পুকুর পারে ঘুমিয়ে আছেন মোস্তফা কামাল
১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:৩১
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী হিসেবে ৭ জনকে দেওয়া হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব। তাদেরই একজন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল।
জন্মস্থান দ্বীপজেলা ভোলা হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরুইন গ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহী মোস্তফা কামাল।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে। তার পিতা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন মোস্তফা কামাল। পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে পা দিয়েছিলেন তবে শেষ করতে পারেননি।
মোস্তফা কামালের ছেলেবেলা কেটেছে তার পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে। বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চেয়ে সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভালো লাগতো তার। সেই থেকেই তিনি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং মন স্থির করেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। ১৯৬৭ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে হঠাৎ করেই মোস্তফা কামাল নিরুদ্দেশে হয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হবার পরে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন।
১৯৭১ সালের প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। তখন সারাদেশে যুদ্ধের বীভৎসতা ছড়িয়ে পড়ে। সেনানিবাসগুলোতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে এন্ডারসন খালের পারে। আখাউড়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুইন গ্রামের দুই নম্বর প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়। সিপাহী মোস্তফা কামাল ছিলেন দুই নম্বর প্লাটুনে। কর্মতৎপরতার জন্য যুদ্ধের সময় মৌখিকভাবে তাকে ল্যান্সনায়েকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। ১৮ এপ্রিল ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার ও আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সাথে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১১ নম্বর প্লাটুন নিয়ে হাবিলদার মুনির দরুইনে পৌঁছেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার নিকট থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করেন। বেলা ১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। সেই সময়ে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে গুলি বর্ষিত হয়। ১২ টার দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। কয়েক জন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। তার পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্দমে এলএমজি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। এতে করে শত্রুরা তার সঙ্গীদের পিছু ধাওয়া করতে সাহস পায়নি। একসময় গুলি শেষ হয়ে গেলে, শত্রুর আঘাতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন।
মোস্তফা কামাল শহীদ হওয়ার পর সেখানেই কয়েকদিন তার মরদেহ পড়েছিল। পরে গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত হলে স্থানীয়রা এসে মোস্তফা কামালকে পুকুরের অপর পাড়ে সমাহিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেওয়া হয় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে। তার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। এছাড়া মোস্তফা কামালের নামানুসারে গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর৷