যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের চার বছর পর আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে একই খেলায় আরও কিছু দেশ যুক্ত হচ্ছে। গত আগস্টে, ইউএস ন্যাশনাল কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সেন্টার-এর পরিচালক উইলিয়াম এভেনিনা মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়া, চীন ও ইরানের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সতর্ক করেন। গত সপ্তাহে জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক জন র্যাটক্লিফ ও এফবিআই-এর পরিচালক ক্রিস্টোফার এ. র্যা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন— রাশিয়া ও ইরানের কাছে আমেরিকার ভোটারদের রেজিস্ট্রেশন ডেটা রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস এ সংক্রান্ত খবরের উপসংহার টানে এই বলে যে, “নির্বাচনের আগের সপ্তাহে এই দুই দেশ প্রভাব খাটানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।”
আমেরিকানরা তাদের নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে এই চর্চা কিন্তু নতুন নয়। বহু আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন চর্চায় শীর্ষস্থানীয়। ডভ লেভিন যেমন তার বই মেডিং ইন দ্য ব্যালট বক্স-এ দেখিয়েছিলেন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (পরবর্তীকালে রাশিয়া) ১৯৪৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনে ১১৭টি বিদেশি নির্বাচনে প্রার্থী বা দলকে সাহায্য বা বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। এর মধ্যে ৮১টি ক্ষেত্রেই (৬৯%) যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল।
বিদেশি নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বড় একটি উদাহরণ হলো— ১৯৪৮ সালে স্নায়ুযুদ্ধের শুরুতে ইতালির নির্বাচনে সিআইএ’র প্রথম গোপন তৎপরতা। ইতালির নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত করতে গোপনে কাজ করেছিল সিআইএ। তখন মার্কিন সমর্থিত ইতালিয়ান রাজনীতিবিদদের প্রচার-প্রচারণায় সহায়তা দিতে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল। একই রকম আরও বহু প্রচেষ্টা পুরো স্নায়ুযুদ্ধের সময় ধরে চলতে থাকে। রিগড নামক বইয়ের লেখক ডেভিড শিমারকে সিআইএ ইতিহাসবিদ ডেভিড রোবার্জ বলেছিলেন, “ওই সময়ে এজেন্সটি ‘মাঝে মাঝে’ সরাসরি ভোটে হস্তক্ষেপ করত।” তার এই কথায় প্রমাণ হয়— সিআইএ আসলে ভোটে হস্তক্ষেপ করত।
স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর মার্কিন সরকার অন্যান্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। কংগ্রেশনাল ইন্টেলিজেন্স কমটিগুলো এর বিরোধিতা করে এবং নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে বিভাজন দেখা দেয়। তবুও শেষ পর্যন্ত এই চর্চা জারি থাকে। ২০০০ সালে তৎকালীন যুগোস্লাভের প্রেসিডেন্ট স্লোবোডান মিলোয়েভিয়ের পুননির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে বিরোধীদের সমর্থন দিতে জন্য সিআইএ’কে গোপন তৎপরতা চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ২০০৫ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পরপর যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে জর্জ ডব্লিউ বুশ গোপন হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করেছিলেন; তবে কংগ্রেস কমিটির কঠোর বিরোধিতায় তার পরিকল্পনা বাতিল হয়েছিল। শিমারের মতে— প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনও একই রকম এক প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছিল, যদিও পরে তা বাতিল করা হয়।
তুলনামূলক সাম্প্রতিককালের এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে আমেরিকানদের নিজেদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপে ক্রোধ একসঙ্গে মিলে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হলো— আমেরিকা কি এখনও বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে? বা, তা করার দরজা কি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খোলা?
কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা শিমারকে বলেছিলেন, একুশ শতকে এসে বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার নীতি বাদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু অন্যরা এখনও এই নীতি ধরে রেখেছে। সিআইএ’র সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর জন ম্যাকলাফলিন বলেন, “স্বাধীনতা ও উদারতার মতো বিষয়গুলোতে গোয়েন্দা সংস্থার করার কিছু নেই, স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে হয়তো কিছু করা হতো।” একই পদে চাকরি করা আরেক কর্মকর্তা অ্যাভ্রিল হাইনেস বলেছিলেন, “কোনো নির্বাচনে কারসাজি করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।” তবে শিমার জানিয়েছেন, সিআইএ এখনও কিভাবে ভোটারদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। সে সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করতে তিনি অবশ্য রাজি হননি। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রাক্তন পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার একই বিষয়ে অবশ্য বলেছিলেন, “এটি মূলত মাত্রার (ডিগ্রি) ব্যাপার।”
সিআইএ’র প্রাক্তন পরিচালক লিওন প্যানেটা এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “এই এজেন্সি ভোট পরিবর্তন করে না বা বিশৃঙ্খলা ছড়ায় না, তবে বিদেশি গণমাধ্যমগুলোকে দেশের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে প্রভাবিত করে।” প্যানেটা শিমারকে আরও বলেছিলেন, “সিআইএ মাঝে মাঝে কোনো দেশে বা অঞ্চলের এমন মিডিয়াকে কাজে লাগায় যার মাধ্যমে বিভিন্ন বার্তা ছড়ানো যায়। অথবা সেই বার্তা প্রেরণে এমন লোকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে যারা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।” এর মাধ্যমে প্যানেটা আসলে কী ধরনের কর্মকাণ্ডের কথা বুঝালেন তা বুঝে নেওয়া কঠিন। সম্ভবত, তিনি নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে সিআইএর’র প্রচলিত প্রোপাগান্ডা কার্যক্রমের কথাই বুঝিয়েছেন। তবে তাদের কথার সঙ্গে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া অপারেশনের মিল পাওয়া যায়।
মার্কিন কর্মকর্তাদের এ ধরনের বিভিন্ন মত সম্ভবত শুধুই সংজ্ঞাগত পার্থক্য। নির্বাচনী হস্তক্ষেপের বহু রূপ আছে। ভোট পরিবর্তন থেকে শুরু করে গুজব, ডক্সিং, প্রোপাগান্ডা এবং অর্থনৈতিক সহায়তার মতো ব্যাপার আছে। এসব ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে শিমার আমাকে একটি চিত্র বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “বিদেশি নির্বাচনে গোপনে হস্তক্ষেপের চর্চা যুক্তরাষ্ট্র এখনও বন্ধ করেনি। তবে এটি এমন একটি বিকল্প যা খুবই জরুরি অবস্থা ছাড়া করা হয় না। স্নায়ুযুদ্ধের মতো এখন আর হয় না। পার্থক্য রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আর এ কাজ করবেই না— এমন সুস্পষ্ট অবস্থান নেই।”
শিমার আরও জানান, এই চর্চার বিষয়ে কী করা যায় এ নিয়ে মার্কিন সরকার দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, আমেরিকাকে অবশ্যই এই পথ পরিত্যাগ করতে হবে, তবে অন্যরা একমত নন। প্যানেটা মনে করেন, বিদেশি নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে টেক্কা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এই বিকল্প চালু রাখা। বিদেশি নেতাদের টাকা, প্রোপাগান্ডা ও অন্যান্যভাবে সহায়তা করা। একইভাবে ম্যাকলাফলিন বলেন, “আমি গোপনে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার বিষয়টি টেবিল থেকে সরিয়ে রাখতে চাইব না।”
কিন্তু আমেরিকা কি এই চর্চাটি টেবিলে রেখে তাদের নিজের নির্বাচনে অন্য দেশের হস্তক্ষেপে প্রতিবাদ করতে পারে কি? এ প্রশ্নের উত্তরটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ঠিক যখন এই ধরনের আগ্রাসী চর্চা কমিয়ে এনেছে, তখনই ইন্টারনেটের উদ্ভব। আর ইন্টারনেটের ফলে এখন এ কাজ খুবই সহজ, সস্তা ও আরও কার্যকর হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো হুমকির মুখে পড়েছে, কারণ তাদের কাছে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া তারা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। এবং গত চার বছরে আমরা যেমন জানলাম, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধ করা খুবই কঠিন। প্রাক-ইন্টারনেট যুগে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করত এবং প্রতিবাই ব্যর্থ হতো। তবে ২০১৬ সালে রাশিয়া একাজে পুরোপুরি সফল হয়।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী প্রতিপক্ষরা যে নির্বাচনকালীন হস্তক্ষেপ করছে তা মোকাবিলার উপায় ঠিক করতে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র কাজ শুরু করেছে। একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে— তা হলো ‘ডিফেন্ড ফরোওয়ার্ড’— যার মাধ্যমে বিরোধী নেটওয়ার্কে অবস্থান করে হস্তক্ষেপ শুরু হওয়ার আগেই তা বন্ধ করা। আরেকটি হলো— নির্বাচনে গোপন বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নীতি আরও প্রসারিত করা। তবে বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ শতকের ইতিহাস এ ধরনের রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামান্যই সাহায্য করবে— যতক্ষণ পর্যন্ত দেশটি স্পষ্ট ঘোষণা দেবে না যে তারা আর এ কাজ করবে না। তবে দেখে মনে হচ্ছে এ ধরনের স্পষ্ট ঘোষণা দিতে দেশটি মোটেও ইচ্ছুক নয়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ল’ স্কুলের আইনের অধ্যাপক ও হোভার ইন্সটিটিউশনের সিনিয়র ফেলো
জ্যাক গোল্ডস্মিথের এই লেখাটি ২৮ অক্টোবর প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত।
ভাষান্তর: আতিকুল ইসলাম ইমন