|| ডটার অব বাংলাদেশ – পৃথুলা রশিদ||
১৩ মার্চ ২০১৮ ১৮:৩৫
১.
পৃথুলা রশিদ। নামটি লেখার পর অনেকক্ষণ ধরে স্তব্ধ হয়ে আছি। পরের বাক্যটি কী লেখা যায়। এই ছোট্ট কলামে তাঁর মহিমা লিখে আদৌ শেষ করা যাবে কি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পৃথুলা নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন,
‘Ordinary girl with extraordinary love for aviation, literature and floofy animals.’
নাহ্, পৃথুলা মোটেই অর্ডিনারি ছিলেন না। আমাদের মতো ছাপোষা, স্বার্থপর মানুষ হলে তিনি নিজের জীবন বাঁচানো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আদতে তো তা-ই করার কথা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করাটাই স্বাভাবিক আচরণ। ওরকম পরিস্থিতিতে পেশাদারিত্ব, কর্তব্যবোধ এসব মহান বাণী চলে না। কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ থাকেন, মনুষ্যত্বের বিপুল বোধে উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে উজ্জ্বল করেন, সেই সাথে তাঁর বিচরণের পথটিকেও আলোয় ভরে তোলেন।
পৃথুলা ছিলেন গত সোমবার নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজের সহকারী পাইলট। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক বিমানের প্রথম নারী পাইলটই শুধু নন; তিনি ছিলেন এ এয়ারলাইন্সের প্রথম নারী পাইলট।
কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মোট ৬৭ জন যাত্রীর মধ্যে নিহত হন ৫০ জন। জীবিত ১৭ জনের মধ্যে ৯ জন রয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিক।
মোট চার জন ক্রুর মধ্যে কো-পাইলট পৃথুলাস ঘটনাস্থলে মারা যান দুইজন। আর পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মঙ্গলবার সকালে।
২.
নিজের সম্পর্কে সঠিক বলেননি পৃথুলা। তিনি সাধারণ একজন নারী মাত্র নন। মৃত্যুর আগে নিজের জীবনের বিনিময়ে তিনি বাঁচিয়ে গিয়েছেন দশ জন নেপালি যাত্রীকে। সবথেকে প্রিয়, সবথেকে মূল্যবান অমূল্য জীবনকে উৎসর্গ করেছেন যাত্রীদের জন্য। এ কারণে নেপালের গণমাধ্যম পৃথুলাকে আখ্যায়িত করেছে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ নামে। তিনি আমাদের সবার অহংকার, বাংলাদেশের গর্ব।
পৃথুলার কথা বলতে গিয়ে নেপালের সংবাদমাধ্যম “সিকিম মেসেঞ্জার” বলেছে,
‘Daughter of Bangladesh sacrificed her life while saving the citizens of Nepal today :
This young Pilot from Bangladesh dies in a tragic plane crash today in Kathmandu while saving Nepali citizens’
অথচ কী নিদারুণ বিস্ময়, এ মহীয়সী নারীও রেহাই পেলেন না পিতৃতন্ত্রের কুৎসিত আর জঘন্য আক্রমণ থেকে। কেবলমাত্র নারী হওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁর মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সাহসিকতার একচুল পরিমাণ দাম নেই অসভ্য পুরুষের কাছে। স্বাবলম্বী, স্বাধীন, কর্মজীবী নারী এই সমাজের অন্ধকার পুরুষের কাছে ভয়াবহ অস্বস্তি ও ভীতির নাম। মধ্যযুগের অন্ধকারে পথ হারানো ইতর পুরুষ কিছুতেই মানতে চায় না যে সমান সুযোগ ও সুবিধা প্রাপ্ত হলে পুরুষের চেয়ে দক্ষতায় নারী কোন অংশেই কম যায় না, বরং অনেকক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
অনলাইনে প্রকাশিত অজস্র পোস্ট, কমেন্ট, রিপ্লাইতে দোষী করা হচ্ছে পৃথুলাকে। নারী হয়ে প্লেন চালানোতেই নাকি ওই বিপত্তি, ওই ধ্বংসযজ্ঞ! অথচ, ওই প্লেনের প্রধান পাইলট তিনি ছিলেন না! একই দুর্ঘটনায় নিহত আবিদ সুলতান ছিলেন প্রধান, কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ। পুরুষ হওয়ার সৌভাগ্যে আবিদ নিষ্কৃতি পেলেন বটে। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁরই সহকর্মীর উপর বর্ষিত অনলাইনের এসব কদর্যতা দেখে নিশ্চয়ই তীব্র ঘৃণায় থু থু ফেলতেন।
পরিশেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পৃথুলা রশিদ কেবল আমাদেরই হিরো নন, তিনি এই পৃথিবীর হিরোদের হিরো। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ। তিনি ডটার অফ বাংলাদেশ। স্যালুট হে মহীয়সী নারী! এই দেশে জন্ম নেওয়া বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি শিশুর কাছে আপনার বীরত্বের কথা, আপনার মহত্বের কথা পৌঁছে যাবে একদিন!
সারাবাংলা/আরএফ
ইউএস-বাংলা উড়োজাহাজ ডটার অব বাংলাদেশ ত্রিভুবন বিমানবন্দর পাইলট পৃথুলা রশিদ বিমান দুর্ঘটনা