেয়েদের জীবন শুরু হয় মেয়েমানুষ নাম নিয়ে। তাকে উঠবে বসতে এটাই ভাবানো হয় যে, তুমি একটা মেয়ে। তাকে শিক্ষা দেওয়া হয় কিভাবে তাকে সারা জীবন মেয়ে মানুষ হয়ে থাকতে হবে। মেয়েদের এভাবে কথা বলতে নেই, এভাবে চলতে নেই, এভাবে ভাবতে নেই, শুধু নেই আর নেই। তাকে হয়ে থাকতে হবে লক্ষী, সাত চড়েও যার মুখে রা থাকবেনা। সে হবে সর্বংসহা, যার সহ্যশক্তি অসীম। পরিবারের মান সম্মানের ভার শুধু তার একার। কোন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হলে দেখতে হয় চোখ রাঙানি, মেয়ে আর ছেলেতে কখনো বন্ধুত্ব হয় নাকি! আর প্রেম যদি হয়েও যায় তবে তার সমস্ত দায় তোমার, প্রাণপণ যুদ্ধ করে যেতে হবে সেটা কে মধুর রাখবার জন্য। নইলে তোমার সুন্দর মুহুর্তগুলো নিমিষেই কুৎসিত হয়ে ঘুরতে থাকবে মুঠোফোনে। সাইবার আইন কোন কাজেই লাগবে না, কারণ তুমি মেয়ে, একবার বদনাম যদি তোমায় স্পর্শ করে তবে সভ্য সমাজ তোমাকে অস্পৃশ্য ঘোষণা করবে।
ইচ্ছে হলেই তুমি সাইকেল নিয়ে ছুট লাগাতে পারবেনা। পারবেনা রাতের আকাশ দেখতে, ফুলের গন্ধ নিতে। এসব ইচ্ছা থাকতে আছে নাকি! কারণ তুমি মেয়ে। তোমার গলার স্বর কখনো কখনো উঠবেনা পঞ্চমে, তোমার চোখ জুড়ে থাকবে লজ্জার ভয়। তুমি নিজেকে নিয়ে সবসময় অস্বস্তিতে থাকবে। তোমার কোন ক্রোধ থাকবে না, বড়জোর অভিমান থাকতে পারে। তুমি আজীবন সংসারের মঙ্গল কামনা করবে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ধুর বোকা মেয়ে, তোমার নিজের জীবনেরই সিদ্ধান্ত নিতে পারার কোন অধিকার নেই তোমার, কারণ তুমি মূর্খ মেয়েমানুষ, ঘটে বুদ্ধি কম।
তোমার প্রত্যাখান করা অধিকার নেই, নইলে কোপ পড়বে মগজে, এসিডে পুড়ে যাবে মুখ। না শব্দটি তোমার অভিধানে থাকতে নেই, সব পারতে হবে তোমাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যলয়ে হতে হবে প্রথম। ভালো চাকরি করতে হবে, ভালো মা হতে হবে। পুরুষশাসিত সমাজে যা কিছু ভালো তার সবটা তোমার হতে হবে। পান থেকে চুন খসলে তোমার নিস্তার নেই। হুমকি ধামকি তো আছেই, সাথে কিল ঘুষিও পড়তে পারে। তাতে কস্ট পাবার কিছু নেই। এতো নিতান্তই পারিবারিক ব্যাপার।
মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে, কারণ তুমি মেয়ে। বিধাতার অপরূপ সৃস্টি। তাই কাব্যে সাহিত্যে তোমার এত বন্দনা। তুমি অর্থাৎ তোমার রুপ, তোমার মুখমন্ডল, তোমার শরীর, তোমার সৌন্দর্য এসবই তোমাকে বিচারের মাপকাঠি। রুপকথা, গল্প, সিনেমা সবকিছুতে তুমি বন্দী, তোমাকে উদ্ধার করতে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় হয়ে রাজপুত্র ছুটে আসছে, অথবা গুন্ডা থেকে তোমাকে বাঁচাতে হঠাৎ নায়কের আবির্ভাব। হায়রে নারী তুমি বন্দিনী, সে কাব্য হোক কিংবা হোক বাস্তবতা। তুমি এই পুঁজিবাদী সমাজে পচে যাওয়া মগজের কাছে নিছক পণ্য। কত সমারোহ করে তোমাকে পণ্য বানানো হচ্ছে, কত অবলীলায় তুমি পর্যবসিত হচ্ছো মুনাফায়!
তবুও তুমি প্রতিবাদ করতে পারবে না। চিৎকার করে বলতে পারবে না, এ অন্যায় মানি না, মানব না। তোমার জিব কেটে রাখা হবে। মেয়ে মানুষের এতো কথা কিসের? মনে আছে খনার কথা? আমাদের বাংলার মেয়ে খনা। জ্যোতিষ শাস্ত্রে যার ছিল গভীর পান্ডিত্য, করতে পারতেন নির্ভুল গণনা, যার কথা খনার বচন নামে খ্যাত। সেই খনাকেও তাঁর জ্ঞান বিদ্যা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো স্বামীর গৌরবের জন্য। ইতিহাসে কখনও প্রশ্ন উঠেনি একি গৌরব না গ্লানি।
এতো গেলো অনেক আগের কথা। এবার ফিরি নারী স্বাধীনতার যুগে, এই আধুনিক সময়ে। তনু, রুপাদের কথা মনে আছে? কথ নৃশংসতা, কত হিংস্রতার সাথে ওদের হত্যা করা হলো, নির্যাতন করা হলো। ওরা শিকার হলো আদিম বীভৎস লালসার। আবার চারুকলার সিমি যে লোকনিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। সারা পৃথিবী জুড়ে রোজ কত না তনু রুপা সিমি খাদিজারা মরে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, বাস্তুহারা হচ্ছে, ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে। পত্রিকাদি ভরে যাচ্ছে তাদের অসহায়ত্বের কাহিনীতে অথচ আমাদের বিবেক টলছে না। কত নির্বিকার আমরা!
কারণ তুমি মেয়ে! তোমার শৈশবও আর নিরাপদ নয়, শ্লীলতাহানি শব্দটি বুঝে উঠবার আগেই তোমার শ্লীলতাহানি হচ্ছে। তুমি মুখোমুখি হচ্ছো চরম নোংরামির। কিছু মানুষরুপী ঘৃণ্য পশুর লোলুপতা টুটি চেপে ধরেছে তোমার কোমল শৈশব ও কৈশোরের।
সময় নারীর জন্য খুব বদলায়নি। এখনও তার আগমন অনভিপ্রেত চিন্তার। এখনও গায়ের রঙ দুধে আলতা নাহলে মুখ কালো হয় অনেকের। এখনও মেয়ের পিতারা শুধু পিতা নন, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা। শত শত না আর বাঁধার শেকলে বন্দী নারীর স্বপ্ন, ইচ্ছে এবং জীবন। যদি অনেক অনেক আগে, সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ফিরে যাই, তবে দেখতে পাই এমন তো ছিলো না। শক্তি, বুদ্ধি ও প্রেমের গুণে নারী ছিলো মানব সভ্যতার অবিসংবাদী নেতা। নারীকে বলা হত মানবজাতির ধারক ও বাহক। কিন্তু হায়! কালের পরিহাসে নারীর নাম হয়েছে অবলা, সরলা, বামা ইত্যাদি ইত্যাদি। নারীরা নেতা হতে চায় না, চায় মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান। কাগুজে সম-অধিকার নয়, মগজ প্রসূত বাস্তব অধিকার।
তবে কি মেয়ে তুমি থমকে যাবে! না, পৃথিবী বিপদাপন্ন জেনেও, তার চারিদিকে কামনার হিংস্র থাবা ওত পেতে আছে জেনেও, শত শত অবার্চীন সংস্কারের বেড়ি পায়ে নিয়েও, সারা পৃথিবীর বক্রাক্তিকে উপেক্ষা করে দৃপ্ত পায়ে মেয়েরা সামনে এগিয়ে যাবে। সে পথে যদি আসে অন্ধকার, তবে আসুক। যদি ওঠে ঝড়, তবে উঠুক। মেয়েরা লড়বে তাদের অধিকারের জন্য, তাদের সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য। একবিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের প্রতিভূ কমলা বাসিনের সুরে বলতে চাই, পৃথিবী স্বাধীন, রাষ্ট্র স্বাধীন কিন্তু নারীরা এখনও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রুপে স্বাধীন নয়। স্বাধীনতার জন্য তাই পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। তাই চোখের জল নয়, এই দীর্ঘ সংগ্রামে সাথী হোক আশা, আনন্দ আর মনোবল। পরিশেষে বলতে চাই, মেয়ে তুমি এগিয়ে চলো শত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে।
সারাবাংলা/এসএস