পৃথুলা, এই জন্মের ভুল শুধরে নিও ওপারে!
১৫ মার্চ ২০১৮ ১২:০৮
পৃথুলাকে নিয়ে লিখতে হবে। কেন পৃথুলাকে নিয়েই লিখতে হবে?
বিমান দুর্ঘটনায় মরে যাওয়া প্রায় অর্ধশত মানুষের মধ্যে পৃথুলাকে নিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে তার কারন, পৃথুলা হতভাগ্যদের মধ্যেও হতভাগ্য। পৃথুলা মৃতদের মধ্যে ততোধিক মৃত। পৃথুলা লাশ হয়েও রেহায় পায়না, কারন পৃথুলা মেয়ে। পৃথুলা মরেও বাঁচতে পারেনা। পারেনা, কারন পৃথুলার জন্ম মানুষের জন্ম নয়, নারীজন্ম। আজীবন উচিত অনুচিতের পরাকাষ্ঠা পেরিয়ে মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়েও সে জন্মের খেসারত দিতে হয়, সে জন্মের নাম নারীজন্ম।
হায়রে পৃথুলা! বড় ভুল সমাজে, ভুল যায়গায় এসে পড়েছিলে তুমি। যে সমাজে নারীদের আকাশের দিকে তাকানোই নিষেধ, যে সমাজে মেয়েদের স্কুলিং হয় ঘাড় তুলে না হাঁটার, যে সমাজে মেয়েরা সেক্স অবজেক্ট ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠেনি এখনো, সেই সমাজে বাস করে একজন নারী উপরে উঠবে, চালকের আসনে বসবে তাও আবার আকাশযানের সেটা এই পুরুষের সমাজ, পুরুষের মগজ হজম করবে!! করবেনা। করবেনা বলেই বিমান চালক হয়েও পৃথুলার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
নারীর যোগ্যতাকে বিনাপ্রশ্নে মেনে নিয়েছে আর কবেই বা মেনে নিয়েছে এই সমাজ!! “মেয়ে হয়ে বিমান চালালে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই”…”পুরুষ পাইলটের সহকারী নারী পাইলট…নিশ্চয়ই প্রেম-ঘুজুর-ফুসুর করছিলো…সুন্দরী নারী পাশে নিয়ে প্লেন চালালে কন্ট্রোলতো হারাবেই”.. এসবই তো যৌন অবদমন আর বিকৃতির এই সমাজের সরল উচ্চারণ। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক স্কুলিং কাব্য,গাঁথা, জারি, উপন্যাস, গল্প, চিত্রকলা, সকল শিল্পকলাতেই পুরুষের মনে নারীর সৌন্দর্যের স্তব আর স্তুতি দিয়ে নারীকে যেভাবে রমণ আর যৌনতার উপাদান করে চিত্রায়িত করেছে যুগ যুগ ধরে তারই ফসল এগুলো। পুরুষের চোখে নারী মানুষ হয়ে উঠতে পারেনা কখনওই। পুরুষের মনস্তত্ত্বে নারী কেবলই নিষ্ক্রিয় সৌন্দর্যে যৌনাবেদনময়ী বস্তু। নারীর যৌবন কেবলই পুরুষের ভোগ্য আর উপভোগ্য। পুরুষ নারীকে বিবেচনা করে হয় দেবী, নয় দাসী হিসেবে। নারী তাই হয়ে ওঠে তাই পুরুষ তাকে যেভাবে চায়। পুরুষতন্ত্র তার পার্পাস সার্ভ করার জন্য যে নারীকে ছলা কলা কল্পলোকে দেবী বানায়, স্বার্থোদ্ধার হলেই সে নারীকে নিষ্ক্রিয় করে দাসত্বের শেকল পরিয়েছে।
পুরুষের একচ্ছত্র কামনা-বাসনা-বিলাসিতা, ভোগ-উপভোগ ও কল্পনার ক্ষুধা মেটানোর প্রয়োজনে নারীর জন্য গণ্ডী এঁকে রেখেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, শিক্ষা-দীক্ষা-প্রথা আর কানুনের। তবুও কোন কোন নারী সেই গণ্ডী কেটে ঠিক বেরিয়ে পড়ে জীবনের দীগন্তে। সেই নারীরা জীবনের দামে স্বাধীনতা কিনে নেয়। সারাজীবন তারা স্বাধীনতার মুল্য শোধ করে, মরেও শোধ করে।
পুরুষের পৃথিবীতে কাঁটাতার পেরিয়ে কোন নারী জীবনের প্রান্ত ছুঁতে পারেও যদি, তাকে জীবন থাকতে প্রতি পদে পদে ঘরে বাইরে জিতে জিতে উপরে উঠতে হয়। মরেও তাকে প্রমাণ করতে হয় তার উপরে ওঠাটা স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ছিলো। তবুও আমাদের পৃথুলারা ঠিকই পুরুষের একে দেয়া গণ্ডী পেরিয়ে, সকল শেকল মাড়িয়ে, পুরুষতন্ত্রের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ঠিক উপরে উঠে যায়।
পৃথুলার অপরাধ কম নয়। এই পুরুষোত্থিত দেশে পৃথুলা উর্ধাকাশ ভেদ করে আরো আরো আরো উপরে উঠেছিলো। যতদুর উপরে উঠলে নারীজন্মের শেকল কাটানো যায়, তত উপরে উড়ে গিয়েছিলো মেয়েটি। যতদুর উপরে উঠলে “নারী কেন পাইলট” বলা পুরুষ শ্বাপদগুলার অণ্ডকোষে কষে লাত্থি মারা যায় ততটুকু উপরেই সে উঠে গিয়েছিলো।
এতো উপরে উঠেছিলো বলেই আমরা অনেকেই যা পারিনা, আমরা অনেকেই যা করিনা পৃথুলা তাই পেরেছিলো, তাই করেছিলো। নিজে মরতে মরতে দশজন ভিনদেশীর জীবনকে নিরাপদে তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। তারপর এই বীরকন্যা চুপচাপ মৃত্যুকে ভালোবেসেছিলো।
নেপালের গণমাধ্যম এই বীরকন্যাকে “ডটার অব বাংলাদেশ” বলে মেনশন করেছে। আমরা এই বাংলাদেশের মানুষরা (পড়ুন পুরুষ) এই মেয়েটিকে বিমান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে মিড়িয়া ট্রায়াল করে ছেড়েছি।
পৃথুলা, তুমি শান্তিতে ঘুমাও। ওই জীবনে নিশ্চয়ই আর তোমাকে নারীজন্মের দায় শোধ করতে হবেনা। পারলে এই জন্মের ভুল শুধরে নিও সোনা। আর জন্মে এই পুরুষের সমাজে জন্ম নিওনা।
সারাবাংলা/এসএস