কর্মজীবী নারীর অনুপ্রেরণা, একজন অক্লান্ত কর্মী শেখ হাসিনা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৯:২৭
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা বলতে গেলে সবার আগে মাথায় আসবে তার রাজনৈতিক অর্জন এবং কৃতিত্বের কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন নিয়ে লিখতে গিয়ে তার সম্পর্কে তথ্য খোঁজাখুঁজি করছিলাম। তখনই মাথায় আসল, বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আড়ালে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। একজন কর্মজীবী নারী, যিনি ৭৪ বছর বয়সেও কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। তাকে দেখে কখনোই ক্লান্ত কিংবা অসুস্থ মনে হয় না। একটি দেশ ও বড় রাজনৈতিক দল চালিয়ে যাচ্ছেন ধীর-স্থির শান্তভাবে। সেই থেকেই একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে আমি একজন কাজপাগল শেখ হাসিনার কাজের দিকটা ভেবে দেখতে চেষ্টা করলাম।
যেহেতু জননেত্রী বা প্রধানমন্ত্রী রূপেই শেখ হাসিনাকে আমার সরাসরি দেখা হয়নি, বা তার জীবন সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তাই সুস্পষ্ট করে কিছু লেখা সম্ভব না। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন আর অপরের অভিজ্ঞতাই ভরসা।
চারবারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন- একবারে বলতে খুব একটা সময় না লাগলেও এর পেছনে রয়েছে অসামান্য শ্রমের গল্প। দেশ, দল ও পরিবারকে সময় দেওয়া, নিজেকে সুস্থ রাখা- কতটা চ্যালেঞ্জের তা নিজের কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই অনুধাবন করতে পারি কিছুটা। দেশ ও দল চালানর দায়িত্ব কোনো আট ঘণ্টার ডিউটি না, এটি ২৪/৭ ডিউটি। সারাক্ষণই সচেতন আর মনোযোগী থাকতে হয়। তার ওপরে নামটা যদি হয় শেখ হাসিনা, তার নামের সঙ্গে জুড়ে আছে পাহাড়সম দায়িত্ব। বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর কন্যার জন্য চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। যার বাবা শেখ মুজিব তার জীবন মসৃণ হওয়ার কথাও না। স্বাধীনতার আগে জীবনের একটা বড় অংশ জাতির পিতাকে জেলেই কাটাতে হয়েছে। যখন বাইরে থেকেছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। সেভাবে পরিবারকে সময় দেওয়া কখনোই হয়ে ওঠেনি বঙ্গবন্ধুর। সেই পরিবারের বড় সন্তান শেখ হাসিনাকে মায়ের সঙ্গে ছোট ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। হয়ত কিশোরী বা তরুণী হাসিনা তখন ভাবেননি যে একসময় একটা পরিবারের থেকে সেই দায়িত্ব ছড়িয়ে পড়বে কোটি পরিবারে।
জীবন কাটছিল আর দশটা বাঙালি তরুণীর মতই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়তে পড়তেই বিয়ে হয় তরুণ বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়াঁর সঙ্গে। একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যে জন্ম প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের। বাবা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তারা সপরিবারে গৃহবন্দী। এমন সময়ে গর্ভবতী শেখ হাসিনা। কেমন ছিল, তার মানসিক পরিস্থিতি? আজ স্বাধীনতার অর্ধশতকের আগ মুহূর্তের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার অনেক পরে জন্ম নেওয়া আমার সেই অনুভূতি বোঝা সম্ভব না। রাজনৈতিক নেতা হলেও বাবা, বাবাই। সেই বাবাকে আবার জীবিত দেখতে পাওয়া না পাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে রাতের পর রাত কাটানো অসম্ভব। তার ওপর যেকোনো সময় পরিবারশুদ্ধ খুন হওয়ার শঙ্কা, আনাগত সন্তানকে নিরাপদে ভূমিষ্ঠ করতে পারা না পারার অনিশ্চয়তা নিশ্চয়ই ভয়াবহ ছিলো।
সেই শেখ হাসিনাকে তাই বারবার দেখি যেন ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠেছেন। আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখতেই যেন তিনি বারবার বেঁচে ফিরেছেন শত্রুর হাত থেকে। শেখ মুজিবুর রহমানের বড় সন্তানের হাতেই যেন বাংলাদেশের ভবিতব্য লেখা ছিল। বাংলাদেশ হয়ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উন্নত দেশ না। সব সমস্যা এখনো উৎরে যাইনি আমরা, তবুও বাংলাদেশের ক্রমান্বয় উন্নতির ধারা অনেকের জন্যই উদাহরণস্বরুপ।
জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের আজকের দিনে। সেখানে বাল্যশিক্ষা শেষ করে ১৯৫৪ সাল থেকে সপরিবারে ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে চলে আসেন। পরে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে স্থানান্তরিত হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। সেই বাড়ি থেকেই প্রত্যক্ষ করেন বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকবদল। দেখেন স্বাধীনতার পথে পিতার ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলা, বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ। আবার সেই বাড়িতেই ঘটে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড। সৌভ্যাগ্যক্রমে বেঁচে যান, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
১৯৬৭ সালে বিয়ে আর ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ৯ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল আগস্টে তিনি ছেলে-মেয়ে ও ছোটবোনকে সঙ্গে নিয়ে ছিলেন স্বামী ওয়াজেদ মিয়াঁর সঙ্গে জার্মানি। তারপরই ঘুরে যায় তার জীবনের গতিপথ, অনিশ্চিতের পথে ছুটে চলা। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করলেও প্রতিনিয়ত ছিল মৃত্যুর হুমকি। নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়ে নাম বদল করে সেখানে থাকেন তারা। এরপর যুক্তরাজ্যে যান আর সেখান অবস্থানকালেই নির্বাচিত হন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। নির্বাসিত থাকা অবস্থায় এভাবে সভাপতি নির্বাচনের ঘটনা একই সঙ্গে অভাবনীয় আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম পালাবদলকারী অধ্যায়। সেই থেকে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন, অনবদ্য এক নাম। ভারত ও যুক্তরাজ্যে ছয়বছরের নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দুই সন্তানের দায়িত্ব নেন তার ছোটবোন শেখ রেহানা।
যে দেশে তার স্বাধীনতার বার্তাবাহক স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছরের মাথায় খুন হন স্বপরিবারে, সেই দেশে তার উত্তসুরির ফিরে আসার পথে ছিল পদে পদে বিপদের আশঙ্কা। কারণ, স্বাধীনতা বিরোধীরা শেখ মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র আট বছরের রাসেলকেও যে ছাড়েনি সে রাতে। নিজের জীবনের পরোয়া না করে দেশে আসেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন ভাঙনের মুখে থাকা পিতার গড়া দলের। ঘুরে বেড়ান দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। আজকের বাংলাদেশ আর চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জন তাই রূপকথার মতই। যে বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী তখনো কর্মজীবী নন, সেই আশির দশকে রাজনীতির মত অনিশ্চিত পথ বেছে নেন শেখ হাসিনা। ৩৯ বছরে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা মোকাবিলা করে এখনো স্বপ্ন দেখেন বাংলদেশকে এক উন্নত দেশ হিসেবে গড়বেন।
যেখানে বাংলাদেশের মানুষের কর্মজীবনের আয়ু মাত্র ৫৫ থেকে ৬০, সেখানে ৭৪-এও অক্লান্ত ছুটে চলা শেখ হাসিনা প্রতিটি নারী ও পুরুষের জন্যই অনন্য অনুপ্রেরণা। তার কর্মজীবন ও ত্যাগ তিতিক্ষা প্রতিটি মেয়ে শিশু, কিশোরী ও তরুণীর জন্য আদর্শ। শেখ হাসিনার জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে বিপদের ভয় উপেক্ষা করে, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হয়। এদেশেই শুধু নয়, পুরুষতান্ত্রিক এই পৃথিবীতে মেয়েদের চলার পথ কখনোই মসৃণ নয়। সেই পথ পেরোতে তাই দরকার অতিরিক্ত সাহস, মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি। বারবার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেও এগিয়ে যেতে হবে মানসিক দৃঢ়তাকে সঙ্গি করে। চলার পথে কারও সঙ্গ না পেলেও নিজের কষ্ট আর হতাশা ঢেকে এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক ততদূর হাঁটতে হবে, যতদূর হাঁটলে পৌঁছানো যাবে নিজের ঠিক করা গন্তব্যে। একজন শেখ হাসিনা তাই বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রীই নয়, অগণিত সাফল্য, দুখ-বেদনা জয় করে জয়ীর বেশে মাথা উঁচু করে থাকা এক বাতিঘর। সেই বাতিঘর আমার মত কর্মজীবী নারীর জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে হাজার বছর। জয়তু শেখ হাসিনা। শুভ জন্মদিন প্রধানমন্ত্রী।