জীবন এখানেই শেষ নয়…
২৯ অক্টোবর ২০২০ ১৫:২৯
কেস স্টাডি ১# রুম্পা, পুরো নাম ফারিহা তাবাসসুম। ‘ফারিয়া’ শব্দের অর্থ সুখী আর ‘তাবাসসুম’ অর্থ মুচকি হাসি। অথচ মুচকি হাসির সেই সুখী রুম্পা আজ কেবল এক দুঃখ তারার নাম। সুখ হবার বদলে কেন সে দুঃখ হয়ে গেল?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ফারিয়া তাবাসসুম রুম্পা প্রিয় মানুষটিকে পাশে নিয়ে একসাথে সারা জীবন পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখেছিল। তাতে বাঁধ সাধল পরিবার। পরিবার থেকে তার অমতে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। সে কারণেই রুম্পা অভিমানে আমাদের ছেড়ে, পরিবারকে ছেড়ে, তার প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
কেস স্টাডি ২# করোনা মহামারির সময়েই খুব ধুমধাম করে বিয়ের পিড়িতে বসল লিসা-তৌফিক (ছদ্মনাম)। অথচ দিন বিশেক আগে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির রেশ ধরে জীবনসঙ্গির সঙ্গে অভিমান করে লিসা একমুঠ ঘুমের বড়ি খেয়ে বসেছিল। যার সাথে অভিমান সেই ছেলেটি এ খবর শুনে নিজেই বলে উঠেছিল, লিসা যদি না থাকে, এই পৃথিবীতে তার বেঁচে থেকে কী লাভ?
ঢাকা মেডিকেলের ওয়াসার পানির স্রোতে ভাসা শীতল ভেজা স্যাঁতসেঁতে কক্ষটা থেকে ফিরে আসে খুব কম মানুষ। লিসা কি তৌফিকের সে কথা শুনেছিল? টেলিপ্যাথি কি সত্যিই কাজ করে? যদি কাজ না করত তাহলে লিসাও নিশ্চয়ই রুম্পার মত দুঃখ তারা হয়ে যেত ।
কেস স্টাডি ৩# সুমা-তমালের (ছদ্মনাম) প্রেমের বয়স প্রায় ছয় বছর। দুজনে পার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। ঠিক করেছিল, চাকরিতে একটু থিতু হয়ে বিয়ে করবে। হঠাৎ সুমা বুঝতে পারে, তমাল কেমন বদলে যাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে উঠল সুমার। খুব বেশিদিন আর অপেক্ষা করতে হল না তাকে। একদিন তমাল এসে নিজেই জানিয়ে দিল তার অপারগতার কথা। এত বছরের সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়া সহ্য করতে পারল না সুমা। জীবনকে শেষ করে দেবে ঠিক করেছিল। ঠিক সেই দুঃসময়ের দিনগুলোয় সুমার মা হয়ে উঠলেন মেয়ের সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা। মায়ের এই আশ্রয় সুমাকে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখার শক্তি জুগিয়েছে জীবনের পরবর্তী ক্ষেত্রগুলোয়।
আশার জীবন, মায়ার জীবন, স্বপ্নের জীবন, শত আকাংখার জীবন কী করে এক নিমেষে শেষ করে দেওয়া যায়?- এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। হয়ত রুম্পার কাছে আছে। কিন্তু তা জানার যে কোন উপায় নেই। নিজেই নিজের মুক্তির যে সরল পথ আমরা ভেবে নেই তা যে সরল নয় সে উত্তর হয়ত লিসা জানে। কিংবা কি জানি রুম্পা-লিসা-সুমা আমি-আপনি-আমরা কেউ জানি না।
তবে আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। ছেলে-মেয়ে উভয়ের জীবনেই ঘটতে পারে সম্পর্ক ভাঙার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা। মানব সম্পর্কের উত্থান-পতন রয়েছে। এক জীবনে প্রিয় মানুষকে পাওয়া না পাওয়ার সমীকরণ সব সময় নাও মিলতে পারে। কিন্তু জীবন এখানেই শেষ নয়। জীবন অনেক বড়। সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার মতো ঘটনায় সবকিছু থামিয়ে দিলে চলবে না; বরং সামনের জীবনের জন্য নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে হবে। কিংবা পুরোনো সম্পর্ককে সম্ভব হলে নতুন করে লালন করতে শিখতে হবে। পরিবারকে যদি নিজের প্রিয় মানুষকে বিয়ে করার জন্য মানানো না যায় তবে সময় নিয়ে বার বার তাদের বোঝাতে হবে। কারণ যুদ্ধটা না করে, লড়াইটা না লড়ে, স্বপ্নের জীবনকে জয় করা যাবে না গোলাপ পেতে হলে সাথে কাঁটার আঘাতও নিতে হবে। যারা ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যবতী তাদের কথা অবশ্য আলাদা।
পাশাপাশি আমাদের বুঝতে হবে, পরিবার কখনো প্রতিপক্ষ হতে পারে না। প্রয়োজনে কখনো কখনো কঠোরকেও কোমল হতে হয়। পরিবারকে তাই সন্তানের সিদ্ধান্তে পাশে থাকতে হবে। সন্তান যদি তার পছন্দের সম্পর্কে সুখি থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক মেনে নেওয়া উচিৎ। অভিমানে যে চলে যায় তার পরিবার কেবল বুঝে তারা কী হারাল। তাই হারিয়ে ফেলার আগে আমাদের সন্তানের মত করে সন্তানের সুখ নিয়ে ভাবতে হবে।
পরিবার ছাড়াও সম্পর্ক ভাঙার আরও উপলক্ষ থাকতে পারে। দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে ভাঙন দেখা দিতে পারে। নদী যেমন একূল ভেঙ্গে ওকূল গড়ে, জীবনও তাই। সম্পর্ক ভাঙার মতো চরম সত্যকে মেনে নেওয়ার মত মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। হঠাৎ করে প্রিয় মানুষ প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস ভাঙলে তা মেনে নেওয়া খুব সহজ কোনো বিষয় নয়; এটি বেদনাদায়ক। তবু এর জন্য জীবনকে থামিয়ে দিলে চলবে না। মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে শিখতে হবে। এখানেও পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের সবাইকে বুঝতে হবে, যার জীবনে সম্পর্ক ভাঙার এ ঘটনা ঘটেছে, তিনি খুব কষ্টে আছেন। তার মনের কষ্ট কমিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবারের কাছের মানুষের। তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে ও কোথাও ঘুরতে নেওয়া যেতে পারে; প্রয়োজনে তাকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যেতে পারেন।
জীবনে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান থাকবে। এটিই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, আপনি একটি পরিবারের সদস্য। পরিবারের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, আপনার ভালো থাকা ও খারাপ থাকার ওপর তাদেরও ভালো-মন্দ নির্ভর করে। তাই মা-বাবা ও ভাইবোনের ভালোবাসার বন্ধনকে ছোট করে দেখে স্বার্থপরের মতো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কাছের মানুষটির কাছে মন খুলে সব দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। দেখবেন, অনেক হালকা হয়ে গেছেন। বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যতটা সম্ভব সময় কাটান। নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখুন। বিতর্ক, আবৃত্তি ও খেলাধুলার মতো গঠনমূলক ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। ব্যায়াম করলেও অনেক সময় হতাশা কমে যায়।
সম্পর্কের ভাঙা-গড়াকে জীবনের আর দশটি ছোটখাটো অপ্রাপ্তির ঘটনার মতো ভাবতে চেষ্টা করুন। কারণ, জীবন এখানেই শেষ নয়…
লেখক- চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়