Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কূটনৈতিক যুদ্ধে চীনকে টেক্কা তাইওয়ানের নারীদের


২ নভেম্বর ২০২০ ১৯:৩৪

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলানোয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাইওয়ানের ডিজিটাল বিষয়ক মন্ত্রি অড্রে তাং

বিশ্বের দরবারে নিজেদের ব্রান্ডিংয়ে প্রতিবেশি তাইওয়ান থেকে বহুগুণ এগিয়ে আছে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর মতো সামর্থ্যও স্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি।

অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দেশ হলেও তাইওয়ান কূটনৈতিকভাবে বলতে গেলে একঘরে। তবুও তারা চাইনিজ প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেকটাই সফল। এর কারণ তাইওয়ান সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বৈশ্বিক দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত আছে একাধিক দক্ষ নারী।

বিজ্ঞাপন

নারীদলের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে রয়েছেন সিয়াও-বি-খিম। গত গ্রীষ্ম থেকে তিনি তাইওয়ানের ‘ডি ফ্যাক্টো অ্যাম্বাসাডর’ হিসেবে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত হয়েই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। এভাবে তাইওয়ানের সবচেয়ে কৌশলগত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তিনি।

এদিকে তাইওয়ানের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি সাই ইং-ওয়েন দায়িত্ব হাতে নিয়েই সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের নিয়োগ দেন। প্রতিবেশী চিন তাইওয়ানের সব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রুখতে তৎপর, এমনকি নতুন করে বিধিবনিষেধ আরোপেরও হুমকি দেয় তারা। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে নারীদের নিয়োগ ছিল সাই ইং-ওয়েনের দারুণ একটি চাল যা অনেকটাই কাজে লাগছে। ‘নারীপ্রধান’ তাইওয়ান এখন বেইজিংইয়ের সঙ্গে শক্তির খেলায় কিছুটা নরম চাল চালছে আর গুরুত্ব দিচ্ছে কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে।

এই কার্যকরী নারীদল সম্পর্কে ই-মেইল বার্তায় সিয়াও জানান, এশিয়ার মধ্যে রাজনীতিতে তাইওয়ানের নারীদের অংশগ্রহণের হার অনেক বেশি। দেশটির আইনসভায় ৪০ শতাংশেরও বেশি নারী। আর এদের প্রায় সবাই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এসেছেন। কেউ ছিলেন শিক্ষক, কেউ বেসরকারি সংস্থার মালিক কেউবা আবার ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।

বিজ্ঞাপন

আমেরিকার সঙ্গে তাইওয়ানের সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্কের অভাব থাকলেও চার দশকের মধ্যে এখন তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত। সিয়াও আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চাপ দিচ্ছেন। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি জানান, চিন তাইওয়ানকে আক্রমন করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে সাহায্য করবে কিনা সে সম্পর্কিত কৌশলগত অস্পষ্টতা দূর করার সময় এসেছে। ‘আমাদের প্রয়োজন কিছুটা স্পষ্টতা’ বলেন তিনি। তবে ক্রমবর্ধমান চীনা হুমকির মুখে খুব বেশি সমর্থনের আশা করেন না বলেও জানান তিনি।

বার্তা যুদ্ধে গুরুত্ব
বার্তা যুদ্ধ অর্থাৎ প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছেন সিয়াও। ওয়াশিংটন পোস্টে সাক্ষাতকার দেওয়া ছাড়াও আরও কিছু পাবলিক ইভেন্টে অংশ নেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়া সোসাইটির সঙ্গে পলিটিকোর ‘অল থিংস কনসিডারড’ নামক সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘নারীদের আন্তর্জাতিক বিষয়’ সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়া।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পাওয়ার প্রকল্পের পরিচালক বনি গ্লেজার বলেন, ‘সিয়াও বেশ দ্রুতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছেন। এবং কোভিড-১৯ দ্বারা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও তাইওয়ানের নীতিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ তো রয়েছেই। সেইসঙ্গে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী শাখা থেকে শুরু করে মিডিয়া ও থিংক ট্যাঙ্কের অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন।’

এদিকে আমেরিকাই একমাত্র দেশ যারা তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে ইচ্ছুক। এবং চিন হামলা চালালে তারাই পাশে এসে দাঁড়াবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সিয়াওর কার্যকরী কূটনৈতিক চালের কারণেই আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর তাইওয়ানের কাছে চার কোটি ২০ লাখ ডলারের অস্ত্র বিক্রির দুটি প্যাকেজ অনুমোদন করেছে যা কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম।

তাইওয়ানিজ বাবা ও আমেরিকান মায়ের সন্তান ৪৯ বছরের সিয়াও তাইওয়ানের দক্ষিণের শহর তাইনানে বেড়ে উঠেছেন। সেখানকার ওবারলিন কলেজ থেকে পূর্ব এশীয় গবেষণায় স্নাতক করার পর যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেসময়ে তিনি তাইওয়ানের ডেমোক্রেটিক পগ্রেসিভ পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাইওয়ানে ফিরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদানের আগেই তিনি কার্যকলাপ সমন্বয়কারী হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ শুরু করেন।

পার্টিতে ধাপে ধাপে উপরে ওঠেন তিনি এবং ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে তাইওয়ানের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। পরপর চার মেয়াদে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে সিয়াও তাইওয়ানে নানারকম প্রগতিশীল পরিবর্তনে কাজ করেন যেমন- সমকামী বিয়ের বৈধতা দান ও বিদেশ বিষয়ক জাতীয় সুরক্ষা কমিটি গঠন। এসবই তার নির্বাচনে সফলতার কারণ বলে মনে করা হয়। ওয়াশিংটনের অনানুষ্ঠানিক দূতাবাসে যোগদানের আগে তিনি রাষ্ট্রপতি সাইয়ের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।

চিনের সঙ্গে পার্থক্য গড়েছে যা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে তাইওয়ানের চিনের থেকে এগিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে নারীপ্রধান কূটনীতি। যেখানে চীনা কূটনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নাই বললেই চলে। গ্লেসিয়ার বলেন, বেইজিংইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে কার্যত নারীদের কোন প্রভাব নেই বললেই চলে। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির শীর্ষ ২৫ সদস্যের পলিটব্যুরোতে কেবলমাত্র একজন নারী আছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাত সদস্য বিশিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে নাই একজনও নারী।

অন্যদিকে তাইওয়ানের আইনসভায় ৪৩ শতাংশ নারী যা এশিয়ার মধ্যে নারী প্রতিনিধিত্বের হারে সর্বোচ্চ এবং সারা বিশ্বেও প্রথমদিকেই রয়েছে।

সিয়াওয়ের মতো যেসব নারীরা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে তার মধ্যে একজন হলেন তাইওয়ানের ডিজিটাল মন্ত্রী অড্রে তাং। করোনাভাইরাস মহামারি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।তাইওয়ানের সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম রুপান্তরকামী হিসেবে ৩৫ বছর বয়সে তিনি তাইওয়ানের মন্ত্রিসভার সদস্যপদ লাভ করেন। তাইওয়ান সরকার গৃহীত ‘মৌলিক স্বচ্ছতা’ ও ক্রাউড-সোর্সিং আইনের রূপকারও তিনিই। এক বক্তব্যে তাং বলেন, ‘লৈঙ্গিক সমতা অর্জনে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে কাজ করছে ও ভালো ফলাফল আনতে সক্ষম হয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সহনশীল সমাজ হিসেবে সরকার ও জনগণ সর্বদা একে অপরের কথা শুনে চলে।’

বিশ্বের কাছে তাইওয়ানের বার্তা পৌঁছে দিতে টুইটারই প্রধান প্ল্যাটফর্ম। এখানে সাইয়ের অনুসারির সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশি যা তিনি ভারতীয় টুইটার ব্যবহারকারীদের কাছে তার সফল প্রচারমাধ্যম হিসেবে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে সম্প্রতি টুইটারে যোগদান করা সিয়াওয়ের অনুসারিরর সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩৫ হাজারের বেশি।

তাইওয়ানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাম্প্রতিক এক টুইট বার্তায় সিয়াও তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা সম্বলিত একটি মাস্ক পরেছিলেন যেখানে লেখা ছিল, ‘তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ শক্তি’। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রকে লাখ লাখ মাস্ক উপহার দেয়। তার এই ছবি সেই দিকটাই ইঙ্গিত করে। এভাবেই নারী-প্রধান রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কূটনীতি দিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করছে তাইওয়ান।

সূত্র- দ্য জাপান টাইমস

ভাষান্তর- রাজনীন ফারজানা

চিন তাইওয়ান তাইওয়ান-চিন কূটনৈতিক যুদ্ধ তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর