ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের ঘোষণা ও ক্রীড়ায় লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপ
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:৩৫
বিশ্বের মাত্র চতুর্থ দেশ হিসেবে নারী ফুটবলারদের পুরুষ ফুটবলাদের সমান বেতন ও প্রাইজ মানি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ফুটবল জায়ান্ট ব্রাজিল। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে মার্তা, ফার্মিগা, রোজেইরা, তামিরেস, লেসিয়ারারা পুরুষ ফুটবল দলের নেইমার, জেসুস, ক্যাসিমেরো কিংবা কুটিনহোদের সমান বেতন ও ভাতা লাভ করবেন। ব্রাজিল ফুটবল দল তথা সমগ্র বিশ্বের নারীদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৮৬ সালে ২২ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারী ফুটবল দলের বিপক্ষে ২-১ গোলে পরাজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব নারী ফুটবলে ব্রাজিলের যাত্রা শুরু। নারী ফুটবলে কখনও বিশ্বকাপ না জিতলেও বিশ্বকাপে একবার রানার আপ ও একবার ৩য় স্থান লাভ করেছে ব্রাজিল নারী ফুটবল দল। এছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া নারী ফুটবল বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরে অংশ নেওয়ার গৌরব রয়েছে ব্রাজিল নারী ফুটবল দলের। অলিম্পিক ফুটবলে ১ বার রানার আপ হওয়ার গৌরব রয়েছে ব্রাজিলের মার্তাদের। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশিয় প্রতিযোগিতা কোপা আমেরিকায় ৮ বার অংশ নিয়ে ৭ বার চ্যাম্পিয়ন ও ১ বার রানার আপ পদকে ভূষিত দলটির খেলোয়াড়েরা নিশ্চিতভাবেই পুরুষদের সমান সম্মানি লাভের অধিকার রাখেন।
৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ব্রাজিল ফুটবল কর্তৃপক্ষ সিবিএফ সভাপতি রোজেরিও কাবক্লো ব্রাজিল ফুটবল থেকে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। বিবিসি নিউজের বরাতে জানা যায়, সিবিএফ ঘোষিত এই বেতন ও প্রাইজমানি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গত মার্চ মাস থেকেই কার্যকর হবে। সিবিএফ আরও ঘোষণা দিয়েছে, আসন্ন বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক ফুটবল থেকে অর্জিত প্রাইজমানি নারী ও পুরুষ ফুটবল দলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে।
সমান বেতন পাবেন ব্রাজিলের নারী ও পুরুষ ফুটবলাররা
বিশ্ব ফুটবলে বেতন, ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপকারী প্রথম দেশ নরওয়ে। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে নওয়েজিয়ান ফুটবল ফেডারেশন নারী ও পুরুষ ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সমান বেতন ও ভাতা প্রদানের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়। এরপর ২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ড ফুটবল ফেডারেশন ও ২০১৯ সালে অষ্ট্রেলিয়া ফুটবল ফেডারেশন নারী ও পুরুষ ফুটবলারদের সমান বেতন ও ভাতার ঘোষণা দেয়। বিশ্বের মাত্র ৪র্থ দেশ হিসেবে ব্রাজিল নারী ফুটবলারদের পুরুষের সমান বেতন ও ভাতা প্রদানের ঘোষণা দিয়ে ফুটবল বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
খেলাধুলা তথা ফুটবলে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের জন্য সারা বিশ্বে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও আন্দোলন চলমান রয়েছে। বিশ্ব নারী ফুটবলের অন্যতম সফল দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি যা করে দেখাতে পারেনি, সেই কাজই করে দেখিয়েছে নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের মত তুলনামূলক কম সাফল্যমণ্ডিত দেশ। এর মধ্যে নরওয়ে একবার নারী ফুটবল বিশ্বকাপ জিতলেও বাকিদের বিশ্বকাপ প্রাপ্তির খাতা এখনও শূন্য।
২০১৯ সালের নারী দিবসকে সামনে রেখে মার্কিন নারী ফুটবলাররা তাদের ফেডারেশনকে একটি কড়া বার্তা পাঠায়। এই বার্তায় তারা ফুটবলে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের দাবি জানায়। তবে মার্কিন নারীদের এটিই প্রথম দাবি নয়। এর আগে ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও একাধিকবার তারা পুরুষের সমান বেতন ও ভাতার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মার্কিন ফুটবল ফেডারেশন সেই দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। ফলে মার্কিন নারী ফুটবলাররা আদালতের দারস্থ হন। কিন্তু মার্কিন আদালতও তাদের হতাশ করেন। পরবর্তীতে মার্কিন নারীরা আবারও আপিল করেন। এই আপিলের শুনানি এ বছরের ডিসেম্বরে হওয়ার কথা।
ক্রীড়া বিশ্বে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন নতুন নয়। খোদ মার্কিন মুলুকেও বহুবার এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ক্যাথরিন সুইজার নামের ২০ বছরের এক মার্কিন তরুণী বোস্টন ম্যারাথনে অংশ নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন। যদিও নারীরা এই ম্যারাথনে অংশ নিতে পারবেননা, এমন কোন লিখিত আইন ছিলনা, তবুও ম্যারাথনের ডিরেক্টর সুইজারকে বের করে দিতে চেষ্টা করেন।
আমরা অনেকেই সেরেনা ইউলিয়ামস, ভেনাস উইলিইয়ামস কিংবা মারিয়া শারাপোভাকে চিনি। কিন্তু অতীতে নারীদের টেনিসে অংশগ্রহণের সুযোগ ও প্রাইজমানি এখনকার মত ছিল না। ৭০-এর দশকে বিলি জিন কিং নামে একজন নারী টেনিস খেলোয়ার মার্কিন নারী টেনিস ফেডারেশন গঠনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ৫৫ বছর বয়সী সাবেক গ্রান্ডস্লাম বিজয়ী ববী রিগসকে টেনিস খেলায় পরাজিত করেন। টেনিস ইতিহাসে এই লড়াই ‘ব্যাটল অফ সেক্সেস’ নামে পরিচিত।
মার্কিন নারী টেনিস তারকা ভেনাস উইলিয়ামসের এক আন্দোলন ও উদ্যোগের ফলে ২০০৭ সালে উইম্বলডন কর্তৃপক্ষ নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের সমান প্রাইজমানির ঘোষণা দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও নামকরা টেনিস প্রতিযোগিতা হল উইম্বলডন। আ
নারী বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায়ও লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান। পুরুষ প্রতিযোগিদের বিভিন্ন চুক্তি ও বেতনের সুযোগ থাকলেও মার্কিন মুলুকের নারীদের রুকি শ্রেণিতে বেতন ও ভাতা প্রদান করা হয়। দীর্ঘদিন যাবত মার্কিন নারীরা এই বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন করে আসছেন। অবশেষে ২০১৮ সালে আজা উইলসন নামে একজন নারী প্রথম প্রফেশনাল চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাস্কেটবল থেকে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের পথে ভূমিকা রাখেন।
অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেট নারী দলকে জাতীয় নারী ক্রিকেট দল ও পুরুষদের দলকে জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে তারা নামের বৈষম্য বিলোপ করেছে। লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপ, নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে এটি অষ্ট্রেলিয়ার একটি বড় অর্জন।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা কোন অংশেই পুরুষের চেয়ে কম না। উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ পেলে নারীরা যে পুরুষের মতই সমান দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারেন, তা আজ নানা ক্ষেত্রে প্রমাণিত। ক্রীড়াক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। টেনিস, ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকসসহ সকল ক্রীড়াক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা আজ বিশ্বে দর্শক টানছে। নারী টেনিস, ক্রিকেট, ফুটবলের মার্কেট ভ্যালুও বাড়ছে। নওয়েজিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের দেখানো পথে বিশ্বের আরও দেশ আজ নারীদের পুরুষের সমান বেতন প্রদানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটি ভীষণ ইতিবাচক ঘটনা। সর্বশেষ সিবিএফ ব্রাজিলের ফুটবলে লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে মানবজাতি সমতার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আমরা আশাকরি বাংলাদেশও একদিন ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিকসহ সকল ক্রীড়া ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষ ক্রীড়াবিদদের সমান বেতন, ভাতা ও সম্মান প্রদানের মাধ্যমে ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে লিঙ্গবৈষম্য বিলোপে অগ্রগন্য ভূমিকা রেখে ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
লেখক- পর্তুগাল প্রবাসী
কায়সুল খান নেইমার ব্রাজিল নারী ফুটবল দল ব্রাজিল ফুটবল ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন মার্তা সিবিএফ প্রেসিডেন্ট রোজেরিও কাবক্লো