Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ধর্ষণকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ করেনি’


২৫ নভেম্বর ২০২০ ২১:৪৫

নারীর প্রতি সহিংসতায় নির্যাতনের শিকার নারীর নয়, দায় নির্যাতকের। তাই ধর্ষণের ঘটনাতেও ধর্ষককেই প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ করেনি। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে ধর্ষকের মেডিক্যাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বুধবার (২৫ নভেম্বর) থেকে শুরু হওয়া ১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে জাতীয় মহিলা পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর) ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস, ২০২০ পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নারীর প্রতি নির্যাতন রোধ করার জন্য আগামী ১৬ দিনের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি বেশ কিছু সুপারিশও দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা ও ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যুক্ত করেছে। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রচলিত আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি ও অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ক্ষমতা ও অর্থের প্রভাবসহ অন্য কোনো বিবেচনায় ছাড় না দিয়ে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার সব পর্যায়ে নিরাপত্তা, নিরাপদ আশ্রয়, ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি হলেও এসব দাবি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার যে নারী, তার প্রতি সমাজ অনেক বেশি কঠোর। কিন্তু ধর্ষকের প্রতি অতটা নয়। তাই ধর্ষককে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ করেনি। সমাজকে এই দুর্বৃত্তায়ন থেকে বের করতে হবে’।

বিজ্ঞাপন

এর জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি যে বিষয়গুলো জরুরি, সেগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সামাজিক ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে। প্রশাসনকে নারীবান্ধব হতে হবে। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাধারণ পর্যায়ে শিক্ষায় নারীর প্রতি বৈষম্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে বেড়ে চলা নারীর প্রতি সহিংসতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সেটি কমাতে শিক্ষায় এই বিষয়ক সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।’

ডা. ফওজিয়া আরও বলেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে, যা প্রশংসনীয় কিন্তু একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সংসদে দাঁড়িয়ে হেফাজতে ইসলামের সুরে সুর মিলিয়ে নারী নির্যাতনের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করছেন। সেটি আশঙ্কা জাগায়। আবার একজন সরকারি কর্মকর্তা তার অফিসে নারী-পুরুষের জন্য টাখনুর ওপর/নিচে পোশাক পরতে ও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও তার যথাযোগ্য শাস্তি হয় না। সরকারি নীতির বিরুদ্ধে কাজ করলেও তাকে ওএসডি করা হয়, কিন্তু তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এই পরিস্থিতিতে নারী প্রতি সহিংসতা দূর করা যথেষ্ট চ্যলেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় মহিলা পরিষদের আয়োজনে এই সংবাদ স্মমেলনে তারা নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা অবসানের জন্য বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইন সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়নসহ আইনের কার্যকর প্রয়োগে গুরুত্ব দেন। সেইসঙ্গে সমাজের গভীরে বিরাজমান নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নেতিবাচক চর্চার পরির্তনের দাবি তুলে ধরা হয়। আর তার জন্য সব শ্রেণিপেশার মানুষের সচেতন সম্মিলিত উদ্যোগ, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

এবারের আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে জাতীয় মহিলা পরিষদের স্লোগান— ‘ধর্ষণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এবং ‘আসুন, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি’। এই আহ্বানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২৯টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে—

  1. নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে দায়ী করার মানসিকতা পরিহার করতে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে;
  2. ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসাসহ ন্যায়বিচারপ্রাপ্তিতে সহায়তা করতে হবে;
  3. নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনার বিচারে সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে;
  4. নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে;
  5. কোর্টে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন নিষিদ্ধ করে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের বিধান পরিবর্তন করতে হবে;
  6. বৈবাহিক ধর্ষণের শাস্তির বিধান আইনে যুক্ত করতে হবে;
  7. ছেলেদের স্কুল-কলেজগুলোতে নারী ও কন্যা নির্যাতনবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে;
  8. নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব সামাজিক শক্তিকে এক হতে হবে;
  9. শিশু, কিশোর-কিশোরীদের খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে;
  10. নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে;
  11. ধর্ষণের শিকার নারী নয়, ধর্ষক পুরুষদের নিয়ে গবেষণা করে ধর্ষণের মূল কারণসমূহ অনুসন্ধান করতে হবে;
  12. বিদ্যমান আইনের প্রয়োগসহ দ্রুত মামলার বিচার ও শাস্তি কার্যকর করতে হবে;
  13. নারী ও কন্যা নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়, প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে;
  14. অপরাধীকে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় আনতে হবে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে;
  15. মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
  16. নিরাপদ অভিবাসনসহ দেশে ও বিদেশে নারী শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে;
  17. নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে অধিকতর কার্যকর, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করতে হবে;
  18. মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মুখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোনো বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে;
  19. উত্ত্যক্তকরণ, যৌন নিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে;
  20. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিংগার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্তে প্রটোকল বাস্তবায়ন করতে হবে;
  21. ধর্ষণকারীর মেডিকেল পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে;
  22. ধর্ষণকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ করেনি— এ বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
  23. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১২-এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে;
  24. পারিবারিক সংহিসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০-র বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সব পদক্ষেপ নিতে হবে;
  25. সামজিক অনাচার প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হবে;
  26. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে;
  27. সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সঠিকভাবে মামলা দায়েরসহ সহিংসতার সাথে যুক্তদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে;
  28. অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ)-এর ওপর থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে জাতিসংঘের সিডও সনদ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে; এবং
  29. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সব নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার)।

এছাড়াও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনের জন্য জাতীয় মহিলা পরিষদ বেশকিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ঘোষণা অনুযায়ী পক্ষকালব্যাপী ঢাকাসহ সব জেলায় ই-পোস্টার করা হবে। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার ও ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের দাবিতে নির্মিত টিভি স্পট অনলাইনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হবে। যথাক্রমে ৩০ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা শাখার সংগঠকদের প্যারালিগ্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

এছাড়া ৫ ডিসেম্বর বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংস্কার এবং সম্পদ-সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবিতে সারাদেশের প্যানেল আইনজীবীদের সঙ্গে অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে প্রশাসন, পেশাজীবীদের সঙ্গে অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৮ ডিসেম্বর নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধে মতবিনিময় সভা হবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। আর ১০ ডিসেম্বর আয়োজনের শেষ দিন বিকেল ৩টায় ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ জাতীয় মহিলা পরিষদ ডা. ফওজিয়া মোসলেম নারী নির্যাতন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর