‘তুমি আর আমার মা নও’— নির্বাচন যেভাবে আমেরিকাকে দু’ভাগ করছে
২ নভেম্বর ২০২০ ২৩:৪৩
আজীবন ডেমোক্রেট সমর্থক মায়রা গোমেজ যখন তার ২১ বছর বয়েসী ছেলেকে বলেছিলেন— মঙ্গলবার তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিতে যাচ্ছেন, তখনই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “সে আসলে আমাকে বলেছিল— ‘তুমি আর আমার মা নও, কারণ তুমি ট্রাম্পকে ভোট দিচ্ছ”। মায়রা গোমেজ উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়েকি শহরের বাসিন্দা। তিনি জানান, ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথাবার্তা এত তিক্ততায় ভরা ছিল যে, ফের এ সম্পর্ক জোড়া লাগবে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। “ট্রাম্প যদি এবার নির্বাচনে হেরেও যান তবুও এ সম্পর্ক সহজে ঠিক হবে না”— বলেন তিনি।
গোমেজ বলেন, “ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। মানুষের মনের মধ্যে ট্রাম্প একজন দানবরূপে স্থান পেয়েছেন। এটা দুঃখজনক। ট্রাম্পকে সমর্থন করার কারণে কিছু লোক এখন আমার সঙ্গে আর কথাই বলে না”। অবৈধ অভিবাসীদের শায়েস্তা করা ও শক্ত হাতে অর্থনীতি পরিচালনা করার কারণেই মূলত গোমেজ ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট মেয়াদকালে শুধু এই গোমেজ পরিবারই যে বিভক্ত হয়েছে এমন নয়, এরকম আরও অসংখ্য পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে। ট্রাম্পের সময়ে এসব সম্পর্কে যে মাত্রার তিক্ততা জমেছে, তা এবার তিনি হেরে গেলেও সহজে তিরোহিত হবে না বলে মনে করেন এদের অনেকেই।
সম্প্রতি দশ জন ভোটারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এমন এক চিত্র উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার দাতাদের পাঁচ জন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ও পাঁচ জন জো বাইডেনের সমর্থক। খুব কম ভোটারই মনে করেন, ট্রাম্পের সময়ে যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি হয়েছে তা হয়ত কোনোভাবে ঠিক করা সম্ভব। তবে বেশিরভাগই ভিন্ন মত দিয়েছেন। তাদের কথা হলো— এসব কারণে সম্পর্ক এতই খারাপ হয়েছে যে, তা আর কখনই ঠিক হবে না। ব্যক্তিগত সকল বোঝাপড়া চিরতরে উবে গেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মেয়াদের চার বছরে তার সমর্থক ও বিরোধিদের মনে কঠোর অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছেন। অভিবাসন নীতি, আদালতে রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ ও তার কঠোর ভাষণ-বিবৃতর (যাকে তারা বলছেন— সোজা কথা) কারণে তার সমর্থকদের কাছ থেকে আরও বেশি হাততালি পেয়েছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে ডেমোক্রেট ও অন্যান্য সমালোচকরা সাবেক এই আবাসন ব্যবসায়ী ও রিয়েলিটি শো তারকাকে আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করছেন। তাকে একজন মিথ্যাবাদী এবং বর্ণবাদী হিসেবে চিহ্নিত করছেন তারা। তাদের মতে, ট্রাম্প করোনাভাইরাস মহামারি দমনে ব্যর্থ— ফলে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ট্রাম্প অবশ্য এসব খবরকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করে কখনই আমলে নেননি।
এখন, যখন নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন— তখন, মানুষের মনে এ প্রশ্ন জেগেছে, মার্কিন ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশকে সবচেয়ে বেশি মেরুকরণ করেছেন যিনি, তার বিদায়ের পর কি আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভাঙন জোড়া লাগবে ?
রোচেস্টার সেন্টার ফর বেহেভাইরল মেডিসিন বিভাগের সাইকোথেরাপিস্ট জেমি সাল এ ব্যাপারে বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, আমি মনে করি না যে জাতির সুস্থতা অর্জন প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের মতো সহজ কাজ হবে। সময় লাগবে, পরিশ্রম লাগবে। দুই দলকেই তা করতে হবে”।
২০১৬ সালে নির্বাচনে ট্রাম্পের কারণে পরিবারে-পরিবারে ভাঙন দেখা দেয়। বন্ধুত্বে দেখা দেয় ফাটল আর প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
গত সেপ্টেম্বরে দেশটির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার এক গবেষণায় দেখায়, ট্রাম্প ও বাইডেনের ৮০ শতাংশ সমর্থক বলেছেন— তাদের এমন কোনো বন্ধু নেই যিনি প্রতিপক্ষকে সমর্থন করেন। গ্যালপ পোলিং অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায়ও এমনই এক চিত্র উঠে আসে। ঐ সমীক্ষায় দেখানো হয়, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের তৃতীয় বছরের পর দলীয়করণ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বিভিন্ন অফিসের ৮৯ শতাংশ রিপাবলিকান কর্মকর্তা-কর্মচারী মনে করেন ট্রাম্প যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন তাই সঠিক। পক্ষান্তরে, ডেমোক্রেট সমর্থকদের মাত্র ৭ শতাংশ মনে করেন ট্রাম্প ভালো করছেন।
২০১৬ সালে ৭৭ বছর বয়েসী গায়লে ম্যাককরমিক তার ৮১ বছর বয়েসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটনা। এ বিচ্ছেদের কারণ হলো— তার স্বামী তখন ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। এবার এসব ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমি মনে করি সম্পর্কে ট্রাম্পের প্রভাব সহজে কাটবে না, এটি অনেক লম্বা সময় ধরেই চলবে”।
এখনও এ দম্পতি একসঙ্গে সময় কাটান। যদিও গায়লে থাকেন ভ্যানকুভের আর তার স্বামী থাকেন আলাস্কায়। ২০১৬ সালে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছিলেন বলে তার দুই নাতী এখনও তার সঙ্গে কথা বলে না। তার অন্যান্য ট্রাম্প সমর্থক বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
ডেমোক্রেট ভোটার ৪৯ বছর বয়েসী রোজানা গোদাগনো বলেন, “চার বছর আগে ট্রাম্পকে ভোট দিতে রাজি না হওয়ায় আমার ভাই আমার সঙ্গে তা সম্পর্ক ছিন্ন করে। গত বছর ভাইয়ের সঙ্গে থাকা মা স্ট্রোক করেছিলেন, তবে আমার ভাই আমাকে এ খবর দেয়নি। এর ছয় মাস পরে মা মারা যান। এ খবরও ভাই আমাকে দেয়নি। আমার বোনের স্বামী তিন দিন পর এক ইমেইলে আমাকে এ খবর জানান”।
রোজানা গোদাগনো স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সাইকোএনালিস্ট। এবার নির্বাচনে যেই জয়ী হোক, তিনি আশঙ্কা করছেন, ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আর আগের মতো কখনই জোড়া লাগবে না।
ট্রাম্প পরবর্তী অনিশ্চয়তা
ড্যানভারের স্প্যানিশ দোভাষী ৩৯ বছর বয়েসী সারাহ গুথ বলেন, তিনি তার জীবন থেকে বহু ট্রাম্প সমর্থকদের ঝাটিয়ে বিদায় করেছেন। অভিবাসীদের কাছ থেকে তাদের বাচ্চাদের আলাদা করার মতো বিষয়কে যারা সমর্থন করে তাদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখতে পারেন না বলে জানান তিনি। এছাড়া নারীদের যৌন হেনস্থাকারী ট্রাম্পকে যারা সমর্থন দেয় তাদের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক রাখা যায় না বলে মত তার। ২০১৬ সালে তার বাবা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। এখন অবশ্য বাবা-মেয়ে কথা বলেন তবে রাজনীতির বিষয় সতর্কভাবে এড়িয়ে চলেন।
গুথ বলেন, তিনি যে এবার জো বাইডেনকে সমর্থন দিচ্ছেন তার কিছু বন্ধু এটা মেনে নিতে পারছেন না। গর্ভপাত নীতির কারণেই তিনি বাইডেনের সমর্থক।
“এমন মৌলিক বিষয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিমত আছে। এটার অর্থ হলো আমরা মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত নয়। আমি মনে করি না ট্রাম্প পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কগুলো আর ঠিক হবে”— মৌলিক বিষয়ে একমত না হলে সম্পর্ক টিকে না বলেই মত সারাহ গুথের।।
পেনসিলভানিয়ার ৬৫ বছর বয়েসী ড্যাভ ওয়ালেস একজন কট্টর ট্রাম্প সমর্থক। তিনি অবশ্য আশাবাদী যে, ট্রাম্প পরবর্তী যোগে সম্পর্কগুলোর উন্নতি হবে। ওয়েলেস জানান, ট্রাম্পকে সমর্থন করায় তার ছেলে ও মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
তিনি বলেন, “ট্রাম্পের প্রতি ডেমোক্রেটদের ঘৃণা আমাকে অভিভূত করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মানুষকে যেভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেন, আমি মনে করি এটাই ট্রাম্প। আমার মতে, সে না থাকলে মানুষকে নিয়ে মোটেও ভাবেন না এমন রাজনীতিবিদদের আমলে সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক হয়ে যাবে”।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক জে জে ভ্যান বাভেল এসব ব্যাপারের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এখন আর শুধু গোষ্ঠীগত নয় বরং নীতিগতও হয়ে উঠেছে। কারণ ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মেরুকরণকারী চরিত্র। মৌলিক মূল্যবোধ ও এ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে মানুষ আসলে আপোষ করতে চায় না”।
৪৭ বছর বয়েসী জ্যাকলিন হ্যামন্ড যিনি তার ট্রাম্প সমর্থক মায়ের সঙ্গে আর কথাই বলেন না, এমনকি তার ছেলেকেও পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন দাদীর সঙ্গে কথা না বলে। তিনি বলেন, “আমি সম্পর্ক ঠিক করতে চাই, তবে মনে হয় এটা কঠিন হবে। ট্রাম্প যদি এবার হেরে যান, তবুও”।
তিনি বলেন, “ট্রাম্প হলেন ভূমিকম্পের অনুঘটকের মতো, যার কারণে ভাবনার দুই মহাদেশ বিভক্ত হয়ে গেছে। একবার পৃথিবী এভাবে বিভক্ত হয়ে গেলে আর ফেরার সুযোগ থাকে না”।
হ্যামন্ড বলেন, “২০১৬ সালের নির্বাচনের পর একদিন মা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি গাড়িতে বসেছিলাম। আমি হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে কথা বলার এক পর্যায়ে মা রেগে যান। তিনি গাড়ি থামিয়ে আমাকে বলেন— তার রাজনৈতিক অবস্থানকে অসম্মান না করতে। যদি তার রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি আমার কোনো সম্মান না থাকে তবে আমি যেন তার গাড়ি থেকে নেমে যাই”। হ্যামন্ড জানান, সেই দিনই প্রথম তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আসলে সম্পর্কে কত ভয়ঙ্কর অবনতি হয়ে গেছে।
-বার্তাসংস্থা রয়টার্স এর প্রতিবেদন